ক্ষত

কালো জিনসের সঙ্গে পুরো-হাতা অলিভ গ্রিন টিশার্ট, চোখে বিস্ময় আর খুশির মিশেল, সায়ক বলে উঠল, ‘‘কী রে? তুই এখানে?”

Must read

দিলীপ মাশ্চরক: গড়িয়াহাট মোড়ের বাঁদিকে একটু গিয়েই রিকি দেখতে পেল সায়ককে। যেখানে ফুটপাথের ওপর পুরনো বইয়ের দোকান, ঠিক তার সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সায়ক। রিকি ড্রাইভারের কাঁধে আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘‘নিখিল, গাড়িটা একটু থামাও।”
শেষ বিকেলের রাস্তায় বেশ ভিড়। নিখিল সামনে-পেছনে দেখতে দেখতে একটু দূরে গিয়ে সাইড করে গাড়িটা থামাল। রিকি গাড়ি থেকে নেমে পিছনদিকে হাঁটতে লাগল। এই জায়গার ফুটপাথটা একটু ফাঁকা।
হাতে একটা বই, সায়ক অন্যমনস্কভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিকিকে দেখতে পায়নি। বোধহয় টোটোর দিকে মনোযোগ ছিল। যখন রিকি হাত দুয়েকের মধ্যে তখন সায়ক দেখতে পেল।

আরও পড়ুন-মেসির হাতেই কাপ দেখতে চায় কাতার

কালো জিনসের সঙ্গে পুরো-হাতা অলিভ গ্রিন টিশার্ট, চোখে বিস্ময় আর খুশির মিশেল, সায়ক বলে উঠল, ‘‘কী রে? তুই এখানে?”
রিকি ঘাড় ঝাঁকাল, ‘‘এখানে নয়, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তোকে দেখলাম, তাই।”
মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে সায়ক বলল,
‘‘তুই কোনদিকে যাবি?” রিকি হাত দিয়ে বাঁদিক দেখাল। সায়ক হাসিমুখে বলল, ‘‘আমিও এদিকেই যাব। চল।”
সায়ক বোধহয় টোটোর দিকে এগোচ্ছিল, রিকি ওর হাতটা টেনে ধরল। তারপর ইশারায় দূরের গাড়িটা দেখাল।
একটু কি ছায়া পড়ল সায়কের মুখে? আলগা ভাবে বলল, ‘‘ও, তোর সঙ্গে গাড়ি আছে? আচ্ছা, আজ গাড়িতেই যাই।”
দুধসাদা এসইউভির এসির মধ্যে সায়ক যেন একটু কুঁচকে আছে। রিকিই মৌনতা ভাঙল , ‘‘তুই এখন কোন কোম্পানিতে আছিস?’’
সায়ক আস্তে আস্তে বলল, ‘‘কোম্পানির নাম বললে তুই বুঝতে পারবি না।’’ আরেকটু থেমে বলল, ‘‘আমি আসলে জলের ফিল্টার বিক্রি করি। আবার আমাদের রিপেয়ারিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। সেরকমই এক জায়গায় যাচ্ছিলাম।’’

আরও পড়ুন-সংখ্যালঘুদের শিক্ষার অধিকার চেয়ে বিশ বছরের লড়াই

রিকি প্রসঙ্গ ঘোরাল। সায়কের হাতের বইটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘‘এটা কী বই?” সায়ক বইটা রিকির দিকে এগিয়ে দিল, ‘‘এদিকে এলে আব্দুলের দোকানে একটু ঢুঁ মারি।” গাড়ির ভেতর অল্প আলোয় রিকি দেখল বইটা পাওলো কোয়েলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’। গুপ্তধনের সন্ধানে যাওয়া একটা ছেলের গল্প।
সায়ক আস্তে আস্তে বলল, ‘‘তোর বর কী করে?” বইয়ের পাতা উলটোতে উলটোতে রিকি বলল, ‘‘ওদের ফ্যাক্টরি তারাতলায়, শ্যাম ইন্ডাস্ট্রিজ। বাড়ি ভবানীপুরে। তুই এখনও বেলেঘাটায় ওখানেই থাকিস?’’
সায়ক হাসল, ‘‘আর কোথায় যাব বল? ওই ভাড়া দিতেই প্রাণান্তকর অবস্থা।”
রিকি বইটা পাশে রাখল। ‘‘মাসিমা, মানে তোর মা এখন কীরকম আছেন?”
‘‘একটু প্রেসারের গন্ডগোল, নাহলে এমনি ভালই আছেন। আমার জন্যে চিন্তা করে করেই প্রেসার,” হাসল সায়ক।

