কোভিড ১৯— এই একটি মহামারী গোটা বিশ্বের চালচিত্রটাই গত কয়েক বছরে পাল্টে দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। ‘মাস্ক’, ‘পাল্স অক্সিমিটার’ হয়ে উঠেছিল দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। এখন হয়তো তার আর দরকার পড়ছে না। কিন্তু কোভিডের কল্যাণে অনেক অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত শব্দ আমাদের অভিধানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তেমনই একটি শব্দ ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা বাড়ি থেকে কাজের ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন-লিগে আজ ইস্টবেঙ্গলের সামনে এরিয়ান
করোনাকালে লকডাউনের সময় থেকেই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর বহুল ব্যবহার চালু হয়েছিল। সমস্ত সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কার্যত এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। কোভিডের উপদ্রব কমলে বহু সংস্থা যেমন আগের মতো নিয়মিত অফিসে হাজিরা দিয়ে কাজের নিয়ম চালু করেছে, তেমনই অনেক সংস্থা বহাল রেখেছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর নিয়মই। আর এই টানাপোড়েন প্রশ্ন তুলেছে, কোন ব্যবস্থা বেশি সুবিধাজনক? বিশেষত, মহিলাদের ক্ষেত্রে?
আরও পড়ুন-আগুন-আতঙ্ক মুম্বই-বেঙ্গালুরু উদয়ন এক্সপ্রেসে
ভারতের অন্যতম বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস)। তারা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজের গতি ও মান বাড়াতে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরও কয়েকটি সংস্থা। তারপরই দেখা যাচ্ছে, সংস্থার কর্মীরা কার্যত গণ-ইস্তফা দিচ্ছেন। আর সেই তালিকায় বেশির ভাগই মহিলা! সত্যতা মেনে নিয়েছে সংস্থাগুলির কর্তৃপক্ষও। কিন্তু কেন? বাড়ির পরিবেশে, পরিবারের মাঝে থেকে কাজের পরিবেশে অনেকেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। মহামারীর প্রকোপ কমার পর ‘চেনা’ অফিসে ফিরতে হলেও তাঁরা অনেকেই আর মানসিকভাবে মানিয়ে নিতে পারছেন না। তারই ফলশ্রুতি ব্যাপক হারে ইস্তফা। সম্প্রতি আমেরিকায় একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য! সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ২৫ শতাংশই জানিয়েছিলেন, অফিসে আর ফিরতে না হলেই ভাল হয়! এবং এর সিংহভাগই মহিলা।
আরও পড়ুন-বর্ষার উৎসব তিজ
বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভাবিয়ে তোলার মতো। কারণ, লকডাউনে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ট্রেন্ড নজরে এসেছিল, ‘সবকিছু বন্ধ, কিন্তু রান্নাঘর, সংসারের কাজ বন্ধ নেই। মেয়েদের কাজ করে যেতেই হচ্ছে।’ ঘর মোছা, বাসন ধোয়া, রান্না করা, বাচ্চাদের দেখাশোনা— এই ধরনের ‘মেয়েলি’ কাজ ‘দায়িত্ব’ বলেই মেনে নেন মেয়েরা। তা তিনি চাকরিজীবী হলেও। খুব কম সংসারেই পুরুষ সদস্যদের এ বিষয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। লকডাউনেও কিন্তু ছবিটা বিশেষ পাল্টায়নি। আর প্রথমদিকে যখন গৃহসহায়িকারাও বাড়িতে ‘বন্দি’, তখন তো পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। এমনিতেই কর্মরত মহিলাদের ‘ঘরের কাজ’ সামলে অফিসে যেতে হত। কোভিডকালে তাতে বিরাট কিছু ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু একটি বড় সুবিধা হয়েছে, যাতায়াতের সময়, খরচ এবং পরিশ্রম— তিনটিই বাঁচছে। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বন্ধ করায় মহিলাদের চাকরি ছাড়ার এটি অন্যতম কারণ হতেই পারে। দ্বিতীয়ত, সাংসারিক নানা কারণে মহিলাদের অফিসে গিয়ে কাজ করা কষ্টসাধ্য। ‘নিউক্লিয়াস’ পরিবারে সন্তানের দায়িত্ব হয় আয়া বা পরিবারের কোনও বয়স্ক মানুষের উপর ছেড়ে যেতে হত। কোভিডের জেরে বহু পরিবার এমন ‘বয়স্ক’ সদস্যকে হারিয়েছে। তার ফলে সন্তানের দায়িত্ব সামলাতে গিয়েও জেরবার বহু মহিলা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
আরও পড়ুন-জিতে ফের শীর্ষে ডায়মন্ড হারবার
‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বহুলভাবে চালু থাকলে অনেক মহিলা বাড়িতে থেকেও পেশাগত দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি, তাঁদের আর্থিক স্বনির্ভরতাও বজায় থাকবে। এই ভারসাম্য বজায় রাখার কথাই তাঁদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে।
