অগ্নিযুগের বাঙালিনিরা

অগ্নিযুগের বাঙালিনিরা মহামানবী ওঁরা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে সাত দশক পর অন্তত আমরা ওঁদের চিনি। ওঁরা আমাদের জন্য রক্ত দিয়েছেন, বদলে দু’হাতে শিকল নিয়েছেন, আমরা ওঁদের কাছে ঋণী। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, কিন্তু ব্যাপকভাবে আলোচিত নন এবং কিছুটা অনালোকিত, এরকম কয়েকজন নারী-বিপ্লবীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণে দেবাশিস পাঠক

Must read

ওঁরাও বিপ্লবী, ওঁরাও বীর। ওঁরাও আকাশে জাগাতেন ঝড়। ওঁদের কাহিনিও তপ্ত লোহিত বিদেশির খুনে, গুলি-বন্দুক-বোমার আগুনে, আজও রোমাঞ্চকর।
তবু, তবুও যেন মনে হয়, ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস অতিক্রম করেও আমরা, ভারতবাসীর বৃহত্তর অংশ, আমাদের স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর অনুভবে মনে করি না তাঁদের আত্মত্যাগের কথা।
লালকেল্লার ভাষণে এমন কত না ব্যক্তির কথা স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে উল্লিখিত হল যাঁদের সঙ্গে সেই আত্মবলিদানের প্রহরের কোনও প্রত্যক্ষ সংস্রবটুকুও ছিল না। অথচ ওঁরা উপেক্ষিত অনুল্লেখিতই রয়ে গেলেন।

আরও পড়ুন-Madhya Pradesh Scam: মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই ব্যাপক কেলেঙ্কারি, খুঁজে বের করলেন অডিটর, প্রতিবাদ তৃণমূল কংগ্রেসের

ওঁরা বঙ্গনারী।
এবং ওঁরা অগ্নিযুগের বিপ্লবী।
যে দুই শতাধিক বঙ্গকন্যাকে ব্রিটিশ সরকার জেলে পুরেছিল, আরও ৯০০ জন সন্দেহভাজন বাঙালি মেয়ে, যাঁদের ওপর ঔপনিবেশিক সরকার নিয়ত নজরদারি চালাত, ওঁরা তাঁদেরই কয়েকজন।
ইতিহাস বলছে, ১৯১৯-এর কাছাকাছি সময় থেকে প্রথম ব্রিটিশ গোয়েন্দা দফতরের ফাইলে বাঙালি মহিলা বিপ্লবীদের নাম নথিভুক্ত হয়। আর ১৯৪৭-এর মধ্যে অর্থাৎ প্রায় ২৮ বছরে, ২০০ জনেরও বেশি নারী-বিপ্লবীকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের বাংলা সংক্রান্ত ফাইল থেকে এই তথ্য-পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন-মন্ত্রিত্ব না পেয়ে হতাশা: বিধায়করা ফিরতে চান উদ্ধব শিবিরে

গবেষণাকারীদের তথ্য আরও জানাচ্ছে, এই নারী-বিপ্লবীদের একটা বড় অংশ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা ছিলেন। বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁরা। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর সঙ্গে নিজেদের জুড়তে দ্বিধা করেননি। গেরুয়া পক্ষের হিন্দি-হিন্দুত্ববাদী দাদাদের মনে হতে পারে, এঁরা বুঝি সব্বাই বর্ণহিন্দু পরিবারের কন্যা।
তা কিন্তু আদৌ সত্যি নয়। ইতিহাস অন্য কথা বলছে।

আরও পড়ুন-ফের বর্ণবৈষম্যের শিকার ভারতীয়

ইতিহাস বলছে, এই নারী বিপ্লবীদের মধ্যে আছেন ময়মনসিংহের হালিমা খাতুন আর রাজিয়া খাতুন। আছেন জোবেদা খাতুন আর জয়নাব রহিম। এঁরা নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘে নাম লেখান।
গবেষকরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত নথিপত্র খতিয়ে দেখে আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত সামনে এনেছেন। এই মহাফেজখানায় বাংলার অগ্নিযুগ-সংক্রান্ত প্রায় ৫০ হাজার দলিল রক্ষিত হয়েছে। এই গবেষকবৃন্দের অন্যতম হলেন মধুরিমা সেন, যিনি প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে লিখে ফেলেছেন আস্ত একটা বই, নাম ‘উইমেন ইন দ্য ওয়ার অফ ফ্রিডম আনভেইলড বেঙ্গল ১৯১৯-১৯৪৭, গ্লিম্‌পস ফ্রম আর্কাইভাল রেকর্ডস’।

