বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য সংলাপ। তুমুল ব্যস্ততা সাজঘরে। আলো ঝলমলে মঞ্চ। ছুটছে সময়। উঠছে অভিনয়ের ঢেউ। জুটছে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া। উপলক্ষ দ্বাবিংশ নাট্যমেলা। এই মুহূর্তে চলছে কলকাতা পর্যায়। মহানগরের দর্শকরা দেখছেন জেলার নাটক। কলকাতার নাটক দেখবেন জেলার দর্শকরা। এইভাবেই মিশে যাচ্ছেন সবাই, দূর হয়ে যাচ্ছে সমস্ত ভেদাভেদ। নাট্যমেলার হাত ধরে ঘটছে সংস্কৃতির মহামিলন।
আরও পড়ুন-বিজেপি শাসিত হরিয়ানায় পুড়িয়ে খুন দুই যুবককে, অভিযুক্তরা বজরং দলের সদস্য
১৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রবীন্দ্র সদনে সূচনা হয় নাট্যমেলার। উদ্বোধন করেন রাজ্যের মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী। ছিলেন রাজ্যের আরও দুই মন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও ইন্দ্রনীল সেন এবং নাট্যব্যক্তিত্ব মেঘনাদ ভট্টাচার্য, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সচিব শান্তনু বসু, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সদস্য-সচিব দেবকুমার হাজরা প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সভাপতি দেবশঙ্কর হালদার। আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি।
আরও পড়ুন-দিল্লি-মুম্বই অফিস বন্ধ করল ট্যুইটার
উদ্বোধক রাজ্যের মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী বলেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। কারণ মানুষ অন্য প্রাণীদের মতো শুধুমাত্র খেয়ে বেঁচে থাকে না। চিন্তা করতে জানে। নিজেকে কর্ষণ করে উন্নত থেকে উন্নততর করতে জানে। কয়েকটা শব্দকে পাশাপাশি বসিয়ে বাক্য গঠন করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। মানুষই প্রথম বন-জঙ্গলের জীবন ছেড়ে ভূমি কর্ষণের মধ্যে দিয়ে চাষবাস শুরু করে। পেটের খিদে মেটানোর জন্য। তারপরে মেটায় মনের খিদে। কৃষি কাজের সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতির নিবিড় যোগ। একজন পরিণত মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচতে হলে তার শরীর এবং মন দুটোরই বিকাশ দরকার। অন্যকে অনুকরণ করতে করতেই সৃষ্টি হয়েছে নাটকের। ভারতবর্ষের নাটকের ইতিহাস বহু প্রাচীন। তারপর এসেছে বাংলা নাটক। আমরা পেয়েছি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এসেছেন শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য। এখন রঙ্গমঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মেঘনাদ ভট্টাচার্য, ব্রাত্য বসু, দেবশঙ্কর হালদাররা। দীর্ঘ ইতিহাস। সবাই আসুন, নাটক দেখুন। আমিও নাটক ভালবাসি। সময় সুযোগ পেলেই দেখি। সফল হোক এবারের নাট্যমেলা।
আরও পড়ুন-আদানি-কাণ্ডে মোদির জবাব চান মার্কিন ধনকুবের সোরেস
মন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর নাট্যমেলার জন্য এই বছর প্রায় দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। তাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সাহায্য করেছেন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনও। তাঁকেও ধন্যবাদ। এবারের নাট্যমেলা বহরে ব্যাপ্তিতে গতবারের তুলনায় দ্বিগুণ। আমরা কলকাতার দলগুলোকে জেলায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব, জেলার ভালো দলগুলোকে নিয়ে আসার চেষ্টা করব কলকাতায়। এর ফলে একটা দ্বিমুখী তরঙ্গ তৈরি হবে রাজ্যের মধ্যে। নাট্য আকাদেমি বরাবর দর্শক তৈরি করতে চেয়েছে, দর্শক বাড়াতে চেয়েছে, নাটককে ছড়াতে চেয়েছে। আদি লগ্ন থেকেই থিয়েটার উৎসবকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে। কারণ থিয়েটারে উৎসবের প্রয়োজনীয়তা আছে। এখান থেকে জরুরি থিয়েটার উঠে আসতে পারে। হাজার বছর আগের থিয়েটার, সংলাপ শুনলে অনেক সময় মনে হয়, আজকের কথা, এই সময়ের কথা। এটাই জরুরী থিয়েটার। এখন হাতে নানারকম অপশন। তার মধ্যেও মানুষ থিয়েটার দেখতে আসছেন। কারণ থিয়েটার হল সমাজের এক্স-রে।
আরও পড়ুন-রাজ্যপালরা বিজেপির এজেন্টের কাজ করছেন, বিজয়নের ‘বাংলা’ বক্তব্যকে সেন্সর
মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন বলেন, কোভিড পিরিয়ডেও আমরা নাট্যমেলার আয়োজন করেছি। এবারের আয়োজন অনেকটাই বড়। কলকাতার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত হবে নাট্যমেলা। দেবশঙ্কর হালদার, ব্রাত্য বসুরা কাজটাকে যথাযথভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। নাট্যমেলায় সপরিবারে আসুন। নাটককে ঘিরে কয়েকটা দিন মহানগর উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠুক।