সংসারে বাড়তি দায়িত্বের চাপ সত্ত্বেও কেন মহিলারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম পছন্দ করছেন? একটু তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, কর্মরতা মহিলাদের অনেকেই অপরাধবোধে ভোগেন। পরিবার, স্বামী, সন্তানকে সময় দিতে না পারার অপরাধবোধ। আর্থিক সামর্থ্য সব সময় সেটা পূরণ করতে পারে না। বাড়ি থেকে কাজ করলে তা অনেকটাই লাঘব হয়। মনে শান্তি পান, ‘আর্থিকভাবে স্বনির্ভর তো রয়েছি। একই সঙ্গে পরিবারের জন্য দায়িত্ব পালনে কোনও ত্রুটি থাকছে না। স্বামী বা সন্তান আমার দিকে আঙুল তুলতে পারবে না।’
আরও পড়ুন-মালয়েশিয়ায় বিমান দুর্ঘটনা, নিহত ১০
আরও একটি বিষয় উল্লেখযাগ্য। আমরা যত বড়াই করি না কেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতি হেনস্তা পুরো বন্ধ করা যায়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সহকর্মী অনেকেই ‘অবাঞ্ছিত’ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। বাড়ি থেকে কাজ করলে সেই পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। সেই ভাবনাও কারও কারও ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি, দেশের ছোট-বড় সব শহরেই ট্রাফিক সমস্যা মাথাব্যথার কারণ। ট্রেনে-বাসে-মেট্রো সফরে কখন কী দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে, কেউ জানে না। আর কর্মস্থল থেকে যাঁরা গাড়ি পান, তাঁদেরও কিন্তু যানজটে নাকাল হতে হয়। সেই যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি মেলে বাড়ি থেকে কাজ করলে। সময় ও এনার্জি দুটোই বাঁচে।
আরও পড়ুন-মালয়েশিয়ায় বিমান দুর্ঘটনা, নিহত ১০
আরও একটি ‘ছোট্ট’ যুক্তি দেওয়া যেতে পারে। কারও কাছে তা ‘সেক্সিস্ট’ মনে হতেই পারে। কিন্তু তা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রাত্যহিক কর্মস্থলে যেতে তৈরি হওয়ার বিশেষ ঝামেলা নেই পুরুষদের। কিন্তু যেমন তেমন পোশাক পরে, বিনা প্রসাধনে মেয়েরা বের হতে পারেন না। হয়তো চানও না। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েদের ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা। কখনও কখনও কর্মস্থলে পোশাকবিধি থাকে। বাড়িতে বসে কাজে সেই ঝামেলা নেই। নিত্যদিনের সেই ‘চিন্তা’ থেকেও রেহাই মেলে। সরকারি-বেসরকারি বহু সংস্থা মেনে নিচ্ছে, পুরোপুরি না হলেও আংশিক ওয়ার্ক ফ্রম হোম ভবিষ্যতের বাস্তবতা। খরচ কমানোর অন্যতম উপায়ও বটে। আর এত মহিলা যখন এই বাজারে ঝুঁকি নিয়ে কাজ ছাড়ার কথা ভেবেছেন, তখন নিশ্চিতভাবেই তাঁদের যুক্তির পক্ষে পাল্লা ভারী হওয়ার কথা।
আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রী আপনিই দায়ী, মেয়াদ শেষের চিঠিতে বরাক উপত্যকা নিয়ে তোপ সুস্মিতার
তবে অসুবিধা কি কিছুই নেই? উল্টোদিকেও যুক্তি কম নেই। অফিসে কাজের নির্দিষ্ট সময় বাঁধা থাকলেও ওয়ার্ক ফ্রম হোমে অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা যায় না। আবার কাজে বসলে কখনও বাড়ির লোক মনে করেন, ঘরের কাজে ফাঁকি দেওয়ার এটা দারুণ ফন্দি। কাজ ছেড়ে ঘরে সময় দিলে বসের ‘বকুনি’ খাওয়ার আশঙ্কা। ছুটি-উইক এন্ডের বালাই থাকে না অনেক সময়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোমে কাজের চাপ দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে শারীরিক, নয় মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলেই কম ঘুম বা ঘুমের ব্যাঘাতের মতো সমস্যা বাড়ছে। অনেকটা সময় ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইলের দিকে ফলে ক্ষতি হচ্ছে চোখের।
আর তার চেয়েও বড় সমস্যা— নতুন প্রজন্মের বড় অংশ হয়তো ‘অফিস’ কী সেটাই জানবে না। বুঝবে না ‘অফিস পলিটিক্স’, কীভাবে সহকর্মীরা বিপদের দিনে ‘বন্ধু’ হয়ে উঠতে পারে, তা-ও জানতে পারবে না। হারিয়ে যাবে অফিসের কোনও সুন্দরী বা সুপুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে চোখের ইশারা, মুচকি হাসি থেকে তৈরি হওয়া ভালবাসা, চায়ের কাপ হাতে আড্ডা। সহকর্মীরা পরস্পরের ‘নাম’ জানবে, হবে না ‘পরিচয়’। হয়তো বা কর্তৃপক্ষের কাছেও। পরিচয় হবে একটাই— ‘নাম…। এমপ্লয়ি নম্বর…’।
আরও পড়ুন-১০০ বছরে এই প্রথম মহালয়ায় সূর্যগ্রহণ! ভালো হবে না খারাপ?
