বর্ষার উৎসব তিজ

পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যার তৃতীয় দিনে পালিত হয় ‘তিজ’— যার অর্থ তৃতীয়। ভারত তথা নেপাল, উত্তর ও পশ্চিম রাজ্যগুলিতে বর্ষাকালকে স্বাগত জানাতে মহিলারা পালন করেন এই সুন্দর উৎসবটি। বর্ষার রঙ্গিলা তিজ উৎসব নিয়ে লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

মাস তিনেক হল রাজস্থানের জয়পুরে বদলি হয়ে এসেছে সৌরভ, আর ওর সঙ্গে ওর সদ্য-বিবাহিত স্ত্রী মেহুলিও কলকাতাকে গুডবাই জানিয়ে চলে এসেছে বরের সঙ্গে। সৌরভ আর মেহুলি প্রেম করে বিয়ে করলেও বাড়ির সবাইকে ছেড়ে, প্রাণের শহর কলকাতাকে ছেড়ে এত দূরে আসতে ওর মন একটু খারাপই হয়েছিল। কিন্তু জয়পুরে এসে জয়পুরের মায়াময়ী রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে মেহুলি। আর এখানে এসেই সে একটি নতুন উৎসবের সন্ধান পেয়েছে। সেই উৎসবটির নাম ‘তিজ’ (Teej)। কলকাতার বুকে বসে এই উৎসবটির ব্যাপারে সেভাবে কিছুই জানত না মেহুলি।

তিজ কী
তিজ (Teej) বলতে বর্ষা উৎসবকে বোঝায়। এই উৎসব বিশেষ করে ভারত এবং নেপালের উত্তর ও পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে পালন করা হয়ে থাকে। এই উৎসবটির মাধ্যমে মেঘ-বৃষ্টির আগমন, সবুজ প্রকৃতি ও পাখি এবং তাদের সামাজিক কার্যকলাপ, রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। এই উৎসবটা মহিলা-কেন্দ্রিক। অর্থাৎ এই উৎসব মহিলারাই পালন করে থাকেন। এই উৎসবের মাধ্যমে মহিলারা সবাই একত্রিত হয়, নাচ-গান করে, বিভিন্ন ধরনের খাবার বানান। হাতে মেহেন্দি করেন, লাল, সবুজ বা কমলা রঙের পোশাক পরেন। এবং উৎসবের খাবার সবাই ভাগাভাগি করে নেয়। এই উৎসবে মিষ্টি ছাড়াও পঞ্চামৃত, গুজিয়া, হালুয়া, ডাল, বাটি চুরমা, মিরচি পকোড়া, কচুরি ইত্যাদি খাবার প্রস্তুত করা হয়।

রাজস্থানের জয়পুরেও
তিজ (Teej) উৎসব আসলে শিব-পার্বতীর মিলন উৎসব। এই সময় তিজ মাতার কাছে স্বামীর দীর্ঘায়ু এবং মঙ্গল কামনা করেন তাঁদের স্ত্রীয়েরা। জুলাই-অগাস্ট মাসে এই উৎসব পালন করা হয়। তিজ মাতাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ডুলিতে করে নিয়ে অথবা কোনও কোনও জায়গায় গরুর গাড়িতে করে নিয়ে বিশাল মিছিল বের করা হয়। এই দিন বিবাহিত মেয়েরা হাতে মেহেন্দি পরেন এবং সাবেকি রাজস্থানি পোশাক অথবা লাল শাড়ি পরেন। এ-ছাড়াও এই দিন প্রচুর গয়না পরে থাকেন। আর এই ভাবেই সেজেগুজে সবাই তিজ মাতাকে নিয়ে শোভাযাত্রা বের করেন। এই শোভাযাত্রায় লোকসংগীতের সঙ্গে নাচতে নাচতে সামনে এগিয়ে যান। এই উৎসবে মুখরিত পিঙ্ক সিটি জয়পুরের রাস্তা এই দিন নানা রঙে সেজে ওঠে। রাস্তার দু’ধারে নানা ধরনের রাজস্থানি খাবার এবং নানা ধরনের রাজস্থানের জিনিসের পশরা বসে। জয়পুর ছাড়াও বুন্দিতেও এই তিজ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন-অনবদ্য নাটক গোধূলি গগনে

