হঠাৎ করেই মনে হল মুখটা যেন একদিকে একটু বেঁকে গেছে। সুস্থ শরীর কিন্তু সুস্থ নয় মনে হচ্ছে, যেন খাবার এবং জলও গিলতে অসুবিধে হচ্ছে। খাবারটা মুখের একদিকে আটকে আছে, চিবোতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কোনও ক্ষেত্রে দেখা গেল যাঁর এমনটা হয়েছে তাঁর একদিকের চোখের পাতা বন্ধ হচ্ছে না সহজে। এগুলো দেখে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। এটা একধরনের স্নায়বিক সমস্যা। এই সমস্যাকেই বলে বেলস পলসি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রচলিত পরিভাষায় ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালিসিস।
আরও পড়ুন-ফের জল ছাড়ল ডিভিসি, প্লাবন
বেলস পালসি কী
আমাদের সাত নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভ বা ফেসিয়াল নার্ভে সমস্যার কারণে এই শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়। কোনও কারণে ব্যথা-যন্ত্রণাতে স্নায়ুটি ফুলে যায় ও চাপ লেগে মুখের পেশি, জিভের স্বাদ বা চোখের পাতা নড়াচড়ায় সমস্যা দেখা দেয়।
এটি এমন একটি অবস্থা যার ফলে মুখের পেশিগুলি দুর্বল হয়ে যায় বা একদিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। মুখের পেশির সঙ্গে যুক্ত স্নায়ুগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে স্নায়ুর পথকে সংকুচিত করে যার ফলে নিউরনের সংকেত বাহিত হতে বাধা পায়। ফলস্বরূপ মুখের পেশিগুলি দুর্বল হয়ে যায়, ঝুলে যায়, যাকে বেলস পালসি বলে। এই জটিলতা সাময়িক কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ-জটিলতা আসে, সারতে সময় নেয়। তবে সময় যা-ই লাগুক না কেন চিকিৎসা এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে এটি সাধারণত পুরোপুরি নির্মূল হওয়া সম্ভব।
বেলস পালসি দু’ধরনের
মুখের একপাশ কপাল থেকে শুরু করে থুতনি পর্যন্ত প্যারালাইজড হলে লোয়ার মোটর নিউরন টাইপ অব ফেসিয়াল পালসি হয়।
কপালের অংশ বাদে চোখ থেকে নিচের অংশ প্যারালাইজড হলে সেটাকে বলে আপার মোটর নিউরন টাইপ অব ফেসিয়াল পালসি।
উপসর্গ
বেলস পালসি হলে সাধারণত মুখের একদিকের বা একপাশের পেশি আক্রান্ত হয়। তবে অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে মুখের দু’পাশের পেশিই আক্রান্ত হয়।
পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে কিন্তু চোখ বন্ধ করা যাবে না এবং মুখের এক পাশ থেকে লালা ঝরতে থাকে।
এই রোগটির ফলে মুখের স্নায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যেসব কাজকর্ম সেগুলোর ওপর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। মুখের যেদিকের অংশ আক্রান্ত হয়েছে তা খুলতে, হাসতে এবং চিবিয়ে খাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কারও কারও ক্ষেত্রে মুখের ওই পাশে ব্যথাও হতে পারে, বিশেষ করে চোয়াল এবং মাথায় ব্যথা অনুভব হয়।
জিভের সামনের অংশটিও প্রভাবিত হয়। ফলে জিভের স্বাদগ্রহণেও সমস্যা দেখা দেয়।
মুখের ভেতরটা শুকনো থাকবে।
আরও পড়ুন-এটা রাজনীতির ময়দান নয়, কোর্ট রুম থেকে বের করে দেব, আইনজীবীকে ভর্ৎসনা চন্দ্রচূড়ের
কারণ কী
আমাদের সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন বেলস পালসির সম্ভাবনা দেখা দেয়। যদিও একেবারে নির্দিষ্ট করে এই রোগে আক্রান্ত হবার কারণ এখনও বলা যায়নি।
বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল বা বিষাক্ত সংক্রমণের কারণে রোগটি হয়। যেমন এইচআইভি, হার্পিস সিমপ্লেক্স, হার্পিস জোস্টার, সাইটো মেগালোভাইরাস এবং এপস্টাইন বার ভাইরাস ইত্যাদির সংক্রমণ। হার্পিস জোস্টার, এইচআইভি বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের মতো ভাইরাল সংক্রমণের কারণে নার্ভ ফুলে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক সময়।
ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ এবং উপরের শ্বাসযন্ত্রের বা আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টের সংক্রমণ হলে এই রোগের সম্ভাবনা থাকে।
প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি রয়েছে।
অতিরিক্ত জ্বর, ঠান্ডা-লাগা, সর্দি-কাশি, কান-পাকা ইত্যাদির কারণেও বেলস পালসি দেখা দিতে পারে।
