আজকের নারী একা লড়তে জানেন, অর্জন করে নিতে জানেন নিজের আত্মমর্যাদা, স্বাবলম্বন, নিজের বেঁচে থাকার অধিকার। আজকের নারী ভয় পান না একাকীত্বের, কেউ পাশে না থাকার। নিস্পৃহ, নির্লিপ্ত, নীরব জীবনযাপন করেন না তাঁরা। আজকের নারী সরব। তাঁরা আনন্দ, হাসি, কান্না একাই ভাগ করে নিতে পারেন। ব্যবসা থেকে বেড়ানো যে কোনও উদ্দেশ্যে একাই চষে ফেলতে পারেন গোটা পৃথিবী। তবু কোথাও একা মেয়ের জীবন কাটানোটা, নিজের শর্তে বাঁচা আজও সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য নয়, তাঁদের আত্মনির্ভরতাকে ঘিরে আজও সমালোচনা হয়। একা নারী পিঠে রুকস্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়বে দেশ-বিদেশ ঘুরতে একথা শুনলে রেহাই দেবে না সমাজের এক শ্রেণির মানুষ। কানঘুষো, মুচকি হাসি বা অবাক দৃষ্টিনিক্ষেপ। কিন্তু তাতে কী; মেয়েদের পায়ের তলাতেও এখন সরষে। একা বেড়াতেই তাঁরা বেশি স্বচ্ছন্দ।
আরও পড়ুন-শৈলবালা ঘোষজায়া, এক বিস্মৃত কলম-বিপ্লবী
পরিবার থাকলেও অনেকেই আছেন বছরে অন্তত একবার একা বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। যাঁরা শুধু পরিবার নিয়েই বেরন তাঁদের মনের গোপন কোনেও লালিত হয় একা ডেস্টিনেশন এক্সপ্লোর করার ইচ্ছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজও অধরা অনেকের। কারণ একা মহিলার ভ্রমণের ইচ্ছেপূরণ একটু কঠিন।
একা মহিলা বা একদঙ্গল; সম্মিলিত ট্যুর কনডাক্ট করা সহজ কাজ নয়। কারণ মেয়েদের একা বেড়াতে যাওয়ায় যেমন রোমাঞ্চ আছে তেমন কিছু ক্ষেত্রে বড়সড় রিস্কও আছ। রয়েছে পরিবারের বাধা। সমাজের শ্যেণচক্ষু আছে। এই সব উপেক্ষা করে যাঁরা বেরিয়ে পড়তে পারেন নিরুদ্দেশের ঠিকানায় তাঁদের জন্য এই ট্যুর কনডাক্ট করেন ডিভাস সোজর্ন। যাঁর কর্ণধারও সেই একাই এক নারী।
দিল্লীর নিবাসী পূজা স্বপ্ন দেখান মেয়েদের মাঝ আকাশে ডানা মেলবার, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যাবার। না তথাকথিত ভাবে সিঙ্গল উওমেন বা সিঙ্গল মাদার নন তিনি। কিন্তু পরিবার থাকলেই যে কোনও মেয়ে একা হতে পারেন না এটাই বা কোথায় লেখা আছে। হাজার ভিড়েও মানুষ একা হয়।
আরও পড়ুন-দুই সংগ্রামী মহিলা চিকিৎসক
শৈশবের কয়েক বছরের সুখস্মৃতির পর গোটা জীবন জুড়েই লড়াই করেছেন পূজা। বাবা ছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মী এবং মা বিএসএফ-এর চাকুরে। তাঁরা তিনবোন তাই ছোট থেকেই বেশ দায়িত্বশীল এবং আত্মনির্ভর। আর পূজার দায়িত্ব একটু বেশিই কারণ তিনি বড়। বাবা-মা কোনওদিন বুঝতে দেননি যে তাঁরা মেয়ে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বড় করেছিলেন মেয়েদের বাবার চাকরির দৌলতে পূজা ছোট থাকতেই দেশ-বিদেশ ঘুরতেন। মানুষ যে বয়সে স্বপ্ন দেখে বেড়ায় পূজা তখন তাঁর শৈশবের রঙিন ডানায় ভর করে ঘুরে ফেলেছেন বহু দেশ। কর্মব্যস্ত বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে ছোট বোনেদের দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে ওই বয়সেই অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছিল সে। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে দিল্লি থেকে সোজা ব্যাঙ্গালোর। অনেক স্বপ্ন তখন চোখে। কিন্তু একটা বড় পদক্ষেপ তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি এবং বাবা-মায়ের অমতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে তাঁকে বিয়ে করে ফেলেন পূজা। দুই পরিবারের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। কিন্তু বিধির বিধান। বিয়ের পরে ভুল ভাঙে তাঁর। স্বপ্নভঙ্গ হয়। পূজা জানতে পারে তাঁর স্বামী জুয়া খেলেন একেবারেই বেকার কিছুই করে না। মনুষ্যত্বের গণ্ডিটা করেননি কোনওদিন। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। ইতিমধ্যে তাঁর দুটি সন্তান হয় তাঁদের। পূজা তখন চাকরি করতেন কিন্তু তাঁর স্বামী সেটাও ছাড়িয়ে দেন। দিনের পর দিন অশান্তি, মানসিক টানাপোড়েন।
আরও পড়ুন-রথযাত্রা
দু-দুটো সন্তান অথচ বাড়িতে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। অথৈ জলে পড়েন তিনি। পড়াশুনোয় খুব ভাল ছিলেন তাই জেদ করেই শুরু করলেন ছাত্র পড়ানো। প্রথমে অন্যের বাড়িতে যেতে হত তারপর নিজের বাড়িতেই পড়ানো শুরু করেন। ধীরে ধীরে সেখানে বাড়তে থাকে ছাত্রছাত্রী। বাড়ির সেই ছোট্ট ঘরটা পরবর্তীকালে এক সুবিশাল ইনস্টিটিউশনের আকার নেয়। একদিকে ইনস্টিটিউশন অন্যদিকে ছেলে মেয়েদের দেখভাল, পড়াশুনো এইভাবে প্রায় ১৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। ছেলে তখন ডাক্তারি পাশ করেছে, মেয়ে চুটিয়ে পড়শুনো করছে।
কিন্তু দিন পেরলেও সেই ছোট্ট মেয়েটা যে উড়ে বেড়াত আকাশে বাবা-মায়ের সঙ্গে, তাঁর সেই ইচ্ছেটা মনের মধ্যে ঝাঁপি বন্ধ হয়ে পড়েছিল। নিজের চল্লিশ বছরের জন্মদিনের সকালে হঠাৎ করেই তাঁর মনে হল যে জীবনের ৪০টা বসন্ত পেরিয়ে গেল তাহলে কি আর কিছুই করণীয় নেই! ঘোরা বেড়ানো যাঁর রক্তে তাঁর আসল সময়টাই তো বেরিয়ে গেল স্ট্রাগল করতে করতে। স্বামী, শ্বশুরবাড়ির কারও সাপোর্ট ছিল না কোনওদিন এরপরেও হয়তো থাকবে না। ছেলেমেয়েদের অন্য জগৎ। তাহলে? তখন তিনি পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। চেয়েছিলেন শুধু মেয়েদের একটা গ্রুপ করে একটা ছোটখাটো কোনও ট্রিপ করার। কারণ পূজার মনে হয়েছিল যে তাঁর মতো এই একই রকম সমস্যায় তো আরও বহু মেয়ে রয়েছেন। যাঁরা একা বেড়াতে যেতে চান। তখন তিনি শুরু করলেন রিসার্চ ওয়ার্ক। বহু মেয়েদের মতামত নেন এবং সমীক্ষার পর দেখেন বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত বেশিরভাগ মহিলা একা ঘুরতে যাওয়ার সপক্ষে রায় দিচ্ছে। কারণ বেশিরভাগ বিবাহিত মহিলারা মনে করেন পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে গেলে গৃহিণীদের রোজনামচার কোনও পরিবর্তন হয় না। সেই থোড় বড়ি খাড়া।
আরও পড়ুন-উদয়পুর হত্যাকাণ্ড: একসঙ্গে বদলি ৩২ জন পুলিশ আধিকারিক
আবার অবিবাহিতরা মনে করেন একটা বয়সের পর পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়াটা আনন্দের হয় না। অতএব সুপ্ত ইচ্ছে সকলের মনেই রয়েছে যা হয়তো সম্ভব হয়ে উঠছে না। ৯৫ শতাংশ মহিলা সহমত পোষণ করেন। এই রিসার্চের পরেই পূজা শুরু করলেন উইমেনস ট্যুর গ্রুপ। তখনও নাম ঠিক হয়নি গ্রুপের। প্রথম ট্রিপটা তিনি অর্গানাইজ করলেন এই রাজ্যেই। উত্তরবঙ্গের দুটি জায়গায় দার্জিলিং এবং ডুয়ার্স ঘুরিয়ে আনলেন ছোট পাঁচ সাতজনের একটি মহিলা দলকে। ভীষণ ভাল রেসপন্স পেলেন তিনি। দ্বিতীয় ট্রিপ ছিল রাজস্থানের জয়পুরে। এই ট্রিপে জার্মান এবং সিঙ্গাপুর থেকেও দুই বিদেশি মহিলাও অংশ নিলেন। ধীরে ধীরে দেশের বাইরেও একটা ছোট্ট পরিচিতি হল তাঁর। সফলভাবে ট্যুর কনডাক্ট করে দারুণ প্রশংসা পেলেন। এরপরেই তিনি ট্যুরিজমের উপর একটা কোর্স করে ২০১৫ সালে শুরু করলেন নিজের ট্রাভেল এজেন্সি। নাম দিলেন ‘ডিভাস সোজর্ন’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায় মহিলাদের জার্নি বা ভ্রমণ। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাননি। স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির সাহায্য ছাড়াই এগিয়ে গেছেন। এই সময় পূজার পক্ষে দুটো ব্যবসা চালানো মুশকিল হচ্ছিল তখন ইনস্টিটিউট বন্ধ করে প্যাশনকে বেছে নিলেন তিনি।
আরও পড়ুন-দু’বছর পর মহাসমারোহে মাহেশের ঐতিহাসিক রথযাত্রা পালন
পুরোপুরি মনোযোগ দিলেন মহিলাদের জন্য তৈরি ট্রাভেল গ্রুপে। শুরু হল স্বপ্নের যাত্রা। কোভিডকালে আবার ধাক্কা খেলেন পূজা কারণ করোনা অতিমারিতে দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার ট্রেন, ট্যুরিজম স্পট গোটা দেশের তথা পৃথিবীর ট্যুরিজম। ব্যবসার বড়সড় ক্ষতি হয় কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। যখনই পরিস্থিতি সামলাত তখনই ছোটখাটো মহিলা গ্রুপ নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। তারপর আবার সব স্বাভাবিক হল আবার পুরোদমে শুরু হল। এখন মহিলাদের নিয়ে মাসে চার থেকে পাঁচটা ট্রিপ করেন পূজা। নিজস্ব অফিস খোলেন। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির আকার দেন। শুধু দেশের মধ্যে নয় ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরও করান। বালি, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, দুবাই ছাড়াও বহু জায়গায় ঘুরেবেড়ান ডিভাস সোজার্ন-এর মহিলারা। এখন সব ট্যুরে পূজাকে যেতে হয় না তাঁর লোকজন রয়েছে ব্যবস্থাপনায়। নিজে জীবনের প্রতি সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। মনে করেন প্রতিটা মেয়ের আত্মনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি।