ধর্মনিরপেক্ষতা এখন কোথায়! সংখ্যাগুরুর দাপটে কাঁপছে শিক্ষা

সেনায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী চিন্তা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা, বইতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার কথা মুছে ফেলা, এ-সব আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক আলোহীন আগামীর দিকে। সন্ত্রস্ত কলমে লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

কথাটা বলেছিলেন অ্যান্ডার্স রাইডেল। বলেছিলেন, বই স্রেফ সম্পত্তি নয়, বই হল স্মৃতির রক্ষাকর্তা, ‘কিপার্স অব মেমোরিজ’। তাই, তাই-ই, হিটলারের জমানায়, নাৎসি তাণ্ডবে উপদ্রুত বিশ্বে, আমস্টারডাম থেকে রোম, ওয়ারশ থেকে প্যারিস, সর্বত্র রাইখের সেনারা ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে সরকারি গ্রন্থাগার, সব কিছু ধ্বংস করার, পুড়িয়ে ফেলার, তছনছ করার ব্যবস্থা করেছিল। আর আজকের ভারতে সেই কাজটাই করছে মোদি সরকার।

আরও পড়ুন-বিরোধীদের মতোই ভোটের আগে জেগে ওঠে কেন্দ্রীয় এজেন্সি : শতাব্দী

শিক্ষার ওপর, স্কুলের ওপর বইয়ের ওপর দাপট দেখাচ্ছে ওরা। দেশের সৈনিক স্কুলগুলিকে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বাংলায় একমাত্র সৈনিক স্কুলটি আছে পুরুলিয়ায়। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাদেমি বা এনডিএ এবং ন্যাভাল অ্যাকাদেমি বা এনএ-তে ভর্তির জন্য সৈনিক স্কুলে প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গেই সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ দেন পদাতিক ও নৌ সেনার অফিসারেরা। এই স্কুলে ভর্তির জন্য কঠোর পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়। দেশে মোট ৩৩টি সৈনিক স্কুল আছে। ক্লাস এইট পাশ ছেলেমেয়েরা এতে ভর্তি হতে পারে। প্রতিরক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, নরেন্দ্র মোদি সরকার সৈনিক স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১০০টি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এরমধ্যে প্রথমে ২১টি স্কুল খোলা হবে। সেগুলি বেসরকারি সংস্থা, এনজিও-ইত্যাদির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হবে। সৈনিক স্কুল বেসরকারি সংস্থার হাতে যাওয়ার অর্থ সরকার টাকায় পরিচালিত সংস্থার বেসরকারীকরণ। সেই সঙ্গে আরএসএস ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের হাতে এই স্কুল তুলে দেওয়ার অর্থ সেনায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভাবধারা ছড়িয়ে দেওয়া। এইভাবে সেনাবাহিনী আরএসএসের ক্যাডারে ভরে যাবে।
এরই সমান্তরালে চলছে ইতিহাস মুছে মন গড়া তথ্য পড়ুয়া মনে ঢোকানোর চেষ্টা।

আরও পড়ুন-প্রকাশের প্রচারে দেব, আছড়ে পড়ল জনস্রোত

এনসিইআরটি কর্তৃক প্রকাশিত নতুন কিছু বই, এই মাস থেকেই, ক্লাসে ক্লাসে পড়ানো হবে। ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এ-নিয়ে চারবার পাঠ্যপুস্তকে বদল আনল এই কেন্দ্রীয় সংস্থা। সেখানে এমন সুচারু ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে আগামী প্রজন্ম বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথা, আজকের রামমন্দির যে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে করা হয়েছে, সে কথা ঘুণাক্ষরেও না জানতে পারে।
ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-এর দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে একাধিক জায়গা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ২০০২-এর গুজরাত হিংসার প্রসঙ্গ। ‘হিন্দুত্বের রাজনীতি’ প্রসঙ্গও ওই পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইয়ের অষ্টম পরিচ্ছদে ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক উত্থানপতন সংক্রান্ত আলোচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে ‘অযোধ্যা ধ্বংস’ প্রসঙ্গ। আগে পরিচ্ছদটির শিরোনাম অংশে লেখা থাকত, “রাজনৈতিক ধারায় রাম জন্মভূমি আন্দোলন এবং অযোধ্যা ধ্বংসের প্রেক্ষাপট কী?” এখন সেখানে লেখা হল “রাম জন্মভূমি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কী?” ওই পরিচ্ছদেই বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ এবং হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে খুলল আরও একটি চা-বাগান

বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে, যেখানে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে কতগুলি সংবাদ প্রতিবেদনের কোলাজের শিরোনাম অংশ থেকে সরানো হয়েছে ২০০২ সালের গুজরাত হিংসার কথা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইতে গুরুত্ব পেয়েছে রাম জন্মভূমি আন্দোলন। আগের বইতে চার পৃষ্ঠার একটা অধ্যায়ে অযোধ্য বিতর্ক আলোচিত হয়েছিল। সেখানে ছিল ১৯৮৬-তে রাম জন্মভূমির তালা খোলার বিষয়, হিন্দু-মুসলমান উভয় পক্ষের দাবিদাওয়া নিয়ে জন-আন্দোলন তৈরির কথা, বাবরি মসজিদ ভাঙার কথা আর তার প্রতিক্রিয়ার অভিঘাতও। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর বিজেপি শাসিত রাজ্যসমূহে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছিল, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক সঞ্চারিত হয়েছিল, এসবও আগের বইতে ছিল। সেই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে সামনে রেখে বিতর্কের কেন্দ্র হয়েছিল ভারতের জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃতির মতো বিষয়ও। সেই সূত্রেই বিজেপি আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান, সে-কথাও লেখা ছিল ওই বইতে।

আরও পড়ুন-রাজ্যে সবজি ও ফল চাষের উৎকর্ষ কেন্দ্র

নতুন বইতে সেসব বাদ। এখানে নতুন করে পুরো বিষয়টার বিন্যাস ঘটানো হয়েছে। অনেক বিষয় চেপে গিয়ে পুরো ঘটনাক্রম আলোচিত হয়েছে। কোথাও যাতে হিন্দুত্ববাদের ভাবমূর্তিতে আঘাত না লাগে, সে-বিষয়ে যাতে আগামী প্রজন্ম যাতে অন্ধকারে থাকে, সেদিকে সতর্ক লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
রাম জন্মভূমি মন্দির নিয়ে শতাব্দী প্রাচীন আইনি ও রাজনৈতিক বিবাদ ভারতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে অনেক পরিবর্তনের জন্ম দেয়। এই পরিবর্তনের তুঙ্গ পরিণতিতে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের ৯ নভেম্বর, ২০১৯-এ প্রদত্ত রায়ের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে অযোধ্যার রাম মন্দির। ব্যাস! এতটুকুই বর্ণিত নতুন বইতে। অধ্যায়ের শুরুতে প্রদত্ত অধ্যায়ে আলোচিত বিষয়বস্তুর সারাৎসারের প্রথম বাক্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বর্ণনাকারী বাক্যটি বাদ পড়েছে। একইভাবে অনুশীলনীর শেষে একটি বাক্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিষয় সংক্রান্ত বাক্যাংশ বাদ পড়েছে। কালপঞ্জি অনুসারে ছটি রাজনৈতিক ঘটনাক্রম অনুযায়ী লিখতে বলা হয়েছে। আগে এই ঘটনাবলির মধ্যে ছিল ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস’। এখন তার জায়গায় এসেছে ‘রাম জন্মভূমির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়’।
রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সুবাদেই যে কংগ্রেসের পতনের এবং বিজেপি-র উত্থানের সূত্রপাত, তা এই নয়া বইতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত।

আরও পড়ুন-চক্রান্তের অভিযোগ উষার

এনসিইআরটির নির্দেশিকা মেনে গত কয়েক মাসে পরিবর্তন ঘটেছে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে। কোনও শ্রেণিতে মোগল যুগ বাদ পড়েছে। কোথাও ডারউইনের বিবর্তনবাদ। কোথাও নারী আন্দোলনের ইতিহাস। কোথাও বা ভারতের সামাজিক বৈষম্য। শিক্ষামহল এবং শিক্ষায় আগ্রহী মহল, সর্বত্রই এ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
এর আগে উত্তরপ্রদেশের দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যবই থেকে মোগল সাম্রাজ্যের অধ্যায় বাদ দিয়েছে যোগী আদিত্যনাথ সরকার। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-এর পরামর্শ মেনেই নাকি এই সিদ্ধান্ত।
আসলে প্রতিদিন গেরুয়া আধিপত্য বাড়ানো হচ্ছে বইতে এবং স্কুলে, সাধারণ নাগরিকের অসামরিক জীবনে এবং সেনা বাহিনীর মস্তিষ্কে।

Latest article