এ-ছাড়া মাথায় আঘাত, টিউমার, স্ট্রোক থেকে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তখন এমনটা হয়।
মধ্যকর্ণে সংক্রমণের কারণে হতে পারে ফেসিয়াল পালসি।
আঘাতজনিত কারণে হতে পারে এই ফেসিয়াল প্যারালিসিস।
মস্তিষ্কের স্ট্রোকজনিত কারণেও হতে পারে।
ফেসিয়াল টিউমারের কারণে আসতে পারে জটিলতা।
কানের অপারেশন পরবর্তী ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি ইত্যাদি কারণে এই রোগ হতে পারে।
চোখ জ্বালা-পোড়া করতে পারে। অনেক সময় ড্রাই আইজের সমস্যা দেখা দেয়।
কাদের হয়
এটা যেকোনও বয়সের নারী-পুরুষের হতে পারে। তবে পুরুষের তুলনায় নারীদের এই রোগ বেশি দেখা যায়। গর্ভাবস্থায়, ফুসফুসের সংক্রমণে হতে পারে, ডায়াবেটিস থাকলে হতে পারে। পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও ফেসিয়াল প্যারালিসিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন-বাজারদর নিয়ন্ত্রণে জোরদার অভিযানে নামছে টাস্ক ফোর্স
চিকিৎসা
বেলস পালসির চিকিৎসা নির্ভর করে যিনি আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর সেই রোগের কারণটা ঠিক কী এবং কতটা ঝুঁকি রয়েছে তার ওপর।
চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ কার্যকরী। চিকিৎসকেরা তাই করেন।
এ-ছাড়াও অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন জাতীয় কিছু ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয় প্রয়োজন পড়লে।
যদি উপসর্গ দেখে ডাক্তার সন্দেহ করেন, যে কোনও ভাইরাস সংক্রমণই এই রোগের কারণ, তাহলে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয়৷
ওষুধের পাশাপাশি, ফিজিওথেরাপির একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এই রোগের চিকিৎসায়। রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেন।
তবে কিছু জটিলতা থাকে যেমন ট্রমার কারণে স্নায়ু সঙ্কুচিত হলে তখন অপারেশন ছাড়া গতি থাকে না।
কারও কারও ক্ষেত্রে কয়েক মাসের মধ্যেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আবার কারও ক্ষেত্রে তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়।
এখন দীর্ঘ গবেষণায় নতুন নতুন পদ্ধতি আসছে এই রোগ নির্মূল করতে। যেমন ইলেকট্রিকাল নার্ভ স্টিমুলেশন পদ্ধতি এক্ষেত্রে নিরাপদ এবং বেশ কার্যকরী।
আরও পড়ুন-”এই বৈঠক ইতিবাচক হয়েছে”: মুখ্যমন্ত্রী
কী করবেন
এই অবস্থা না সারা পর্যন্ত নরম খাবার খেতে হবে।
আপেল, পেঁপে, আঙুর, তরমুজ, স্ট্রবেরি, কলা খান— এ-সবে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুকে সুস্থ করবে।
ফ্রোজেন অথবা ক্যানজাত খাবার বাদ দিতে হবে।
ফিজিওথেরাপি
৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় বেলস পালসিতে। ১০ শতাংশের কিছু দুর্বলতা থেকে যায়। যেমন, মুখ কিছুটা বাঁকা থেকে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির বড় ভূমিকা রয়েছে। দু-ধরনের থেরাপি হয়।
মেকানিক্যাল থেরাপি
আইআরআর, প্যারাফিন ওয়াক্স থেরাপি, আলট্রা সাউন্ড থেরাপি, ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন।
ম্যানুয়াল থেরাপি
ইনফ্রা-রেড রেডিয়েশন থেরাপি, ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন থেরাপি, অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ ফেসিয়াল মাসল এক্সারসাইজ, স্পিচ রি-এডুকেশন থেরাপি, ব্যালুনিং এক্সারসাইজ, রিঙ্কলিং এক্সারসাইজ ইত্যাদি।
আয়ুর্বেদে
আয়ুর্বেদেও এই ফেসিয়াল প্যারালিসিসের চিকিৎসা রয়েছে। আয়ুর্বেদের ক্ষেত্রে প্রথমেই অস্বস্তি সৃষ্টিকারী বায়ু উপাদানটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং মুখের পেশিকে শক্তিশালী করা। এটা করতে মূলত জীবনধারা পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা। সেই পরিবর্তনে থাকে খাদ্য, ব্যায়াম এবং ডিটক্সিফিকেশন অর্থাৎ পঞ্চকর্ম পদ্ধতি এবং তেল মালিশ সঙ্গে কিছু ওষুধও দেন।
প্রচণ্ড ঠান্ডায় নিজেকে ঠিক রাখা। ঠান্ডা লাগতে না দেওয়া। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাল ঘুম বেলস পালসি হওয়ার ঘটনা কমাতে সাহায্য করে।