আরও পড়ুন-তিনটি ছোটদের পত্রিকা

‘‘কেন?”
‘‘আমি মাঝখানে উত্তরপ্রদেশ চলে গিয়েছিলাম। বেশিদিন নয়, তিন মাস, তারপরেই চলে এসেছি। মাকে কলকাতা থেকে নড়ানো যাবে না।”
‘‘ভাল করেছিস, মাসিমার তো তুই ছাড়া কেউ নেই।”
সায়ক জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। একটু পরে বলল, ‘‘আমার জায়গা তো পেরিয়ে গেলাম। আমরা যাচ্ছি কোথায়?:”
রিকি হাসল, ‘‘আজ তোর সব কাজ মুলতুবি রইল । আমি যেখানে বলব, সেখানেই যাবি।”
বেশ কয়েকটা রাস্তা ঘুরে রিকির নির্দেশমতো গাড়িটা যেখানে থামে, সেখানে দক্ষিণ কলকাতার একটা অভিজাত রেস্তোরাঁ। সন্ধে হয়ে গেছে, রেস্তোরাঁর বাইরে কমলা রঙের আলো। গাড়ি থেকে নেমে সায়কের গম্ভীর মুখ দেখে রিকি বলল, ‘‘কী হল?” ‘‘সায়ক চাপা স্বরে বলল, ‘‘তোর ড্রাইভারকে আরেকটু এগিয়ে সামনের রাস্তায় গাড়িটা পার্ক করতে বল।”
রিকি জানলার সামনে ঝুঁকে নিখিলকে সামনের রাস্তায় গাড়িটা রাখতে বলে, সায়কের কাছে এসে বলল, ‘‘কী হয়েছে রে?”
সায়ক কিছুক্ষণ চুপ করে গাড়িটার চলে যাওয়া দেখল, তারপর বলল , ‘‘আমি এরকম পশ রেস্টুরেন্টে ঢুকব না। মানে, আমার ভাল লাগে না। তুই যদি রাজি থাকিস, একটু পরে একটা চায়ের দোকান আছে, যেরকম দোকানে আমরা একসময় চা খেতাম…

আরও পড়ুন-মহাসমারোহে অমৃত মহোৎসব, সংখ্যালঘু অধিকাররক্ষা আজও সেই তিমিরে

রিকি বলল, ‘‘চল।”
একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান। ফুটপাথে দোকান হলেও দু’পাশে একটু আড়াল রয়েছে, এই সন্ধেবেলায় একটু আলো-আঁধারি। ভেতরে সরু কাঠের বেঞ্চ পাতা। এই মুহূর্তে কোনও খদ্দের নেই। অনেক আগে শোনা গানের মতো রিকির মনে পড়ল এরকম একচিলতে দোকানে সায়কের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছে সে।
বেঞ্চিতে গুছিয়ে বসে সায়ক বলল, ‘‘তারপর, তোর শ্বশুরবাড়ির গল্প বল শুনি।” রিকি সায়কের হাতে একটা ঠেলা মারল, ‘‘ইয়ার্কি হচ্ছে?” সায়ক হাসতে হাসতে বলল , ‘‘না না, বল না একটু শুনি।”
রিকি কপট গম্ভীরভাবে বলল, ‘‘ওরা সবাই বিজনেসম্যান, তিন ভাই, আমার বরই সবচেয়ে বড়। শ্বশুরের অনেক বয়স, এখন আর বিজনেস দ্যাখেন না। শাশুড়ির খুব দাপট।”
‘‘বাঃ বাঃ”, সায়ক মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগল, ‘‘একেবারে বাংলা সিরিয়াল। বাড়িটা কোথায় যেন বললি।”

আরও পড়ুন-এমপি কাপ: সুজয়, আকাশের হ্যাটট্রিক

‘‘ভবানীপুর। পুরনো বিরাট তিনতলা বাড়ি। চিক দিয়ে ঘেরা বারান্দা, ঘরের ভেতর ঝাড়বাতি, দেউড়িতে গোঁফওলা দারোয়ান… তোর আর কিছু জানার আছে? ‘‘সায়ক প্লাস্টিকের কাপটা রিকির হাতে দিয়ে বলল, ‘‘আরে, রাগ করিস না, চা খা। কতদিন এরকম চায়ের দোকানে আসিসনি বলতো? তোর বর বইটই পড়ে?”
রিকি বলল, ‘‘না, ও বাড়িতে বইয়ের পাট নেই। আমিই গিয়ে কয়েকটা বইপত্র আনিয়েছি। আচ্ছা, ‘অন্বেষণ’ কি এখনও বেরোচ্ছে?’’
‘‘না রে, এখন বন্ধ আছে। প্রেসেও অনেক ধার হয়ে গেছে। দেখি, বইমেলার সময় যদি একটা সংখ্যা বের করা যায়।”
‘‘তুই উত্তরপ্রদেশ গিয়েছিলি কেন?’’
সায়ক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘‘তুই তো কোনও খবর দিসনি। শুভ্রজিৎ আমাকে তোর খবরটা দেয়। আমার মনে হয়েছিল আমাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে, এক্ষুনি।”
আমি উত্তরপ্রদেশে একটা ঠিকাদারি সংস্থার কাজ নিয়ে চলে গেলাম। শহর থেকে দূরে, একটা রিমোট জায়গা। লোকজন খুব কম। সাইটে কাজ হত, আমার ছিল দেখাশোনার কাজ। থাকার জন্যে একটা ঘর দিয়েছিল।”

আরও পড়ুন-নীতি আয়োগের কথা বলে আরতি কটন মিল বিক্রির চেষ্টা

‘‘এই কাজের জন্য উত্তরপ্রদেশ?”
সায়ক রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘হ্যাঁ, কাজটা ভাল নয়। কিন্তু সেটা ফিরে আসার কারণ ছিল না । তোকে বোঝাতে পারব না… এক মাস পর কলকাতা আমাকে টানতে লাগল। বিকেল হলেই আমি অস্থির হয়ে উঠতাম।
এই সব রাস্তা, যেসব রাস্তায় আমি তোর সঙ্গে হেঁটেছি অনেক দুপুর-বিকেল-সন্ধে, সেই সব রাস্তা, পার্ক, ট্রামলাইন আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে লাগল। আমি কাজ ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলাম।”
রিকি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সায়কের দিকে। তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। এই ব্যস্ত ফুটপাথের মধ্যিখানে কি একটা সময় ফিরে এল? ইউনিভার্সিটির সেইসব উজ্জ্বল দিন। তখন কলকাতা নতুন বইয়ের পাতা, প্রতিটি দিনই যেন রঙিন কাগজে মোড়া উপহার। কফিহাউস, অ্যাকাডেমি, নন্দন-চত্বরে লিটল ম্যাগাজিনের আড্ডা, অবিরাম কবিতার স্রোতে ভেসে যাওয়া…। গতজন্মের স্মৃতির মতো, আবছা।
আলোয় ভেসে যাচ্ছে সন্ধের কলকাতা। স্ট্রিট ল্যাম্পের হলুদ আলো এসে পড়েছে দোকানের ভেতরে। একটু অন্যমনস্কভাবে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে আছে এলোমেলো চুলের ছেলেটা। মুখের মধ্যে একটা আলগা বিষাদ জড়িয়ে আছে। অন্য কোনও রেখাও কি রয়েছে? অভিমান, বা অন্য কোনও অপূর্ণতা? রিকির খুব ইচ্ছে হল মাথাটা কাছে টেনে নিয়ে চুলগুলো আরেকটু এলোমেলো করে দেয়। না, কিছুতেই তা হয় না। আমাদের প্রতিদিন জন্ম বদল হয়ে যায়। আত্মবিস্মৃতির প্রান্ত থেকে ফিরে আসে রিকি, নিজেকে সংযত করে। কোথা থেকে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। কলকাতার ফুটপাথে শিউলির গন্ধ? নাকি স্মৃতির ভেতর থেকে আসছে এই গন্ধ। এক আলোকবর্ষ দূরত্ব পার হয়ে হাত বাড়িয়ে সায়কের একটা আঙুল ছুঁল রিকি।

আরও পড়ুন-আপনারাই ঠিক করুন প্রার্থী : অভিষেক

একটু চমকে উঠল সায়ক। তারপর কব্জি উলটে ঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠল, ‘‘আরে, তোর না হয় কোনও কাজ নেই , আমার একটা সার্ভিসিংয়ের ব্যাপারে যেতে হবে। ওঠ ওঠ।”
দোকানের ভেতর আলো আর অন্ধকারের জাফরি।
রিকি মুখ ফিরিয়ে একটু ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দুটোকে মুছে নিচ্ছিল। কিন্তু উঠতে গিয়েই হল বিপত্তি। বেঞ্চের পায়ার কাছে একটা পেরেক উঠে ছিল। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে রিকির গোড়ালির পাশে পেরেকের ধারালো দিকটা বিঁধে গেল।
অস্ফুট আর্তনাদ শুনেই সায়ক রিকির পা-টা বেঞ্চের ওপর তুলে নিয়েছে। রিকির ফর্সা পায়ে টকটকে লাল একটা বিন্দু।
সায়ক বলল, ‘‘তুই পা-টা এরকম ভাবেই রাখ। এক মিনিট।” তারপর দৌড়ে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল ঠিক এক মিনিটের মধ্যেই। তারপর রিকির পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে রক্তের ফোঁটা আঙুল দিয়ে মুছে যত্ন করে একটা ব্যান্ড-এড লাগিয়ে দিল।
একটু একটু শীত পড়ছে কলকাতায়। হ্যালোজেন আলোর চারপাশে হালকা কুয়াশা।
গাড়ির দিকে যেতে যেতে সায়ক বলল, ‘‘জানিস , সুনীল একটা কবিতায় লিখেছেন, ‘পায়ের তলায় কাঁটা, রক্ত বিন্দু / পায়ের তলায় এই সামান্য আদিম বর্ণ, আঃ কী আনন্দ …’

আরও পড়ুন-বেঁচে থাকো ভাষা

কপট রাগে রিকি একটা ঘুসি মারল সায়ককে।
সায়ক গাড়িতে উঠল না। বলল, ‘‘আমাকে অন্য রুটে একটা ক্লায়েন্টের বাড়ি যেতে হবে, তুই চলে যা।” যতক্ষণ গাড়িটা দেখা গেল হাত নাড়তে লাগল।
শুতে যাওয়ার আগে দু’পেগ হুইস্কি অনির্বাণের অনেকদিনের অভ্যেস। বেডসাইড টেবিলে গ্লাস, কাত হয়ে শুয়েছিল অনির্বাণ। রিকি বিছানায় উঠতেই চোখ পড়ল পায়ের দিকে।
‘‘এ কী, পায়ে ব্যান্ড-এড কেন?”
রিকি অস্পষ্টভাবে বলল, ‘‘ওই একটু ছড়ে গেছিল।”
‘‘কোনও ব্যথা নেই তো?”
উপুড় হয়ে নরম বালিশে মুখ গুঁজে মাথা নাড়ল রিকি। ব্যথাটা রয়েছে, তীব্র, কিন্তু পেরেকটা কোথায় বিঁধে আছে মনে পড়ছে না।

Latest article