অ্যাডিনো ভাইরাস আগেও ছিল। সাম্প্রতিক বাড়াবাড়ির কারণ কী? শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কেন?
অ্যাডিনো ভাইরাস আগেও ছিল। এখনও আছে। আগেও সংক্রমণ হত। এখনও হয়। একটা সিজিনেই এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এবার যেমন মাথাচাড়া দিয়েছে ফেব্রুয়ারি-মার্চে। সাম্প্রতিক বাড়াবাড়ির কারণ হতে পারে অ্যাডিনো ভাইরাসের নতুন কোনও স্টেইন। আর একটা ব্যাপার, করোনার সময় মানুষ যথেষ্ট সতর্ক ছিল। বাইরে কম বেরোত, এড়িয়ে চলত ভিড়। ঢেকে রাখত মুখ। ধুয়ে নিত হাত। করোনার প্রভাব কমে যাওয়ার পর শুরু হল বাইরে বেরোনো, কমে গেল মাস্ক, স্যানিটাইজার ব্যবহার। ঠিক এই সময় আক্রমণ করল অ্যাডিনো ভাইরাস। এটাও একটা কারণ হতে পারে। অ্যাডিনো ভাইরাস আগে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যেত না। তাই অতীতে কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে পরিসংখ্যান দেওয়া খুব কঠিন। এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে জানা যায় কোনটা অ্যাডিনো ভাইরাসের প্রভাবে সংক্রমণ। অ্যাডিনো খুবই ক্ষতিকর ভাইরাস। কো-মরবিডিটির থাকলে অ্যাডিনোর প্রভাবে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। উপসর্গবিহীন বাহকরা নিঃশব্দে রোগটা বেশি ছড়াচ্ছে। এই ভাইরাস হার্ট এবং কিডনির ক্ষতি করতে পারে। ক্ষতি করতে পারে শ্বাসনালির। শ্বাসতন্ত্রের দুটো ভাগ। একটা উপরের দিকে থাকে, একটা নিচের দিকে। ওপরের অংশে সর্দি ইত্যাদি হয়। নিজে থেকেই মোটামুটি সেরে যায়। নিচের অংশে হয় নিউমোনিয়া। অ্যাডিনো ভাইরাসের প্রভাবে নিউমোনিয়া হলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত শিশুদের। কারণ শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম। এর ফলে সমস্যা বাড়ে। ঘটে যেতে পারে প্রাণহানিও। সাম্প্রতিক অতীতে এইভাবেই কিছু শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তবে আমরা চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে অনেক শিশুকে সুস্থ করে তুলতে পেরেছি।
আরও পড়ুন-টিকাকরণে আরও সচেতন হোক নারী
এই পরিস্থিতি সামাল দিতে কী কী করণীয়?
মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে কোভিডের কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই। অ্যাডিনো ভাইরাসের মোকাবিলায় প্রথম যেটা করণীয় সেটা হল, মানুষকে ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে ভাইরাস যাতে বেশি ছড়াতে না পারে। এড়িয়ে যেতে হবে ডাইরেক্ট এবং ইনডাইরেক্ট কন্ট্যাক্ট। ট্রেনে-বাসের হাতল ধরে নাকে মুখে চোখে হাত না দেওয়াই ভাল। ভিড় জায়গায় আক্রান্ত লোকজন হাঁচলে তার ড্রপলেট থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। ভাইরাস ছড়াতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা কলম থেকেও। এই রুটগুলো আগে বন্ধ করতে হবে। তার জন্য বারবার হাত ধুতে হবে, অপ্রয়োজনে মুখে-নাকে-চোখে হাত দেওয়া যাবে না, এড়িয়ে চলতে হবে ভিড়, ব্যবহার করতে হবে মাস্ক। বিশেষত যার জ্বর-সর্দি-কাশি হয়েছে তাকে মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে। তাতে রোগ ছড়াবে কম। যার জ্বর-সর্দি-কাশি হয়নি সে মাস্ক ব্যবহার করবে নিজে রোগমুক্ত থাকার জন্য। আক্রান্ত মানুষরা নিজেদের আইসোলেট রাখতে পারলে খুব ভাল হয়। তাহলেও রোগটা কম ছড়াবে।রান্নায় নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পান ইন্দুবালা
আরও পড়ুন-
এর কোনও ওষুধ রয়েছে? কোনও ভ্যাকসিন?
