‘মানসী’ পত্রিকার আয়োজনে ছোটগল্প প্রতিযোগিতা। বিচারক ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অনেক গল্প জমা পড়েছিল। একজন নবীন লেখকের গল্প পড়ে শরৎচন্দ্র রীতিমতো মুগ্ধ। গল্পটির নাম ‘বুভুক্ষা’। নবীন লেখকটির বয়স তখন সতেরো। তাঁকে সস্নেহে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। আশীর্বাদ করে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের কলম। বলেছিলেন, ‘তোমার জীবনে সুখ আসবে। দুঃখ আসবে। কিন্তু এই কলমটি তুমি ছেড়ো না। মনে রেখো, এই কলমের জন্যই তুমি জন্মেছ।’ যে নবীন লেখককে শরৎচন্দ্র আশীর্বাদ করেছিলেন, তিনি হলেন শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার কালীঘাটে মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। শৈশবের ৭ বছর কেটেছিল মামার বাড়িতেই। একটা সময় দাদামশাই তাঁকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। ১৯২৮ সালে তিনি পেয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন। সেই দেখা প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে শচীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘একদিন হল কী, গানের দল ঘুরতে ঘুরতে উত্তরায়ণে প্রবেশ করল। আমরা গাইতে-গাইতে দাঁড়ালাম একটা বাড়ির দোতলার সামনে, গানের দল হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন সেদিন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর স্বচ্ছ ললাটে গোল হয়ে পড়েছে সূর্যের আলো, আর আমার মনে হল, তাঁর ললাট-ধৃত সেই আলো থেকে রশ্মি ঠিকরে যেন এসে পড়ছে আমাদের বুকের মাঝখানে। আট বছরের শিশু, তলিয়ে কিছু বোঝবার বয়সই নয়, কিন্তু সেই আমাদের সদনে ফিরে আসতে আসতে কী আনন্দে যে মনটা ভরপুর হয়ে উঠল, তা আর কী বলব?’
আরও পড়ুন-বাহিনী-এজেন্সি দিয়ে ভোটে, জেতার স্বপ্ন চুরমার বিজেপির
শান্তিনিকেতনে ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল চরিত্রে মহড়া দিয়েছিলেন শচীন্দ্রনাথ। যদিও শেষমেশ মঞ্চস্থ হয়নি নাটকটি। শান্তিনিকেতনে খুব বেশিদিন থাকাও হয়নি তাঁর। তবে সেই স্মৃতি তিনি লালন করেছিলেন আজীবন। ১৯৩৪ সালে চলে যান পৈতৃক বাড়ি, অবিভক্ত বাংলার তথা অধুনা বাংলাদেশের নড়াইলে। ভর্তি হন সেখানকার ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে। জ্যাঠামশাই ছিলেন প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পণ্ডিত মানুষটির প্রভাব এসে পড়ে শচীন্দ্রনাথের জীবনে। একটা সময় ভীষণ দুষ্টু ছিলেন। মন ছিল না পড়াশোনায়। সেই তিনি আমূল বদলে যান। ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন আশুতোষ কলেজে। ততদিনে শুরু করেছেন লেখালিখি। আশুতোষ কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। পরে প্রাইভেটে বিএ পাশ করেন। পাশাপাশি সম্পন্ন করেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা কোর্স। এর কিছু সময় পর ১৯৪১ সালে ইন্ডিয়ান কপার কর্পোরেশনে ইনস্পেক্টরের চাকরি নিয়ে চলে যান ঘাটশিলা। সেখানে তিনি সংস্পর্শে আসেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একটি গল্প পাঠের আসরে শচীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখেন বিভূতিভূষণ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বোন জাহ্নবীদেবীর কন্যা উমা।
আরও পড়ুন-রবিবার মধ্যরাতে ল্যান্ডফল, সতর্ক প্রশাসন, ছয় জেলায় রেড অ্যালার্ট