গ্রহণযোগ্য নয়
মৌমিতা দত্ত
প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা
আমাদের কর্মজগতে শুধু কাজটাই আসল নয়, ওটা একটা সামাজিক আদান-প্রদানের জায়গাও বটে। আমরা সামাজিক জীব ফলে কাজের পাশাপাশি সোশ্যাল লাইফ গড়ে তোলাটাও আমাদের কর্তব্য। কর্মজগৎ আমাদের নানান একঘেয়েমিতা থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু ওয়ার্ক ফ্রম হোমে আমরা পুরোপুরি ঘরের চার দেওয়ালে আবদ্ধ ছিলাম। বাইরের জগতের সঙ্গে মেলামেশার অবকাশ ছিল না। পুরোপুরি ঘরবন্দি একটা অবস্থান। যা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে কাজের চাপ তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। ফলে ওপেন ওয়ার্ক প্লেস-এর সঙ্গে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কোনও তুলনাই চলে না। একটি বাচ্চার জন্যও বাড়ি বসে স্কুল তার শারীরিক, মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। কাজেই অফিস হোক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ওয়ার্ক ফ্রম হোম আমার কাছে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য নয়।
আরও পড়ুন-শিক্ষিত প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সওয়াল করে বরখাস্ত শিক্ষক
ভাল আছে, খারাপও
দেবারতি মুখোপাধ্যায়
লেখক ও সরকারি চাকুরে
আমি রাজ্য সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছি ফলে কোভিডের সময় আমার কোনওদিনই ওয়ার্ক ফ্রম হোম ছিল না। রোজ অফিস যেতে হয়েছে। আমার ছেলে তখন খুবই ছোট। আমি থাকতে পারিনি ওর সঙ্গে। কিন্তু ওর বাবার তখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম ছিল ফলে ও ছেলেকে সম্পূর্ণ সময় দিয়েছে। আমার ছেলে কোনও একজনকে পুরোটা পেয়েছে। এটা খুব ভাল বিষয় ছিল। একইভাবে বাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকলে যে-কোনও মায়ের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম সুবিধার। একজন মায়ের কর্মজগৎ ও বাড়িটা ব্যালান্স হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি মানুষ সামাজিক প্রাণী। ঘরবন্দি থাকার জন্য তার জন্ম হয়নি। কর্মজগৎ মানেই শুধুই কাজ করা নয়, আরও অনেক কিছু। ওয়ার্ক ফ্রম হোম মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে একটা কুপ্রভাব ফেলেছে। আমার অনেক বন্ধু আছে আইটি সেক্টরে, তারা তখন বলত বাড়িতে থেকে অফিস করা অনেকটাই চাপের। কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা তাঁদের ছিল না, যখন-তখন অফিসের কল আসত। অথরিটি মনে করত বাড়ি আছে মানেই যে কোনও সময় কাজ চাপিয়ে দেওয়া যায়। যেটা হয়তো বাইরে বেরলে হত না। একটা আলাদা নির্দিষ্ট টাইম থাকত দুটো কাজেরই। ফলে খারাপ ভাল দুই-ই রয়েছে।
আরও পড়ুন-স্ত্রী-মেয়েকে খুন করে আত্মঘাতী প্রাক্তন সেনাকর্মী
রিল্যাক্স থাকা যায় ওয়ার্ক ফ্রম হোমে
শ্রীষিতা ঘোষ
পি আর কনসালটেন্ট
ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি ওয়ার্ক ফ্রম হোমে থাকার সময় আমার প্রোডাক্টিভিটি অনেকটা বেড়েছিল। যেহেতু বাড়িতে আছি বাইরের কাজের সঙ্গে আমাকে ঘরের কাজও সামলাতে হত। তা সত্ত্বেও মনে হয়েছে যেন অনেকটা রিল্যাক্স থাকতে পারতাম। নিজের মতো করে কাজটা গুছিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু এখন আবার সেই নাকে-মুখে গুঁজে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ছি। ফিরতে ফিরতে সেই রাত। যাতায়াতটা একটা বড় সময় নিয়ে নিচ্ছে সেই সঙ্গে খরচটাও বেড়ে গেছে। অফিস, বাড়ি দুটোই যাঁদের সামলাতে হয় তাঁদের পক্ষে এটা হেকটিক তো বটেই। কোভিডের পর বেশ কিছু মাল্টিন্যাশনাল সংস্থা নতুন পদ্ধতি চালু করেছে দুই বা তিনদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম বাকি তিনদিন অফিস। এটা খুব ভাল। এতে বাইরে বেরিয়ে কাজ করার অভ্যেসটাও থাকল আবার ঘরের দিকটাও সামলে দেওয়া গেল। এই ব্যালান্সিংটাই দরকার মনে হয়।