প্রতিবেদন : সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মতামত নিয়ে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করিয়ে নতুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের দিনক্ষণ স্থির করবে রাজ্য। তবে ২০ জুন কখনওই পশ্চিমবঙ্গ দিবস নয়। এক সুরে সেকথা জানিয়ে দিলেন সমাজের সর্বক্ষেত্রের বিশিষ্টরা। বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের কর্মসূচিকে ঘিরে ঘৃণা ভরা ধিক্কার শোনা গেল মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা সর্বদল বৈঠকে।
আরও পড়ুন-বিমানবন্দরে নেমেই অমিতাভ-জয়ার বাংলাে জলসায়, ইন্ডিয়া জোট আজ মুম্বই যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
বিজেপির ২০ জুনের বদলে অন্য কোনওদিন পৃথক পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের উদ্যোগ নিয়ে মঙ্গলবার নবান্ন সভাঘরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌরোহিত্যে সর্বদল বৈঠক বসে। সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট জনদের এদিনের বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট সাংবাদিক, বণিকসভার কর্তা— সকলের মতামত নেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপি, সিপিআইএম, কংগ্রেস এই বৈঠকে যোগ দেয়নি। তবে এসইউসিআই, সিপিআইএম (লিবারেশন) বৈঠকে উপস্থিত ছিল। তাৎপর্যপূর্ণ, অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিরাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, বিজেপির রাজ্য ভাগের চক্রান্তকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে এর বিরোধিতারও ডাক দিয়েছে হিন্দু মহাসভা। সিপিআইএম ও কংগ্রেস বৈঠকে যোগ না দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁর কথায়, সর্বভারতীয় স্তরে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সদস্য হওয়ার পরেও তাদের এই অনুপস্থিতি দুঃখজনক।
আরও পড়ুন-INDIA-র চন্দ্রবিজয়
বৈঠকের শুরুতেই প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যান্য রাজ্যের প্রতিষ্ঠাদিবস পালনের প্রেক্ষিত তুলে ধরে আলোচনার সুর বেঁধে দেন। বিহার-ওড়িশা-তেলেঙ্গানা-সহ বিভিন্ন রাজ্যের জন্মের প্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের এইভাবে কোনও প্রতিষ্ঠাদিবসের উল্লেখ ছিল না বলে জানান তিনি। ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা কেন উচিত নয় তা নিয়েও স্পষ্ট মতামত জানিয়েছেন বিশিষ্টরা। প্রথমেই কবি জয় গোস্বামী ২০ জুনের বিরোধিতা করে বলেন, এই দিনটি কোনওভাবেই আমাদের রাজ্যের প্রতিষ্ঠাদিবস হতে পারে না। পয়লা বৈশাখ হোক প্রতিষ্ঠাদিবস। সব দিক থেকেই তা হবে মানানসই।
আরও পড়ুন-আজ সম্প্রীতির রাখিবন্ধন উৎসব রাজ্যজুড়ে
ইতিহাসবিদ সুগত বসু পয়লা বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। কেন এই দিনটি পশ্চিমবঙ্গ দিবস হওয়া উচিত তার পক্ষে সুর বেঁধে দিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মনীষীরা ঐক্যবদ্ধ বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গেল ১৯৪৭-এর ৩ জুন। ওই দিন দেশভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন মাউন্টব্যাটেন। ১৯৪৭ সালের ২৮ মে পর্যন্ত সম্ভাবনা ছিল যে বাংলা হয়তো অখণ্ড থাকবে। ৩ জুনের পর ইংরেজদের সিদ্ধান্ত রোধ করা সম্ভব হল না। ১৯৪৭-এর ১৫ জুন কংগ্রেসও এটা স্বীকার করে নিল। ২০ জুন আইনসভায় বাংলা ভাগের বিরুদ্ধেই ভোট পড়েছিল। বাংলা দিবস হিসেবে অন্য শুভ দিনই বেছে নেওয়া উচিত। পয়লা বৈশাখ হলে ভালই হয়। এরপর কবি সুবোধ সরকারও সুগত বসুর সুরেই বলেন, ২০ জুন তারিখটাকে মানতে পারব না। ২০ জুনের পরিবর্তে একটা দিন ঠিক করতেই হবে। পশ্চিমবঙ্গের সত্তা হিসেবে যে তারিখটা সবচেয়ে বেশি রিফ্লেক্ট করে সেটা হল পয়লা বৈশাখ। আলোচনা গড়াতে দেখা যায় পয়লা বৈশাখই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবচেয়ে ভাল দিন হিসেবে উঠে আসছে। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী অন্য একটি তারিখ বলেন। তবে যেভাবে সুগত বসু, সুবোধ সরকার কেন ২০ জুন হওয়া উচিত নয় তার ব্যাখ্যা করেন, তাতে সকলে সমর্থন করেন। শুভাপ্রসন্ন বলেন, বাংলা দিবস না করে বিশ্ববাংলা দিবস হোক। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী এই রাজ্যকে বিশ্ববাংলায় পরিণত করেছেন।
আরও পড়ুন-আঁচিল থেকে মুক্তি
