মাসাইমারার মেয়েরা

দারিদ্র, অশিক্ষা, লিঙ্গ-বৈষম্যের অন্তরালে গুটিয়ে থাকা মাসাই-রমণীদের জীবন খুব সহজ ছিল না। এই অতি-আধুনিক যুগেও তাঁরা ছিলেন কঠিন পিতৃতান্ত্রিকতার শিকার। সেই বেড়াজাল ছিঁড়ে আজ তাঁরা সমাজের মূলস্রোতে পায়ে পায়ে অগ্রসরমান। তাঁদের এগিয়ে চলার গল্প বললেন সোহিনী মাশ্চারক

Must read

ভোর থেকে উঠে মেয়েটি সব গৃহস্থালির কাজ করে। মাইলের পর মাইল হেঁটে পানীয় জল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে, এমনকী জ্বালানিবাবদ ভারী কাঠও তাঁকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে হয়। যদি সেই মেয়েটির কাছে একটি গাধা থাকে তাহলে সে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে, কারণ, ওই ভারী বোঝা তাকে আর বইতে হবে না। এই ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে এমন নারীজীবন ভাবতে একটু কোথাও অসুবিধে হয়, তাই না! এই পৃথিবীর বুকেই রয়েছে এমন কঠিন জীবনসংগ্রাম যা ক্রমাগত করে চলেছেন নারীরা। সুদূর আফ্রিকার মাসাই গোষ্ঠীর রমণীদের জীবনটা আজও ঠিক এরকমই কঠিন, দুঃসহ ও কষ্টসাপেক্ষ। ভাবতে অবাক লাগে এই জীবন কিন্তু মাসাই মেয়েরা নিজেরা বেছে নেন না— তাঁদের সংসার, বিয়ে, দায়িত্ব, সর্বোপরি ভাগ্য ও ভবিতব্য সবটাই নির্ধারণ করে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। কঠিন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তাঁরা নিত্য অভিযোজন করে চলেন।

আরও পড়ুন-হস্তিকন্যা

পৃথিবী বদলে গেছে কিন্তু আফ্রিকার মাসাইরা একই রকম রয়ে গেছে। কেনিয়া এবং তানজানিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে বসবাসকারী মাসাইরা প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর। এই অঞ্চল ও মানুষগুলো পর্যটকদের জন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও তাঁদের জীবনযাত্রার গভীরে রয়েছে মাসাই রমণীদের কঠিন জীবনসংগ্রামে অলিখিত ইতিহাস। এক যুগ আগেও কেনিয়ার মাসাই নারীদের ২০ শতাংশেরও কম স্কুলে ভর্তি হত। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কেনিয়ায় বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা চালু হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ৪৮ শতাংশ মাসাই মেয়েরা স্কুলে ভর্তি হয়, মাত্র ১০ শতাংশ মেয়ে মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ে যায়। ১১ থেকে ১৩-র মধ্যেই বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পণস্বরূপ থাকে গবাদি পশু ও অর্থ। নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচন, বিবাহবিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহের মতো কোনও সিদ্ধান্তই নেওয়ার অধিকার নেই মাসাই-রমণীদের। বাবা যদি তার কন্যার জন্য বৃদ্ধ পাত্র নির্বাচন করে তাহলেও কিছু করার থাকে না। সেই বৃদ্ধ বর মারা গেলে মেয়েটির অধিকার নেই নিজের পছন্দের কাউকে আবার বিয়ে করে সংসার করার। সেই বিধবা মাসাই মেয়েটি তখন অবশ্যম্ভাবী ভাবেই তার ওই মৃত স্বামীর ভাইদের সম্পত্তিতে পরিণত হয় এভাবেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। মাসাই-রমণীদের একাধিক সন্তান প্রসব করতে হয়— তাঁরা যদি শারীরিক দিক থেকে দুর্বলও হয় তাহলেও এই সামাজিক নিয়ম উলঙ্ঘন করা নৈব নৈব চ।
মাসাইরা তাদের মাতৃভাষা ‘মা’ ব্যতীত অন্য কোনও ভাষায় কথা বলে না। মাসাই সমাজে পুরুষেরা বহুগামী। এই বহুগামিতা তাদের শখপূরণ। একাধিক বিবাহের রীতিও রয়েছে তাদের মধ্যে। এমন করুণ অবস্থা যে প্রথম স্ত্রীর চেয়ে পরের স্ত্রীদের অধিকার কম হয়। শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে থাকা এই মেয়েরা নিজের অধিকার, বিয়ে, সন্তানধারণ বা জন্মনিয়ন্ত্রণ কোনও কিছু সম্পর্কেই মতামত দেওয়া বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম ছিল না। তাঁদের মৌলিক অধিকার বলে কিছু নেই। পিতৃতান্ত্রিক মাসাই সমাজের একটি বড় সমস্যা হল মহিলাদের উপেক্ষা করে রাখা।
প্রত্যেক মাসাই পরিবার পৃথক পৃথক তাঁবুতে থাকে যা ‘ক্রাল’ নামে পরিচিত। সেই ক্রালগুলো বাদে বহির্জগতে তাঁদের যাতায়াত পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ফলে বেশির ভাগ মহিলারই গৃহবন্দি হয়েই কেটে যেত গোটা জীবন।

