প্রতিবেদন: জোশীমঠের (Uttarakhand’s Joshimath) পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছে। ধসে পড়ছে একের পর এক বাড়ি। প্রায় ৬০০-রও বেশি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। হোটেল, রাস্তাতেও চওড়া ফাটল দেখা দিয়েছে। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার জোশীমঠে এখন শুধুই আতঙ্ক। গৃহহীন মানুষ রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। কনকনে ঠান্ডায় প্রবল কষ্টে পড়েছেন মানুষ। রাস্তায় ফাটল ধরায় যান চলাচলও স্তব্ধ। ফলে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে জোশীমঠ। ফাটল দেখা দিয়েছে শঙ্করাচার্য মঠেও। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিজেপি সরকারের ব্যর্থতায় এই বিপর্যয়। বিজেপি সরকার যদি সময় থাকতে ব্যবস্থা নিত তবে এই করুণ পরিস্থিতিতে পড়তে হত না জোশীমঠের বাসিন্দাদের। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রের খবর, জোশীমঠের এই বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চামোলি জেলার জোশীমঠ-মালারি বর্ডার রোড। এই সড়ক এলাকার সঙ্গে সরাসরি চিন সীমান্তের সংযোগ স্থাপন করেছে। সীমান্তগামী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের একাধিক জায়গায় দেখা দিয়েছে ধস। যা গভীর উদ্বেগে ফেলেছে প্রশাসনকে। রবিবার বিকেলে জোশীমঠ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আধিকারিকদের পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যসচিব। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব পিকে মিশ্র। সেখানে তৈরি হয় ৭ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল। এর কাজ হবে জোশীমঠের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে কেন্দ্রকে জানানো, এই পাহাড়ি জনপদকে আদৌ বাঁচানো সম্ভব কিনা। জোশীমঠকে বাঁচেতে স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষজ্ঞ টিম একযোগে কাজ করছেন।
জোশীমঠে (Uttarakhand’s Joshimath) এখনও পর্যন্ত ৬০টি পরিবারকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আরও ৯০টি পরিবারকে সরানো হবে। জোশীমঠকে ধসপ্রবণ এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জোশীমঠের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দেবে আইআইটি রুরকি, জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি, সেন্ট্রাল বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
আরও পড়ুন-ইরানের নিন্দায় সরব গোটা দুনিয়া
ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষের উপর জোশীমঠ তৈরি হয়েছে। ১৯৭৬ সালেই ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, এই শহরের আয়ু বড়জোর ১০০ বছর। এই শহরে নগরায়নের ক্ষেত্রেও সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সতর্কবার্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো একের পর এক হোটেল তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে বাড়ি। সুড়ঙ্গ খনন করে, বোল্ডার বসিয়ে চওড়া করা হয়েছে বিভিন্ন রাস্তা। জোশীমঠের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া অলোকানন্দা নদীতে একাধিক বাঁধ ও জলাশয় তৈরি করা হয়েছে। ফলে নদীর বুকে মাটির চাপ বেড়েছে। অপরিকল্পিতভাবে একাধিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলায় মাটি আরও আলগা হয়েছে। এই সব কাজ করতে গিয়ে নির্বিচারে কাটা হয়েছে গাছ। ফলে মাটির ক্ষয় আরও দ্রুত হয়েছে। এসবের জেরেই এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে জোশীমঠ। জোশীমঠের পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তনের পিছনে প্রধান কারণ হল মেইন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট (এমসিটি-২) এর পুনরায় সক্রিয়করণ। এটি ভূতাত্ত্বিক ত্রুটি যেখানে ভারতীয় প্লেট হিমালয় বরাবর ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঠেলে দিয়েছে। কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক ডাঃ বাহাদুর সিং কটলিয়া বলেছেন, এই এমসিটি-২ জোনটি পুনরায় সক্রিয় হয়েছে, যার ফলে জোশীমঠের মাটি বসে যাচ্ছে। এই পুনঃ সক্রিয়তা কখন ঘটবে সে বিষয়ে কোনও ভূতাত্ত্বিকই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন না। আমরা দুই দশক ধরে সরকারকে সতর্ক করে আসছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত সবই উপেক্ষা করা হয়েছে।
প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়া যায় না। কটলিয়া সতর্ক করে বলেছেন, শুধু জোশীমঠেই এমন ঘটনা ঘটবে না, উত্তরকাশী, নৈনিতালও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। লাগামছাড়া নগরায়ণের কারণেই ১০০ বছরের পরিবর্তে এই প্রাচীন শহরের আয়ু ৫০ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে সেটা কেউই কল্পনা করতে পারেননি। এরই মধ্যে সামনে এসেছে প্রশাসনিক গাফিলতির এক ঘটনা। জোশীমঠে যে ভয়ঙ্কর কিছু হতে চলেছে, তার ইঙ্গিত আগেই পেয়েছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা। সেই উদ্বেগের কথা জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামি এবং স্থানীয় জেলাশাসককে চিঠিও দিয়েছিলেন। তবে তিনবার চিঠি দেওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে সৌজন্য খাতিরে সেই চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারও করা হয়নি। অন্যদিকে জেলাশাসক বুঝতে পারেননি এই চিঠির কী উত্তর দেবেন। এঘটনায় স্পষ্ট হচ্ছে জোশীমঠের এই বিপর্যয় কার্যত বিজেপি সরকারের উদাসীনতার ফল।