আজব তারার গল্পকথা

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ভারতীয় দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্ধান পেলেন এক আজব জাতের নতুন তারার। যেগুলো তৈরি হয়েছে বহুকাল আগে অর্থাৎ সৃষ্টির সেই সূচনালগ্নের তৈরি তারাদের ভগ্নাবশেষ দিয়ে। লিখছেন অর্পণ পাল

Must read

ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের অধীন এক প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ (indian institute astrophysics), এর অবস্থান বেঙ্গালুরুতে। এই সংস্থার দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী সম্প্রতি এক নতুন ধরনের তারা খুঁজে পেয়েছেন, যার গঠন এবং অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা যথেষ্ট বিস্মিত। জাপানের SUBARU টেলিস্কোপের সঙ্গে যুক্ত থাকা খুবই শক্তিশালী একটি স্পেক্ট্রোস্কোপের সাহায্যে (স্পেক্ট্রোস্কোপ হল এমন এক যন্ত্র যার মধ্যে দিয়ে আকাশের তারা বা যে কোনও আলোকিত বস্তু থেকে আসা আলোর বর্ণালি তৈরি করে তা নাড়াচাড়া করে ওই তারার উপাদান এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে দরকারি তথ্য পাওয়া যায়) তাঁরা বহু আলোকবর্ষ দূরের ওই তারার পৃষ্ঠতলের রাসায়নিক গঠন কেমন তা দেখবার চেষ্টা করেন আর এই কাজটা করতেই গিয়েই তাঁরা জেনেছেন এক অদ্ভুত তথ্য। যা এতদিন ধরে চলে আসা এক নিয়মকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

অরুণা গোস্বামী
পার্থপ্রতিম গোস্বামী

 

এই কাজের মুখ্য পরিচালক পার্থপ্রতিম গোস্বামী। তাঁর সঙ্গে সঙ্গতে আছেন অরুণা গোস্বামী। এঁদের এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ জার্নালে। তাঁরা নতুন এই তারাটির নাম দিয়েছেন HE 1005-1439। অবাক হওয়ার কিছু নেই, নতুন আবিষ্কৃত হওয়া তারা বা গ্রহদের এরকমই খটমটে নাম দেওয়া হয়ে থাকে। এই তারাটি যে গোত্রের, সেটাকে বলে ‘কার্বন-এনহ্যান্সড মেটাল-পুওর স্টার’ (CEMP Star)। এর অর্থ, এইসব তারার মধ্যে কার্বনের ভাগ বেশ বেশি; এবং এগুলো তৈরি হয়েছে এমন কিছু তারার ভগ্নাবশেষ দিয়ে, যেগুলো আবার তৈরি হয়েছিল বহুকাল আগে, সৃষ্টির একেবারের সূচনা-মুহূর্তে, মানে সেই বিগ ব্যাং-এর সময়। মূলত বামন তারা বা ‘ডোয়ার্ফ স্টার’, দৈত্যাকার তারা বা ‘জায়ান্ট স্টার’ বা এগুলোর মাঝামাঝি থাকা আরও কয়েকরকম তারা এই ভাগে পড়ছে।
এটাও এখানে বলে নেওয়া দরকার যে এই ধরনের তারাদের মধ্যে লোহার পরিমাণ খুবই কম, আমাদের সূর্যের মধ্যে যত পরিমাণ লোহা আছে, তার হাজার ভাগের এক ভাগ। এই ধরনের তারা যে পদ্ধতিতে তৈরি হয়, সেই বিষয়টার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ওই গবেষকদের আবিষ্কৃত তারাটির বিশেষ চরিত্রের রহস্য।