অ্যাডিনো ভাইরাসের কোনও ভ্যাকসিন এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। না বড়দের জন্য, না ছোটদের জন্য। নেই নির্দিষ্ট ওষুধ। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হবে। যেমন, জ্বর হলে জ্বরের ওষুধ, শ্বাসকষ্ট হলে শ্বাসকষ্টের ওষুধ, হাঁচি-কাশি হলে হাঁচি-কাশির ওষুধ, অক্সিজেনের অভাব ঘটলে দেওয়া হচ্ছে অক্সিজেন। বারে বারে জল এবং ওআরএস খেতে হবে। মনে রাখতে হবে এই সময় শরীরে কোনওভাবেই যেন জলের অভাব না হয়।
আরও পড়ুন-ভারতের অস্কার জয়গাথা
ভ্যাকসিন বা টিকা দেওয়া কেন প্রয়োজনীয়। না দিলে কতটা ক্ষতি হতে পারে?
ভ্যাকসিন হল প্রতিষেধক। তৈরি করে অ্যান্টিবডি। তাই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে শরীরে তৈরি হয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কমে যায়। একশো শতাংশ না হলেও নব্বই শতাংশ প্রবণতা কমে তো বটেই। এমন কিছু অসুখ আছে যেগুলো ভ্যাকসিন দিয়ে প্রায় নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। যেমন স্মল পক্স।
আরও পড়ুন-ভরসার ভেলা, সুস্থ পথ চলা ভ্যাকসিন
শিশুদের কোন কোন ভ্যাকসিন অবশ্যই দেওয়া প্রয়োজন?
শিশুদের যে ভ্যাকসিনগুলো দেওয়া প্রয়োজনীয়, সেগুলো হল, জিরো ডোজ ওপিভি, হেপাটাইটিস বি, বিসিজি। জন্মের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে সাধারণত এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এরপর ৬ সপ্তাহ ১০ সপ্তাহ ১৪ সপ্তাহের ব্যবধানে চলে ভ্যাকসিনেশন। এই সমস্ত কিছুই আছে সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে। আরও কিছু নতুন ভ্যাকসিন যুক্ত হয়েছে। সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ওপিভি বা ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন। পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে ইঞ্জেক্টেবিল পোলিও ভ্যাকসিন। এটা প্রয়োগ করলে ভাইরাস আর ছড়াতে পারবে না। পোলিওর সম্ভাবনা কমে যাবে। আগে খাওয়ানো হত। এখন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ একটি ভ্যাকসিন পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন কয়েকটা রোগ থেকে শিশুদের রক্ষা করে। রোগগুলির মধ্যে রয়েছে ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, হেপাটাইটিস বি, টিটেনাস, নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস।
আরও পড়ুন-আজ ৩০ থেকে ৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া, ঝড়ে বিপর্যস্ত ট্রেন পরিষেবা
যদি ভ্যাকসিনের ডোজ মিস হয়ে যায়?
অসুবিধা নেই। আবার নতুন ভাবে ভ্যাকসিনেশন শুরু করতে হবে। অবশ্যই দেখাতে হবে পুরনো ভ্যাকসিনেশন চার্ট। সেটা দেখলেই বোঝা যাবে কোন কোন ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে এবং কতদিন অন্তর। সেইমতো নতুন ভাবে আবার চালু হবে।
সম্প্রতি স্কুলে স্কুলে রুবেলা ভ্যাকসিন দেওয়া হল। এর উপকারিতা কী?
ন’মাস থেকে পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের রুবেলা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে সর্বাধিক সংখ্যক ছেলেমেয়েদের এই ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যায়। এই এমআর ভ্যাকসিন আগে নেওয়া থাকলে ক্ষতি নেই। দ্বিতীয়বার দেওয়া হলে ইমিউনিটি বাড়বে। নতুন দেওয়া হলে ইমিউনিটি তৈরি হবে। গর্ভবতী মায়ের শরীরে রুবেলা ভাইরাস প্রবেশ করলে ভাইরাসটি ভ্রূণের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এর ফলে অনেক সময় ঘটে যেতে পারে বাচ্চার প্রাণহানি। বেঁচে গেলেও থেকে যায় নানা সমস্যা। চিকিৎসার মাধ্যমে তখন পুরোপুরি সুস্থ করা সম্ভব হয় না। এই সমস্যা কোনওভাবেই দেখা দেবে না যদি আগে রুবেলা ভ্যাকসিন দেওয়া যায়। তাই এই ভ্যাকসিন নিয়ে এতটা জোর দেওয়া হচ্ছে। ছেলেদের রুবেলা ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণ রুবেলা ভাইরাসের কারণে জ্বর-সর্দি ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করা। এই জ্বর-সর্দি হতে পারে মেয়েদেরও।
আরও পড়ুন-আজ ৩০ থেকে ৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া, ঝড়ে বিপর্যস্ত ট্রেন পরিষেবা
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার খবর আছে?