প্রথম দেখাতেই শচীন্দ্রনাথকে মনে ধরে বিভূতিভূষণের। দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। লেখালিখির ব্যাপারে শচীন্দ্রনাথকে বিভূতিভূষণ দিতে থাকেন পরামর্শ। বিভূতিভূষণের আগ্রহেই ১৯৪৮ সালের ২৯ এপ্রিল ঘাটশিলায় উমা-র সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শচীন্দ্রনাথ। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই বিয়ে দিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। শচীন্দ্রনাথের হাতে সম্প্রদান করেছিলেন আদরের ভাগনিকে। সেই বিবাহবাসর সাহিত্য সম্মেলনের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। বিভূতিভূষণ এবং শচীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে এসেছিলেন বহু বিশিষ্ট সাহিত্যিক। জানা যায়, বিয়ের দিন বিকেলে কালবৈশাখী ঝড় এলোমেলো করে দিয়েছিল আয়োজন। বেশ কিছুক্ষণ দাপট দেখিয়ে থেমে গিয়েছিল। ঘাটশিলার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জনজীবনের কথা শচীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় ফুটে উঠেছে। স্ত্রীকে নিয়মিত নতুন লেখা শোনাতেন শচীন্দ্রনাথ। গুরুত্ব দিতেন তাঁর মতামতকে।
১৯৪৫ সালে ‘এম এল ব্যানার্জি অ্যান্ড সন্স’ নামে এক জাহাজ কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে ওয়ালটেয়ার চলে যান শচীন্দ্রনাথ। কলকাতা থেকে বহু দূরে থেকেও তিনি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন। পাশাপাশি চালিয়ে নিয়ে যান নাট্যচর্চা। বিভিন্ন সাহিত্যিকের সঙ্গে চলত তাঁর পত্র বিনিময়। বিভূতিভূষণের পত্র তাঁকে বিশেষভাবে প্রাণিত করত।
আরও পড়ুন-হিমন্ত বিশ্বাসঘাতক, বললেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার
১৯৫৩ সালে কলকাতায় ফিরে শচীন্দ্রনাথ যোগ দেন রাজ্য সরকারের চাকরিতে। ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও জনসংযোগ দফতরে। ১৯৮০ সালে ডেপুটি ডিরেক্টর পদে উন্নীত হয়ে অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় জড়িয়ে ছিলেন লোকরঞ্জন শাখার সঙ্গে। পরিচালনা করেছেন বেশ কয়েকটি নাটক। একটা সময় পেয়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজের প্রস্তাব। কিন্তু সেই চাকরি তিনি নেননি। লেখক হিসেবে আজীবন যুক্ত থেকেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
বারবার পেশা বদল অনেকের জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তবে শচীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। পেশা বদল তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে জীবনে অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সেইসব অভিজ্ঞতা তিনি উজাড় করে দিয়েছেন বিভিন্ন রচনায়।
সতেরো বছর বয়সে শরৎচন্দ্রের আশীর্বাদ লাভ তাঁকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছিল। তবে তাঁর লেখালিখি শুরু হয়েছিল পনেরো বছর বয়সে। শুরুতে লিখতেন কবিতা। নড়াইলের চিত্রা নদী তাঁর কবিতাকে বিশেষভাবে করেছিল প্রভাবিত। পরে লিখেছেন প্রবন্ধ। হাতে লেখা পত্রিকা ‘সাথী’-তে। ‘পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে সৈন্য সমাবেশের বিন্যাস’ বিষয়ে। তারপর লিখতে শুরু করেন নাটক, গান গল্প, উপন্যাস।
‘উত্তরাধিকার’ তাঁর প্রথম নাটক। লেখেন ১৯৪১ সালে। সেই বছরই মঞ্চস্থ হয়। বালিগঞ্জ শিল্পী সঙ্ঘের উদ্যোগে। নাটক দেখে খুশি হয়েছিলেন সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রিনরুমে এসে আলাপ করে যান নাট্যকার শচীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ওই নাটকে শচীন্দ্রনাথ একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। মানিক, বিভূতিভূষণের পাশাপাশি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিলেন শচীন্দ্রনাথ। তারাশঙ্করের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় বিভূতিভূষণের স্মরণ অনুষ্ঠানে। শচীন্দ্রনাথের মধুর ব্যবহারে তারাশঙ্কর মুগ্ধ হয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক রচিত হয়েছিল শচীন্দ্রনাথের।