তিজ কাদের উৎসব
তিজ (Teej) হচ্ছে নেপালিদের একটি প্রধান উৎসব। এদিন নেপালি মহিলারা লাল রঙের শাড়ি পরে নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সেজে ওঠেন। নেপালিদের উৎসব হলেও তিজ জায়গা করে নিয়েছে ভারতবর্ষেও। বিশেষ করে বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে বহুল প্রচলিত উৎসব হচ্ছে এই তিজ। তবে এই উৎসব বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, মিরিক, কার্শিয়াং, কালিম্পংয়েও বেশ বড় করে পালন করা হয়ে থাকে। গোর্খা মহিলারা সাড়ম্বরে তিজ উৎসব পালন করে থাকেন। এই উৎসবটি প্রধানত মেয়েরা করে থাকেন, অর্থাৎ বলা যেতে পারে এটি একটি মেয়েদের উৎসব। তিজ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ত্রিত্য থেকে, যার অর্থ তৃতীয়।
তিজ বলতে বোঝায় প্রতিমাসের অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা রাতের পরের তৃতীয় দিনটিকে। এই তৃতীয় দিনটিতে বর্ষাকে স্বাগত জানানো হয় এই উৎসবের মাধ্যমে। বর্ষাকালের মাসগুলিতে তিন ধরনের তিজ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। আর সেগুলো হচ্ছে হরিয়ালি তিজ, কাজরি তিজ, এবং হরতালিকা তিজ। তিজের বর্ষাবরণ উৎসব মূলত দেবাদিদেব মহাদেব এবং দেবী পার্বতীকে উৎসর্গ করে করা হয়।

হরিয়ালি তিজ
শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষ তৃতীয়ায় সাধারণত নাগপঞ্চমীর দু’দিন আগে হরিয়ালি তিজ উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে। এই হরিয়ালি তিজ উৎসবের দিন মহিলারা চাঁদের পুজো করেন। এই হরিয়ালি তিজ হচ্ছে সবুজের প্রতীক। আর সেই কারণে এই তিজ উৎসবের দিন অর্থাৎ হরিয়ালি তিজ যাতে শুভ ভাবে উদযাপন করা যায় সেই কারণে মহিলারা সবুজ রঙের পোশাক পরিধান করেন, এছাড়াও হাতে চুড়ি পরেন। এই তিজ উৎসব অনুষ্ঠান পালন করার সময় তাঁরা বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী লোকগান এবং নাচও করেন। আর এইভাবেই ধুমধাম সহকারে হরিয়ালি তিজ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। যেহেতু শ্রাবণ মাসে এই হরিয়ালি তিজ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে সেহেতু এই তিজ উৎসবটি ‘শ্রাবণ তিজ’ নামেও পরিচিত।

কাজরি তিজ
রাখিবন্ধনের তিনদিন পরে এবং কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর পাঁচদিন আগে এই কাজরি তিজ (Teej) উৎসবটি পালন করা হয়। উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতে আলাদা আলাদা সময়ে এই কাজরি তিজ উৎসবটি পালন করা হয়। এই কাজরি তিজ উৎসবটি উত্তর ভারতীয় ক্যালেন্ডার অনুসারে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের সময় পালন করা হয়। এবং দক্ষিণ ভারতীয় ক্যালেন্ডার অনুসারে শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের সময় পালন করা হয়ে থাকে। এই কাজরি তিজ উৎসবের বিভিন্ন আচার এবং ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিম গাছের পুজো করা। এই নিম গাছের পুজো পবিত্র পুজো বলে মনে করা হয়। এই পুজো উপলক্ষে মহিলারা রাধা এবং সখী হিসাবে নাচ-গান করে থাকেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসা করার জন্য এই গান ও নাচ করা হয়। এই কাজরি তিজ বদি তিজ নামেও পরিচিত।