আরও পড়ুন-কবে জুড়বে শিয়ালদহ-এসপ্ল্যানেড, বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ, ফের জটিলতা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রােয়

এহেন অন্ধকারময় মাসাই সংস্কৃতির জগতে আলোর ছোঁয়া বয়ে আনলেন ফিলোমেনা কিরোয়া। তিনি DER ট্যুরিস্টিক ফাউন্ডেশন নামক একটি সংস্থার কর্ণধার। কেনিয়া ও তানজানিয়ায় মাসাই মহিলাদের বেশকিছু সেল্ফ হেল্প গ্রুপ গড়ে উঠেছে আর এই মহিলা দলগুলি মাসাই রমণীদের জন্য নিরলস কাজ করে চলেছে। তাঁদের নানা সমস্যার সমাধানের পথও বের করছে। এগুলির মধ্যেই অন্যতম হল DER ট্যুরিস্টিক ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির জন্ম ২০১৭ সালের অক্টোবরে। এই সংস্থাটি মাসাই উইমেন এডুকেশন সেন্টারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে মাসাই নারীদের জন্য। নারী শিক্ষার উন্নয়নে। ফিলোমেনা কিরোয়া তাঁর দৃঢ়তা এবং ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ে ইতিমধ্যেই এই কাজে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছেন। আসলে মহিলাদের আত্মবিশ্বাসকে মজবুত করার জন্য প্রয়োজন সংবেদনশীলতা কারণ তাঁদের পারিবারিক পরিস্থিতি পুরুষদের থেকে আলাদা শিশুদের লালন-পালনের দায়িত্ব তাঁদের ওপরেই থাকে, তাই শুধু উপার্জনে সাহায্য করাই না— এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিতে সম্যক ধারণা দেওয়ার কাজও এই স্বনির্ভর দলগুলো করে থাকে। দলগুলো নিয়মিত মিলিত হয়, যেখানে মহিলা শিক্ষকরা উপস্থিত থাকেন, তাঁদের সঙ্গে এই মেয়েরা আলোচনা করে অনেক কিছু জানতে পারেন। এর মধ্যেই ৭৫টি মহিলা গোষ্ঠীর মধ্যে ৫৮টি মহিলা গোষ্ঠী এখন আর্থিক সহায়তা পেতে শুরু করেছে। এই স্বনির্ভর গোষ্ঠীরা আর্থিক দিক থেকে মাসাই নারীদের স্বনির্ভর হয়ে উঠতে সাহায্য করছে।
তানজানিয়ার মামাই লেটুর মতো এখন অনেক মাসাই রমণীরাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। এই গ্রুপগুলিতে অংশগ্রহণ করে তারা শিখেছে কী করে নিজেকে ও ঘর-বাড়ি আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হয়। মাসাই নারীরা এখন জানেন কী করে সাবান বানাতে হয়, কর্নফ্লাওয়ার তৈরি করতে হয়। এগুলি বানিয়ে তাঁরা নিজেরাই বিক্রি করতে পারছেন ফলত আর তাঁদের অর্থের জন্য স্বামীর মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না, নিজেদের অর্জিত অর্থের সাহায্যে পরবর্তী সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারছেন। এই গ্রুপগুলোতে অংশগ্রহণ করে মাসাই রমণীদের জীবনে এসছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

আরও পড়ুন-বাম আমলে আরজি করে ডাক্তারি ছাত্র খুনের ঘটনা, সুবর্ণর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন সৌমিত্র বিশ্বাসের মা