হিন্দু-মুসলিম ধর্ম নিরপেক্ষ বাঙালির উদযাপন দিন হিসেবে পয়লা বৈশাখকেই তুলে ধরা হয়। সকলের মতামত হল বিভাজনের ২০ জুন বাংলার প্রতিষ্ঠাদিবস নয় একেবারেই। প্রত্যেকের বক্তব্য, চোখের জলের ওপর দিয়ে কোনও রাজ্যের প্রতিষ্ঠাদিবস হতে পারেনা। আগেই আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় তার বক্তব্যে বলেছিলেন, পাঞ্জাব সহ একাধিক রাজ্যের রক্তস্নাত ইতিহাস রয়েছে। যেমন ২৩ জুন পাঞ্জাবে যা হয়েছিল বিজেপি কোনওদিন সাহস পায় না সেখানে এই ধরনের কথা বলতে। তবে এখানে কেন ২০ জুন-এর কথা উঠছে! সাহিত্যিক আবুল বাশার, প্রচেত গুপ্ত, চিত্র-পরিচালক গৌতম ঘোষ-সহ ধর্মগুরুরাও ২০ জুন দিনটির বিরোধিতা করেন। হিন্দু মহাসভা ও বেশ কয়েকটি মুসলিম সংগঠনও এদিন উপস্থিত ছিল। হিন্দু মহাসভা বলে, ২০ জুন রক্তের ইতিহাসের ওপর দিয়ে প্রতিষ্ঠাদিবস নয়। এর পরে খেলার মাঠের তরফে মোহনবাগানের কর্মকর্তা, ইস্টবেঙ্গের ড. শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত-সহ আইএফএর তরফে অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের তরফে বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়রা ২০ জুনের বিরোধিতা করেন। এছাড়া বণিকসভা ব্যঙ্কের প্রতিনিধিরা, মার্চেন্ট চেম্বার অব কমার্সের প্রতনিধিরা একে একে তাঁদের বক্তব্য রাখেন। এদিন উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি। এছাড়াও রাজ্যের মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, ব্রাত্য বসু, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, শশী পাঁজা, ইন্দ্রনীল সেন, বীরবাহা হাঁসদা। এছাড়াও এদিন এসেছিলেন রাজ্যের বিভিন্ন কমিশনের পদাধিকারীরা। কলকাতা প্রেস ক্লাবের তরফে বক্তব্য রাখেন সভাপতি স্নেহাশিস সুর, ছিলেন সম্পাদক কিংশুক প্রামাণিক। এছাড়াও সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন বিশ্ব মজুমদার, মৌপিয়া নন্দী, জয়ন্ত ঘোষাল, পূষণ গুপ্ত, দেবদীপ পুরোহিত, হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়, উদিতপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস ভট্টাচার্য, তমাল সাহা-সহ অন্যরাও।
আরও পড়ুন-অত্যাধুনিক সার্জারি পিজিতে আসছে রোবট
এদিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, রাজ্যের প্রতিষ্ঠাদিবস কোনওভাবেই ২০ জুন হবে না। ওরা তাড়াহুড়ো করে এই দিনটা চাপিয়ে দিতে চাইছে। ফলে আমাদেরও একটা বিকল্প দিন তাড়াহুড়ো করেই ঠিক করতে হবে। তাঁর সংযোজন, ঐতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষ বা সাবেক আর্যাবর্তের নির্দিষ্ট কোনও দিন খুঁজে পাওয়া যায় না। এর পরেই কুণাল বলেন, আমাদের বামা-মায়েদের ক্ষেত্রেও এভাবে নির্দিষ্ট কোনও জন্মদিন খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। কোনও একটি শুভ দিনকে বেছে নিয়ে তা পালন করা হত। তখন মুখ্যমন্ত্রীও বলে ওঠেন, এই যে বসে আছে আমার দাদা অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। ওর থেকে নাকি আমার বয়সের তফাত ছয় মাসের। এটা কীভাবে হয়! কারণ সে সময় তো এসবের চল ছিল না। তখন সকলেই হেসে ওঠেন। কুণাল বলেন, যাই ঘটুক না কেন, কোনওভাবেই ২০ জুনের বিভাজনের দিনটি, বঙ্গভঙ্গের দিনটি, রক্তস্নাত দিনটি বাংলার প্রতিষ্ঠাদিবস হতে পারে না। তাঁর প্রস্তাব, ২০ জুন দিনটি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দিবস, বিভাজন দিবস হিসাবে পালিত হোক। তাহলে আজকের প্রজন্মের কাছে এর আসল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পরিষ্কার হবে।
আরও পড়ুন-যুদ্ধে প্রাণ রক্ষা থেকে দাদা/ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় রাখি
এদিন হিন্দিভাষী, উর্দুভাষী কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরাও তাঁদের বক্তব্য রাখেন। এর পরই আলোচনা প্রসঙ্গে উঠে আসে রাজ্যের নিজস্ব একটি সঙ্গীত হোক। মুখ্যমন্ত্রী বলেন তবে, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ এই গানটি হোক। এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী আরও কিছু মতামত দেন এবং তিনি বিশিষ্টদের কিছু মতামত গ্রহণ করেন। এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আজকের বৈঠকে কিছুই চূড়ান্ত হল না। আপনাদের আরও যা মতামত আছে তা লিখিত আকারে আগামী ৫ সেপ্টেম্বরে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দিন। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় এটি প্রস্তাব আকারে আনা হবে। এর পর আলোচনার ভিত্তিতে বাকিটা চূড়ান্ত করা হবে।