প্রমথেশ বড়ুয়া জেনেছিলেন তাঁর কথা। তিনি শচীন্দ্রনাথকে ডেকে নেন ‘ডাক্তার’ ছবিতে। সহকারী পরিচালক হিসেবে। সেই ছবিতে পঙ্কজকুমার মল্লিক, তুলসী লাহিড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন শচীন্দ্রনাথ। ‘বহুরূপী’র মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন শচীন্দ্রনাথের মাতুল। ফলে অভিনয় ছিল তাঁর রক্তে।
আরও পড়ুন-হিমন্ত বিশ্বাসঘাতক, বললেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার
কলেজে পড়াকালীনই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে ‘কথিকা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘জানি জানি আজ আমারে পড়ে না মনে’ গানটি। সেই গান মুগ্ধ করেছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল শচীন্দ্রনাথের। নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর শচীন্দ্রনাথকে বুকে টেনে নেন নজরুল।
১৯৪৪-’৪৫ নাগাদ শচীন্দ্রনাথ লেখেন প্রথম উপন্যাস ‘এ জন্মের ইতিহাস’। সরোজকুমার রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘বর্তমান’ পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে সেটা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘এ জন্মের ইতিহাস’ পড়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন বিভূতিভূষণ। ঘাটশিলায় থাকাকালীন বেতার-নাট্য প্রতিযোগিতায় ‘তীরভূমি’ নামক নাটক লিখে শচীন্দ্রনাথ পুরস্কৃত হন।
‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘পদধ্বনি’, ‘ইঁদুর’ প্রভৃতি গল্প। গল্পগুলো পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ১৪ মার্চ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জেগুয়ার’ গল্পটি শচীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। গল্পটি আন্দামানের পটভূমিতে লেখা। শচীন্দ্রনাথ নামের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন উমানন্দ ভৈরব, উমা দেবী, শিবানী দেবী, শান্তি ভট্টাচার্য প্রভৃতি ছদ্মনামে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ ‘অপরিচিতের নাম’, ‘অভিমানী আন্দামান’, ‘আনন্দ ভৈরবী’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘এই তীর্থ’, ‘এক আশ্চর্য মেয়ে’, ‘একটি রঙ করা মুখ’, ‘কত আলোর সঙ্গ’, ‘কর্নাটরাগ’, ‘কৃষ্ণপক্ষের আলো’, ‘ছায়াসঙ্গিনী’, ‘জনপদবধূ’, ‘জলকন্যার মন’, ‘ঢেউ ওঠে পড়ে’, ‘তারুণ্যের কাল’, ‘তোমার পতাকা’, ‘দুই নদী’, ‘সীমান্ত শিবির’, ‘দেবকন্যা’, ‘দ্বিতীয় অন্তর’, ‘নগরনন্দিনীর রূপকথা’, ‘নগ্নদ্বীপ’, ‘নিধুবাবুর টপ্পা’, ‘নীলসিন্ধু’, ‘বন্দরে বন্দরে’, ‘বিদিশার নিশা’ ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-অসংলগ্ন কথার বন্যা প্রধানমন্ত্রীর মুখে, ‘মুজরা’ মন্তব্যের তীব্র নিন্দা তৃণমূলের
‘বন্দরে বন্দরে’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৮ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পান। এই উপন্যাসের প্রশংসা করেছিলেন সুকুমার সেন। পাশাপাশি পেয়েছেন আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৯৯ সালের ২৬ মে কলকাতায় প্রয়াত হন সাহিত্যিক শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক বছর আগে পেরিয়েছে তাঁর জন্মশতবর্ষ। কিছু পত্রিকা তাঁকে নিয়ে প্রকাশ করেছে বিশেষ রচনা ও বিশেষ সংখ্যা। তাঁর জীবনী-গ্রন্থ প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। তবু মনে হয় শচীন্দ্রনাথের মতো সাহিত্যিককে নিয়ে যতটা চর্চা হওয়ার দরকার ছিল, ততটা হয়নি। তাঁকে আরও বেশি জানা প্রয়োজন, পড়া প্রয়োজন।
ঋণ : শুভেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়