নাট্য ব্যক্তিত্ব মেঘনাদ ভট্টাচার্য বলেন, নাট্যমেলায় আগের থেকে অনেক বেশি অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। কলকাতার দলগুলো শুধুমাত্র সুযোগ-সুবিধা পাক, এটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার চান না। তাই সমস্ত জেলার দলগুলো যাতে সমান সুযোগ-সুবিধা পায়, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এইভাবেই নাট্য আকাদেমির কাজ ছড়াচ্ছে। ফলে রাজ্য জুড়ে যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা নাটক নিয়ে কাজ করছে, তারা অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে নাট্য আকাদেমির প্রতি। নাট্যমেলার নির্বাচন এবং সম্মাননা প্রদানের ব্যাপারেও জেলার দলগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতা আমাদের বজায় রয়েছে। জোর গলায় বলতে পারি, এতে কোন রাজনৈতিক পক্ষপাত থাকে না। কে কোন রাজনীতি করেন, কার কোন রাজনৈতিক দর্শন, এটা নিয়ে আমরা মোটেও আগ্রহী নই। তিনি কেমন থিয়েটার করেন, সেটা নিয়েই আমাদের আগ্রহ।
আরও পড়ুন-জঙ্গলমহলের সঙ্গে জুড়ল উত্তরবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সভাপতি দেবশঙ্কর হালদার বলেন, থিয়েটার নামক কর্মকাণ্ডে সবাইকেই পাশে লাগে। সমর্থন করলেও লাগে, বিরোধিতা করলেও লাগে। আমাকে পছন্দ করুন অথবা অপছন্দ, দয়া করে ছেড়ে যাবেন না। থিয়েটার ডাক দিয়েছে, আপনারা ছুটে এসেছেন। এইভাবেই আমাদের সঙ্গে থাকুন। জেলায় জেলায় আয়োজিত হবে নাট্যমেলা। আপনাদের মারফত বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক। সবাইকে আসতে বলুন। বলুন তর্ক করতে, ভাবতে, প্রতিবাদ করতে, সমর্থন করতে। মোট কথা সবাইকে আমাদের পাশে চাই।
এবারের উদ্বোধনী নাটক ছিল স্বপ্নসন্ধানী প্রযোজিত শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডি ‘হ্যামলেট’। নির্দেশনা এবং অভিনয়ে ছিলেন কৌশিক সেন। নাম ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন ঋদ্ধি সেন। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নাটকটি মঞ্চস্থ হয় এবং দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নেয়। নাটক শেষে পরিচালকের হাতে স্মারক এবং পুষ্পস্তবক তুলে দেন সাংসদ জহর সরকার। তিনিও নাটকটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
আরও পড়ুন-কুঠার ছেড়ে তুলি, রামধনু-রঙ স্বপ্ন বুনছে আদিবাসীদের খোয়াব গাঁ
২১৩টি নাট্যের অভিনয় থাকছে এবারের নাট্যমেলায়। রবীন্দ্রসদন, মধুসূদন মঞ্চ, গিরিশ মঞ্চ, নিউ টাউন রবীন্দ্রতীর্থে মঞ্চস্থ হচ্ছে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক। মূলত দুটো শো। দুপুর ৩টে এবং প্রতিদিন সন্ধে ৬-৩০টায়। মিনার্ভা থিয়েটার এবং শিশির মঞ্চে মঞ্চস্থ হচ্ছে স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক। প্রতিদিন বিকেল ৩টে, ৪-৩০টা, সন্ধে ৬টা, ৭-৩০টায়। পাশাপাশি অন্তরঙ্গ থিয়েটার মঞ্চস্থ হচ্ছে তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে। প্রতিদিন সন্ধে ৬টায় এবং ৭টায়। এ ছাড়াও আছে মূকাভিনয় এবং পুতুল-নাটক। গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শশালায় আয়োজিত হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনী। শিরোনাম ‘দেড়শো বছরে বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়’। উদ্বোধনের পর ঘুরে দেখেন অতিথিরা। গত দুই দিন বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহ এবং প্রদর্শনীতে দর্শক সমাগম ছিল ভালই। কলকাতা পর্যায়ের এই নাট্যমেলা চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তারপর শুরু হবে জেলা পর্যায়ের নাট্যমেলা। কোচবিহার রবীন্দ্র ভবনে ১০-১৫ মার্চ, চন্দননগর রবীন্দ্র ভবনে ১২-১৭ মার্চ, অশোকনগর শহিদ সদন, বাঁকুড়া রবীন্দ্র ভবন, বহরমপুর রবীন্দ্র ভবনে নাট্যমেলা অনুষ্ঠিত হবে ১৩-১৮ মার্চ। অংশ নেবে কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন নাট্যদল। বিশিষ্ট থেকে সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকেই প্রশংসা করছেন রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগের।