অনবদ্য নাটক গোধূলি গগনে

বদলে যাচ্ছে সময়, সমাজ। বদলে যাচ্ছে পাড়া-সংস্কৃতি। অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে দেখা দিচ্ছে বিস্তর ফারাক। বদল ঘটছে মধ্যবিত্তের দিনলিপির। বাড়ছে চাহিদা। এই বদলে যাওয়া সময়ের জলছবি ধরা পড়েছে রাসবিহারী শৈলুষিকের ‘গোধূলি গগনে’ নাটকে। প্রথমবার মঞ্চস্থ হল জ্ঞান মঞ্চে। পদ্মনাভ দাশগুপ্তর পরিচালনায়। নাটকটি দেখে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ভরপুর একটা জীবন
আট এবং নয়ের দশক। ঘোরলাগা একটা সময়। অপ্রাপ্তি ছিল প্রচুর। আজকের মতো বিলাসিতা ছিল না। ছিল না হাতে হাতে মুঠোফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, রাস্তার দুই ধারে সারি-সারি বহুতল। পাড়ায় পাড়ায় দোকান-বাজার ছিল। ঘরের দোরে ছিল না শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স, সুসজ্জিত ক্যাফে, খাবার প্লেটে পিৎজা, বার্গার। চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে ছিল বিস্তার ফারাক। প্রত্যাশা ছিল সামান্য। প্রাপ্তি ছিল আরও কম। তার মধ্যেই ছিল অফুরান সুখ, নির্ভেজাল শান্তি। মানুষের পাশে ছিল মানুষ। হাতে ছিল কথা বলার মতো সময়। ছিল সুস্থ পাড়া-সংস্কৃতি। বাড়ির সামনে রক। রকে আড্ডা। ফুটবল, রাজনীতি নিয়ে উন্মাদনা। লোডশেডিং, রেডিও, টেলিভিশন। ঘরে ঘরে অ্যান্টেনা। দলবেঁধে স্কুল। বিকেলে ফেরা। সবুজ ছিল মন। নরম মনকেমন, তুমুল আবেগ। বিশেষ কারও একঝলক, লুকিয়ে কথা বলার গোপন আনন্দ। একবুক স্বপ্ন। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। ছোট ছোট সমস্যা। সবকিছু নিয়েই ছিল ভরপুর একটা জীবন। অতি-সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন। ঘোরলাগা একটা সময়। আট এবং নয়ের দশক। তারপর পেরিয়েছে সময়। ঘটেছে বদল। চতুর্দিকে। সেই বদলে যাওয়া সময়ের জলছবি ধরা পড়েছে ‘গোধূলি গগনে’ (Godhuli Gagane) নাটকে। ৬ অগাস্ট প্রথমবার মঞ্চস্থ হল কলকাতার জ্ঞান মঞ্চে। রাসবিহারী শৈলুষিকের প্রযোজনায়।

পরিচ্ছন্নতার ছাপ
এর আগে দলটি মঞ্চস্থ করেছে ‘তঞ্চক প্রবঞ্চক’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘প্লে হাউজ’, ‘বরকতগঞ্জের বকরা’র মতো সফল প্রযোজনা। আমেরিকান নাট্যকার থর্নটন ওয়াইন্ডারের নাটক ‘আওয়ার টাউন’-এর ছায়া অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘গোধূলি গগনে’ (Godhuli Gagane)। নাট্যকার ও নির্দেশক পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। তিনি একসময় ছিলেন টেলিভিশনের সংবাদ পাঠক। বর্তমানে টলিপাড়ার খ্যাতনামা সংলাপ লেখক, অভিনেতা। নির্দেশক হিসেবে এটিই তাঁর প্রথম কাজ। নতুন ভূমিকায় সফল তিনি। মনপ্রাণ ঢেলে নির্মাণ করেছেন নাটকটি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে পরিচ্ছন্নতার ছাপ।

নির্ভেজাল স্মৃতিরোমন্থন
প্রথম দৃশ্যে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রস্তুতি। ছোঁয়া পাওয়া যায় পাড়া সংস্কৃতির। গানের স্কুল, রিহার্সাল। দেখতে দেখতে বুকের বাঁদিকে মোচড়। নাটকের মধ্যে দিয়ে অতীত ফিরে দেখা। নির্ভেজাল স্মৃতিরোমন্থন। টুকরো টুকরো মুহূর্তের কোলাজ। মনকে নস্টালজিক করে তোলে। দেখানো হয়েছে উত্তর কলকাতার একটি পাড়া। যে পাড়ায় বসবাস কয়েকঘর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের। সুখেদুঃখে থাকে একে অপরের পাশে। আজকের দিনে যা বিরল। পাড়ার দুটি পরিবারকে সামনে রেখে সাজানো হয়েছে নাটকের গল্প। ধরা পড়েছে কিশোর-কিশোরী শিবু-এমিলির প্রেম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দুজনের বয়স। সম্পর্ক গড়ায় ছাদনাতলায়। মূল চরিত্রগুলোর পাশাপাশি এসেছে আরও অনেক চরিত্র। সকলেই প্রায় মধ্যবিত্ত। আছেন কথক। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন চরিত্রদের সঙ্গে। সামনে তুলে ধরেন এক-একটি মুহূর্ত, ঘটনা। সাধারণ কাহিনি। পরিবেশনার গুণে হয়ে উঠেছে অসাধারণ।

আরও পড়ুন- জনজাতির প্রথম প্রধান ডুকপাকন্যা, বিস্ময়কর লড়াই সোনমের

রাত জাগা চাঁদ
নাটকটি পুরোপুরি সময়ের দলিল। কখনও কাঁদায়, কখনও হাসায়, কখনও তুমুল ভালবাসায়। সময়ের বদল ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটে সমাজব্যবস্থার। সাধারণ জীবন ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় সাইবার যুগে। পুরোনো বাড়িগুলোর জায়গা দখল করে হাইরাইজ বিল্ডিং। মোবাইলের শব্দে মুছে যায় কয়লা ভাঙার আওয়াজ, পাখির ডাক। আছে জন্ম, আছে মৃত্যু। সমস্তকিছুর সাক্ষী থাকে রাত জাগা সুবিশাল চাঁদ। গোধূলি গগনে। অপরিবর্তনীয়। অতীতে ছিল, আগামী দিনেও থাকবে। আট এবং নয়ের দশক পেরিয়ে নাটকটি শেষপর্যন্ত এসে দাঁড়ায় ২০০০ সালে।

অনবদ্য অভিনয়
অভিনয় এই নাটকের বড় সম্পদ। সুনন্দ স্যারের চরিত্রে মার্জিত অভিনয় করেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। তিনি গানের শিক্ষক। সুখী নন সাংসারিক জীবনে। হতাশা ভুলতে ডুবে থাকেন সুর এবং সুরায়। একটা সময় থাবা বসায় অসুখ। অকালে ছেদ পড়ে জীবনে। স্টেজ ম্যানেজার সুজয় চট্টোপাধ্যায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকটিকে বেঁধে রাখেন। অরুণ সেন চরিত্রে অর্জুন দাশগুপ্ত, খুকুর চরিত্রে শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতীশ ঘোষ চরিত্রে গৌতম পুরকায়স্থ, মিতিলের চরিত্রে শ্রমণা ঘোষ অনবদ্য অভিনয় করেছেন। এমিলি এবং শিবু আছে নাটকের অনেকটা অংশ জুড়ে। বড় শিবুর চরিত্রে শুভজিৎ দাস, বড় এমিলির চরিত্রে নবনীতা দত্তর অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। ছোট শিবু চরিত্রে আকাশ চক্রবর্তী এবং ছোট এমিলি চরিত্রে প্রজ্ঞা যথেষ্ট সাবলীল। এ-ছাড়াও শঙ্করদা চরিত্রে অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীরবাবু চরিত্রে রূপম ভট্টাচার্য, প্রফেসর মাইতি চরিত্রে সুব্রত বসু নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি রেখাপাত করেছেন ওঙ্কারপ্রসাদ ঘোষ। পাগলের চরিত্র তিনি অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর চোখমুখের অভিব্যক্তি, হাঁটাচলা, সংলাপ পরিবেশন দর্শকদের নজর কেড়েছে।

দাঁড় করায় আয়নার সামনে
দৃশ্যনির্মাণ এই প্রযোজনার অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। আলো-আবহ-মঞ্চসজ্জা অনবদ্য। প্রশংসা করতে হয় সুদীপ সান্যাল, পঙ্কজ পাল, শোভন-নারায়ণের। বিবাহবাসরটি প্রাণবন্ত লেগেছে। মৃত্যু-পরবর্তী কল্পলোকের বাসিন্দাদের অংশটা দীর্ঘ। তবে চমকে দিয়েছে কম্পোজিশন। এমিলি-শিবুর চাঁদ দেখার মুহূর্তটি কাব্যিক। গান ও কবিতার ব্যবহার বিভিন্ন দৃশ্য এবং মুহূর্তের সঙ্গে মানানসই। সবমিলিয়ে ‘গোধূলি গগনে’ (Godhuli Gagane) অনবদ্য। দেখার মতো। শুধুমাত্র সময়ের হাত ধরে বর্তমান থেকে অতীতে নিয়ে যায় না, নাটকটি রীতিমতো ভাবায়। দাঁড় করায় আয়নার সামনে।

Latest article