রুবেলা ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে জানতে পারিনি। তবে গাঁটে ব্যথা হতে পারে বলে শুনেছি। সব ভ্যাকসিনেরই ছোটখাটো কোনও না কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন সামান্য ফুলে যাওয়া, ব্যথা হওয়া, অ্যালার্জি ইত্যাদি।
শিশুদের কী কী নতুন ভ্যাকসিন এসেছে?
শিশুদের নতুন ভ্যাকসিন অনেকগুলোই এসেছে। রোটা ভাইরাস থেকে ডায়রিয়া হয়। এর প্রতিষেধক হিসেবে এসেছে রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন। জাপানিজ বি এনসেফালাইটিস ভ্যাকসিনটাও মোটামুটি নতুন। আরও একটি নতুন ভ্যাকসিন হল হিউম্যান পেপিলোমা ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন মেয়েদের সারভাইকাল ক্যান্সার রোধে সক্ষম। এটা এখনও সিডিউলের মধ্যে আসেনি। পাশাপাশি নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন তো আছেই। শিশুর জন্মের পর মুহূর্ত থেকেই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। পরোক্ষে শিশুর জন্মের আগে থেকেই কিন্তু ভ্যাকসিন চালু হয়ে যায়। গর্ভবতী মাকে টিটেনাস ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ দেওয়ার মাধ্যমে। যাতে নবজাতকের টিটেনাস জনিত কোনও সমস্যা না হয়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে জন্মের আগে থেকেই ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে।
আরও পড়ুন-তৃণমূলের দুর্গ থাকবে বাংলা, দিল্লি থেকে উৎখাত হবে বিজেপি, মনোবল তুঙ্গে সর্বাত্মক অভিযান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু বিশ্বকে পোলিও মুক্ত ঘোষণা করেছে। সত্যিই কি আমরা পোলিও মুক্ত হতে পেরেছি?
পোলিওর তিনটে স্টেইন আছে। টাইপ ওয়ান, টাইপ টু, টাইপ থ্রি। এই তিনটির কারণেই অতীতে প্যারালাইটিক পোলিও হচ্ছিল। এখন টাইপ টু এবং টাইপ থ্রি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু টাইপ ওয়ান আমাদের দেশে না থাকলেও, কিছু কিছু দেশে রয়েছে। মাঝেমাঝে দেখা যাচ্ছে। ঘটনা হল, একটা থেকে গেলেই, সেটা থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পারে। তখনই আমরা বিশ্বকে পোলিও মুক্ত বলব, যখন একটাও পোলিও ভাইরাসের খবর পাওয়া যাবে না। সেটা বলার মতো পরিস্থিতি কিন্তু এখনও আসেনি। আগামী দিনে হয়তো আসবে। সেই চেষ্টা চলছে। যে কোনও ভ্যাকসিন সব সময় উপকারী। শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্যও। সামান্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অনেক সময় ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে মৃদু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যার সঙ্গে কিন্তু ভ্যাকসিনের সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। আবার থাকতেও পারে। কোনও সমস্যা দেখা দিলে মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত, জানানো উচিত। এই রির্পোটিংটা খুব জরুরি।
আরও পড়ুন-আজ নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অখিলেশ যাদব
ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষ কতটা সচেতন?
মানুষ এখন যথেষ্ট সচেতন। এই সচেতনতা আরও বাড়ানোর জন্য আমাদের প্রচার করতে হবে। বলতে হবে, ভ্যাকসিন খুবই প্রয়োজনীয়। যদিও এখনও কিছু মানুষ ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে উদাসীন। করোনার সময় দেখা গেছে অনেকেই ভ্যাকসিন নিতে চায়নি। ক্ষতির ভয়ে। যদিও পরবর্তী সময়ে ভ্যাকসিন নিয়েছে। বুঝেছে, ভ্যাকসিন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের জন্য এবং সমাজের জন্য। আমরা চাই ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আসুক প্রতিটি মানুষ। এর ফলে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব হয়। এটাই আরও বেশি বেশি প্রচার করতে হবে।