আরও পড়ুন- বাংলাভাগ! অনন্তকে তোপ তৃণমূলের

তারাদের টিকে থাকবার রসায়ন
এতকাল জানা ছিল যে তারাদের মধ্যে মূল যে ঘটনার ফলে ওদের টিকে থাকবার শক্তি ওরা পায়, তা হল নিউক্লীয় সংযোজন নামে একটি ঘটনা। যেখানে হাইড্রোজেনের মতো কিছু হালকা পরমাণুর নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে তৈরি হয় হিলিয়ামের মতো কিছু পরমাণু, যার ফলে তৈরি হয় প্রচুর শক্তি। পরমাণু বোমায় যে ঘটনাটা ঘটে তা হল নিউক্লীয় বিভাজন, ওখানেও প্রচুর শক্তি তৈরি হয়। আর তারাদের মধ্যে ঘটে নিউক্লীয় সংযোজন, যে ঘটনা কাজে লাগিয়ে হাইড্রোজেন বোমা তৈরি হয়।
তারাদের মধ্যে হিলিয়াম ছাড়াও আরও বহু মৌল তৈরি হয়, মহাবিশ্বে এইসব মৌল তৈরির মূল আঁতুড়ঘর আসলে ওই তারারাই। আমাদের পৃথিবীতেও যে মৌলগুলো এ-পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, সেগুলিরও মূল উৎস কিন্তু এই বিভিন্ন জাতের তারারা। তবে লোহার চেয়ে ভারী মৌল তারাদের মধ্যে যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়, সেটার নাম ‘নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেস’, বাংলায় বলতে পারি নিউট্রন আবদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। এর দুটো ভাগ— স্লো বা ধীরগতি প্রক্রিয়া (সংক্ষেপে s-process) এবং র্যাপিড প্রসেস (r-process) বা দ্রুতগতি প্রক্রিয়া। আসলে ভাগ তিনটি, মাঝে-মধ্যে এই দুই পদ্ধতি ছাড়াও এক ধরনের প্রক্রিয়াও ঘটে, যেটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইন্টারমিডিয়েট প্রসেস’ বা মধ্যবর্তী প্রক্রিয়া। স্লো প্রক্রিয়া ঘটে অপেক্ষাকৃত হালকা তারাদের ক্ষেত্রে, আর র্যাপিড প্রসেস দেখা যায় নিউট্রন স্টারদের মতো ভারী তারাদের সংযুক্তীকরণের বেলা। আর অপেক্ষাকৃত হালকা এক জাতের বিশেষ তারাদের ক্ষেত্রে কখনও-কখনও এমন এক দশা আসে, যেটাকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যাসিম্পটোটিক জায়ান্ট ব্রাঞ্চ’ (AGB), ওই সময় এই মধ্যবর্তী প্রক্রিয়া ঘটে। তবে অনেক সময় এই ধরনের হালকা তারাদের ক্ষেত্রে ধীরগতির প্রক্রিয়াও ঘটতে দেখা যায়। কোন তারার ক্ষেত্রে কোন প্রক্রিয়া ঘটবে, সেটাই বিজ্ঞানীরা বহু তারার তথ্য ঘেঁটে বিশ্লেষণ করে দেখেন এবং ওই ব্যাপারগুলো মহাবিশ্বের গঠন সম্বন্ধে ধারণা পোক্ত করতে সাহায্যে আসে।

এই তারা আলাদা অন্যদের চেয়ে
তবে সদ্য-আবিষ্কৃত এই বিশেষ তারাটির উপরিতলে পাওয়া বিভিন্ন মৌলের চিহ্ন বিশ্লেষণ করে ওঁরা দেখেছেন যে এক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, তা হল এই তারাটি তৈরি হয়েছে এমন এক পদ্ধতিতে, যেখানে একটু আগে যে তিনটি পদ্ধতি বললাম, তার মধ্যে দুটি— স্লো আর ইন্টারমিডিয়েট প্রসেস— এই দুটোর প্রতিটাই ঘটেছে এই বিশেষ তারাটির মধ্যে। ওই তারাটি সৃষ্টির সময় ওর মধ্যে বিভিন্ন ভারী মৌল তৈরি হয়েছে এই দু-ধরনের আলাদা প্রক্রিয়ায়, এটাই জেনে বিস্মিত ওই বিজ্ঞানীরা। এতদিন নতুন তারা গড়ে ওঠবার যে সব প্রক্রিয়া জানা ছিল বিজ্ঞানীদের, এখানে দেখা গিয়েছে যে সেইরকম দুটো প্রক্রিয়া এই তারাটির তৈরিতে একই সঙ্গে যেন ঘটে গিয়েছে। কিন্তু এটা কেমন করে বা কীভাবে হল, সেটাই এখন ওঁদের কাছে রহস্য। এর আগে এরকম কোনও তারারই সন্ধান মেলেনি যেখানে একই সঙ্গে দুটো প্রক্রিয়াই ঘটেছে। সেই হিসেবে এই তারাটি একেবারেই ইউনিক। আগামী দিনে তারা-সৃষ্টির প্রক্রিয়া লিখতে গেলে সেখানে এই ঘটনাটিকে বিশেষ ব্যতিক্রম হিসেবে রাখতেই হবে, এটাই বক্তব্য ওঁদের।

Latest article