হরতালিকা তিজ
এই হরতালিকা তিজ ব্রত পালন করা হয় ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষ তৃতীয়ার সময়। হরিয়ালি তিজের একমাস পরে পালন করা হয়ে থাকে হরতালিকা তিজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই হরতালিকা তিজ গণেশ চতুর্থীর একদিন আগে উদযাপন করা হয়ে থাকে। হিন্দুশাস্ত্রমতে এই হরতালিকা তিজকে সবথেকে বড় তিজ বলে মনে করা হয়। হরতালিকা তিজ নামক এই ব্রতর দিন মহিলারা নির্জলা উপোস করে থাকেন। মনে করা হয় এই উপবাস পালন করলে জীবনে সৌভাগ্য নেমে আসে। আর বিবাহিত মহিলারা স্বামীদের দীর্ঘ জীবন আর সুখী দাম্পত্য জীবন লাভের জন্য করে থাকেন। অবিবাহিত মেয়েরাও এই ব্রত পালন করে থাকেন। কারণ মনে করা হয় যে অবিবাহিত মেয়েরা এই উপবাস করলে পুণ্য হবে এবং নিজেদের পছন্দমতো বর পাবে। এই দিন মহিলারা ভগবান শিব এবং মাতা পার্বতীর পুজো করে থাকেন। এই হরতালিকা তিজ উৎসবের একমাস আগে থেকেই মহিলারা নিরামিষ খাবার খেয়ে থাকেন। ব্রতর দিন নির্জলা উপোস থেকে পুজো দেন এবং তারপরে স্বামীর পায়ে জল ঢেলে তাঁরা তাদের উপবাস ভঙ্গ করেন।
রীতিমতো বিধান মেনে হরতালিকা তিজ ব্রত পালন করা হয়।
এই তিজ উৎসবে শ্রীগণেশ, ভগবান শিব এবং মাতা পার্বতীর পুজো করা হয়। প্রথমে মাটি দিয়ে এই তিন ভগবানের মূর্তি তৈরি করতে হয়। এরপরে গণেশকে তিলক অর্পণ এবং দূর্বা নিবেদন করা হয়। এরপরে ভগবান শিবকে ফুল, বেলপাতা এবং শমীপত্র নিবেদন করা হয় এবং দেবী পার্বতীকে সাজসজ্জার সামগ্রী নিবেদন করা হয়। এরপর এই তিন দেবতাকে বস্ত্র নিবেদন করার পর হরিতালিকা তিজ ব্রতকথা পড়তে বা শুনতে হয়। এরপরে আরতি এবং ভোগ নিবেদন করা হয়।

তিজের ইতিহাস
ইতিহাস অনুসারে তিজ উৎসবটির নামের পেছনে আছে একটি ছোট্ট লাল রঙের পোকা। যার নাম তেজ। এই পোকাটি বর্ষাকালে দেখতে পাওয়া যায়। আবার পৌরাণিক কাহিনি থেকে যেটা জানা যায় সেটি হল— এই দিনে পার্বতী শিবের বাসভবনে এসেছিলেন। এবং সেখানে তাঁরা মিলিত হন। এই তিজ উৎসব শিব-পার্বতীর পুনর্মিলনের প্রতীক। এই উৎসব স্বামীর মন এবং হৃদয় জয় করার জন্য একজন স্ত্রীর আত্মত্যাগ। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী পার্বতী শিবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য ১০৮ জন্ম কঠোর তপস্যা করেছিলেন। পার্বতী হিসেবে জন্মগ্রহণ করার আগে তিনি ১০৭ বার জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১০৮ বারের জন্মে তিনি পার্বতী রূপে জন্মেছিলেন। শিবের প্রতি ভালবাসা এবং ভক্তি নিয়ে এতগুলো জন্ম তপস্যা করার পর ১০৮তম জন্মে তিনি শিবকে তাঁর স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন। আর এই কারণেই মহিলারা সুখী বিবাহিত জীবন এবং ভাল স্বামী পাওয়ার জন্য এই তিজ উৎসব পালন করে থাকেন।

Latest article