এরকমই আর একটি গ্রুপের নাম নামায়না— যার অর্থ আশীর্বাদ। ৩০ জন সদস্যবিশিষ্ট এই গ্রুপের অন্যতম সদস্য খাদিজাও মনে করেন এই গ্রুপটি তাঁদের মতো মাসাই মেয়েদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ এই গ্রুপ তাঁদেরকে স্বনির্ভর হতে শিখিয়েছে, জীবনকে অন্যভাবে দেখতে ও জানতে শিখেয়েছে, মনের জানলাগুলো খুলে দিয়েছে তাই এক ঝলক মুক্ত বাতাসের মতোই তাদের মধ্যে লুকোনো শিল্পশৈলীগুলো জেগে উঠেছে আর সেগুলোই ক্রমে তাদের উপার্জনের অন্যতম পথ হয়ে উঠেছে। এই গ্রুপের মাসাই মেয়েরা তাদের তৈরি বিভিন্ন হাতের কাজ যেমন— বিডস-এর হার, কানের দুল, আংটি বিক্রি করে। ২০০৯ সালে গঠিত এই গ্রুপটি ইরিঙ্গা প্রদেশের রুয়াহা ন্যাশনাল পার্কের কাছে অবস্থিত মালিনজাগা গ্রামে অবস্থিত। শুরুর দিকে মাসাই মেয়েরা তাদের হাতের তৈরি এইসব জিনিস রাস্তার ধারে ফেরি করত আর রুয়াহা ন্যাশনাল পার্কের টুরিস্টরা সেসব কিনত। কিন্তু রাস্তার ধরে ফেরি করত বলে রোদ-জল-ঝড়ের পাশাপাশি দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। তাই ২০১৭ সালে জাতিসংঘ এই ‘নামায়না’ গ্রুপকে সাহায্য করা শুরু করে। মজবুত ধরনের ছাউনি তৈরি করে দেয় মাসাই-রমণীদের জন্য যাতে তাঁরা তাঁদের হাতের কাজ ওই বিশেষ ছাউনি থেকে বিকিকিনি করতে পারেন। এইভাবে ধীরে ধীরে আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন মাসাই-রমণীরা। তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন এমনকী সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেন। সবসময় স্বামীর মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না।
এই মেয়েরা এখন এগিয়ে এসেছেন চাষাবাদেও। তাঁরা পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছে। মিকিসি গ্রামের ৩১ বছরের মারিয়া নাইকু বা ৩৪ বছরের নাসারিয়ান লেঙ্গাই যিনি আবার পাঁচ সন্তানের মা তাঁরাও সাদরে ড্রিপ সেচ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষাবাদ করছেন। এতে যেমন জলের খরচ প্রচুর কমেছে তেমনি শস্যতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জলও পৌঁছছে ফলে ফলনও ভাল হচ্ছে। এইভাবে মেয়েরাও ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে।

আরও পড়ুন-দিল্লি এইমসে যৌন নির্যাতন লুকোতে ব্যস্ত এবার বিজেপি

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসাই উপজাতির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে ইংল্যান্ড পৌঁছয় সাতজনের একটি দল। এই সাতজনের যে দলটি প্রতিনিধিত্ব করতে সুদূরে ইংল্যান্ডে পৌঁছে গেছিল কারণ তারা চেয়েছিল নিজেদের সংস্কৃতির পরিচায়ক এই হাতের কাজ বা শিল্পকর্মকে সকলের সামনে তুলে ধরতে এবং সর্বোপরি মাসাই সংস্কৃতিকে এবং এই সংস্কৃতির ধারক মাসাই মেয়েদের কথা সকলকে জানাতে। মেয়েরাই যে মাসাইদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও তাদের স্বকীয়তা বাঁচিয়ে রাখার জন্য যারপরনাই তৎপর সে-বিষয়টি কিন্তু এই প্রতিনিধিদের কথায় বারে-বারে উঠে এসেছে। মাসাই সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির প্রতীক বিডস গয়না তৈরি করে নিজস্ব পরিচয়কে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাঁরা। ভাবতেও অবাক লাগে যে মাসাই নারীরা দীর্ঘদিন শুধুই উপেক্ষিতা ছিলেন, যাঁরা ছিলেন কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের উৎস— অন্য কোনও পরিচয় যাঁদের ছিল না তাঁরা আজ চাষাবাদ, পশুপালন, পড়াশোনার পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও পৌঁছে যাচ্ছেন নিজেদের সম্প্রদায়ের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। লিঙ্গবৈষম্য, উপেক্ষা, অশিক্ষাকে পেছনে ফেলে মাসাই-রমণীদের সভ্য সমাজের অঙ্গ হয়ে ওঠার এই লড়াই আগামী দিনে আরও দৃঢ় হবে এই আশাটুকুই থাক।

Latest article