আরও পড়ুন-শুভেন্দুর নামে সাইবার থানায় অভিযোগ

এই গবেষণায় উঠে আসা বিষয়গুলির মধ্যে কয়েকটির কথা না বললেই নয়।
১) পশ্চিম ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নারীদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক বাঙালি নারী ব্রিটিশ কারাগারে বন্দিদশা কাটিয়েছেন। এই বন্দিনী বঙ্গবিপ্লবিনীদের একটা বড় অংশের জন্মভূমি ছিল চট্টগ্রাম। ১৯৩০-এ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের পর ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া মেয়েদের সংখ্যা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়।


২) পূর্ববঙ্গের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও বহু মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এঁরা মূলত কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরের বাসিন্দা ছিলেন। কলকাতার বেথুন কলেজ এরকম নারী-বিপ্লবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল।
৩) মেয়েদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে টেনে আনার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল সমসাময়িক পত্র-পত্রিকাগুলি। এই পত্র-পত্রিকার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ‘জয়শ্রী’।

আরও পড়ুন-দুজনের বিরুদ্ধেই শুধু অভিযোগ, ৯৮ জনকে বদনাম করা হচ্ছে, খয়রাসোলে শতাব্দী

কালান্তরে বিস্মৃতির চোরাবালির নিচে চলে গিয়েছেন অনেক নারী-বিপ্লবী। এঁদেরই একজন সুধাংশুবালা সরকার। সরকারি নথি বলছে, বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা (১৯০৮)-এ অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম এই সুধাংশুবালা। ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর সম্পর্কে একটি চারপৃষ্ঠার জীবনবৃত্তান্ত প্রস্তুত করেছিল। ঔপনিবেশিক পুলিশ ও গােয়েন্দাদের কাছে এত গুরুত্বলাভ করেছিলেন যিনি তাঁর ১৯০৮-’০৯-এর পরবর্তী জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে এ-বিষয়ে বিশেষ কোনও গবেষণাও হয়নি। এটা যুগপৎ বেদনাদায়ক ও লজ্জাজনক ঘটনা।

আরও পড়ুন-অ্যাসিড-হামলায় জখম এক পরিবারের তিনজন

বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের কারণে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটতে হয়েছিল যে নারী-বিপ্লবীকে তিনি হলেন দুকড়িবালা দেবী। অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। রডা কোম্পানির অস্ত্র বিপ্লবীদের কবজায় এনেছিলেন যাঁরা তাঁদের অন্যতম নিবারণচন্দ্র ঘটক ও বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়। এঁদের কাছ থেকে দেখার পর বিপ্লবী ভাবধারার উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন তাঁদের ‘মাসিমা’ দুকড়িবালা। নিবারণচন্দ্রের একদম ইচ্ছা ছিল না, তিনি তাঁদের মতো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষা নিন। কিন্তু দুকড়িবালার স্পষ্ট কথা, ‘‘দেশের জন্য যদি ছেলেরা মরতে পারে তবে আমাদের মতো মায়েরা পারবে না কেন!” বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য দুকড়িবালা যখন গ্রেফতার হলেন তখন, ১৯১৭-র ৮ জানুয়ারি ঘরে তাঁর দুধের শিশু মাতৃস্তন্যের জন্য কাঁদছে। মুক্তি পান ১৯১৮-র ডিসেম্বর। জেলে তাঁর ওপর অসহ্য শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিপ্লবীদের সম্পর্কে ন্যূনতম তথ্যও ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর কাছ থেকে বের করতে পারেনি।

আরও পড়ুন-শিক্ষকদের শিক্ষক

বাংলার যেসকল নারী-বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন, তাঁদের মধ্যে শেষতম ছিলেন লীলা নাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম এমএ পাশ করা ছাত্রী। সুভাষচন্দ্রের হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ সংক্রান্ত আন্দোলনে শামিল হয়ে জেলে যান। কারামুক্তির পর ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ সাপ্তাহিকের দায়িত্ব নেন।
এঁদের মতো আরও বহু মহিলা-বিপ্লবী যেমন বেলা রায়, হাস্যবালা দেবী, লীলাবতী বর্মা প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে কারান্তরালে জীবন কাটিয়েছেন।

আরও পড়ুন-আমরা মাথা নোয়াব না !

তাঁদের সেই অগ্নিশিখা বাংলায় এখনও দেদীপ্যমান। তাঁদের সেই বঙ্গনারীর প্রাতিস্বিক অস্মিতার বিভা বঙ্গলোকে এখনও জ্বাজল্যমান।
গেরুয়া পক্ষ তাঁদের কথা বলুক না-বলুক, আমরা তাঁদের আদর্শ ঐতিহ্য পরম্পরা ভুলিনি, ভুলব না।
বাংলাকে তাই আজও বাঘিনি আগলে চলেছেন ‘পাপ্পু’দের নখদাঁত থেকে।

Latest article