অধ্যাপক অরুন্ধতী দাস: গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে টেলিভিশনের পর্দায় বিজেপির রাজ্য সভাপতিকে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে শুনেছিলাম, ‘মহিলা/সংখ্যালঘু/দলিত’ আখ্যাগুলো আসলে ‘সেফগার্ড’ নেওয়ার ছল!
ঠিকই বলেছেন মশাই। কিন্তু কেন এই তথাকথিত ‘সেফগার্ড’-এর দরকার কিছুতেই ফুরোচ্ছে না? ‘আচ্ছে দিন’ দেখে-ফেলা ভারতে কেন প্রতি ঘণ্টায় অন্তত চল্লিশটি নারী নির্যাতনের ঘটনা আজও ঘটে চলেছে? হরিয়ানা, সুরাট, কাঠুয়া, উন্নাও, বদায়ুন, হাথরাস সর্বত্র জঘন্যতম নারকীয় নির্যাতনের ছবি একের পর এক উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে, ঠান্ডা স্রোত বইয়ে ছেড়েছে গোটা ভারতের শিরদাঁড়া জুড়ে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
আরও পড়ুন-
তাহলে বলি, ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আসামের দরং জেলায় ভিন্ন ধর্মে বিয়ের অনুষ্ঠান করার অপরাধে তিন মহিলাকে সিপাহঝাড়ের বুঢ়া থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে বিজেপি সরকারের পুলিশ এমনই অত্যাচার চালায় যে, ঘটনাস্থলেই সন্তানসম্ভবা এক মহিলার গর্ভপাত পর্যন্ত হয়ে যায়! মৃত মায়ের গর্ভস্থ ভ্রূণকে ত্রিশূলের ডগায় গেঁথে জল্লাদনৃত্যের মধ্যে যে-দল শৌর্যের তুঙ্গ মুহূর্ত কল্পনা করে, যোগী-রাজ্যের পুলিশ যেখানে লাভ জিহাদ অর্ডিন্যান্স জারি করে মেয়েদের দাম্পত্যসঙ্গী নির্বাচনের অধিকারের মতো একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, সেখানে একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই আশ্চর্য পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের রাজনীতি নিও ফ্যসিস্ত ভারতের সমাজনীতি। তারা মনে করে, ভিনধর্মে মেয়ের বিয়ের অর্থই স্বধর্মের সম্প্রসারণের পথে বাধা সৃষ্টি হওয়া। সংখ্যালঘুদের অনাগরিক করে দেওয়ার রূপায়নে বাধা প্রদান।
আরও পড়ুন- বাংলার মহিলাদের “ভিখারি” সম্বোধন করে বিপাকে দিলীপ ঘোষ, হল এফআইআর
এসবের মাঝেই স্রেফ ‘আই ওয়াশ’ করতে সাজো-সাজো রবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এগিয়ে আসে বিজেপির মহিলা মোর্চা। তাদের দাওয়াই—হোয়্যাটস্যাপ নম্বর। সেই নম্বরেই মিস্ড্ কল দিয়ে আবেদন জানানো যায় সেই মহিলা মোর্চা দলেরই সদস্য হওয়ার জন্য! বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই মিস্ড্ কল-মিস্ড্ কল খেলায় সুবিচারের আশা দলাদলির আড়ালে অস্তমিত হয়ে যাবেই যাবে ! এই দরদ যে আসলে ভাঁওতাসর্বস্ব এবং লোকদেখানো, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় মুখে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগান দেওয়া নেতা হাতে ভুল বানানে কিম্ভূত অক্ষরে লেখা প্ল্যাকার্ড ধরে বলছেন, কন্যাশ্রী চাই না, নারী সম্মান চাই! শুধু রাজ্য নয়, গোটা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এই কন্যাশ্রীর মাসিক অনুদান প্রকল্পে প্রায় ২৮ লক্ষের উপর ও এককালীন অনুদানে প্রায় ৭ লক্ষের উপর মেয়ে যেখানে নির্ভরশীল, সেই কন্যাশ্রীকে নাকচ করে কোন্ ‘বেটি পড়াও’-এর ধ্বজা তুলে ধরতে চাইছে এই আপাদমস্তক স্ববিরোধে ভরা বিজেপি সরকার!
আরও পড়ুন- দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ পড়ল মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প ‘’দ্রৌপদী’’
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী (সদ্যপ্রাক্তন) তীরথ সিং রাওয়াত মহিলাদের পোশাক নিয়ে বাঁকা মন্তব্য করেন। বিহার বিধান পরিষদের সদস্য বিজেপি নেতা অভিযুক্ত হন নাবালিকাকে নিগ্রহ করে। তাদের মুখে ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগান একটা ভয়ানক ঠাট্টা বলে মনে হয়।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনায় ভারত যথেষ্ট বিপন্ন, শীর্ষস্থানে উত্তরপ্রদেশ। নারীবাদী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের কর্মী কবি কমলা ভাসিন এই প্রসঙ্গে স্পষ্টতই বলেন, সমস্যাটা আদতে লুকিয়ে আছে ‘ছপ্পন ইঞ্চ কি ছাতি’ নিয়ে একজন প্রধানমন্ত্রীর পৌরুষের গর্বে ফুলে ওঠা থেকে শুরু করে তাঁর দলের লোকজনদের যাবতীয় পুরুষতান্ত্রিক মন্তব্যের মধ্যেই।
আরও পড়ুন- চিনা মাঞ্জা থেকে বিপদ আটকাতে সেতুর দু’পাশে লোহার জাল
আসলে নারীর সম্মান তো ভিক্ষার আঁকাড়া চাল, চাইতেও বাধে, গিলতেও বাধে। কিন্তু অধিকার তো আর দাক্ষিণ্যের বস্তু নয় যে, ক্ষমতার গা-জোয়ারি দিয়ে তা ইচ্ছেমতো কেড়ে নেওয়া যাবে! ধরনা, মিছিল, সহানুভূতি নয়, বরং সংবিধানের জোরেই এই অধিকার এবার বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেকথাটা এবার মোদী- শাহদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।