ওঁকে আজও মানুষ ভরসা করে।
এই রাজ্যের বহু মানুষ আছেন যাঁরা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে শতসহস্র ক্রোশ দূরে থেকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আস্থাশীল। যদিও সমাজের উচ্চকোটির লোকজন ওঁকে পছন্দ করে না। তাই ওঁকে নিয়ে মিম বানায়, ঠাট্টা-তামাশা করে। কিন্তু সমাজ এবং জীবন কি আর সোস্যাল মিডিয়া আর ইলেট্রনিক মিডিয়া দিয়ে মাপা যায়? যারা এতকাল শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলত, সেই তারাই একুশের শহিদ দিবসকে ‘ডিম্ভাত দিবস’ বলে মিম বানাচ্ছে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে একশো দিনের কাজ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা রূপায়ণের কথা বলছেন। এখানেই তফাত গড়ে দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন-বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত ভুট্টাচাষ, মাথায় হাত চাষিদের
আসলে যেটা হয়েছে এ-রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে এলিটিজিমের দুর্গপ্রাচীর খানখান করে দিয়েছেন। তাই গরিব ও সাধারণ মধ্যবিত্ত নিজেদের প্রতিনিধিকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
শুক্রবারের একুশে জুলাইয়ের সমাবেশ দেখতে দেখতে একটা শব্দই মনের দরজায় কড়া নাড়ছিল। অপ্রতিরোধ্য। সত্যিই তিনি অপ্রতিরোধ্য। ৩০ বছর আগের শপথ ছিল, বাংলা থেকে জগদ্দল হার্মাদ শাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তা বাস্তবায়িত হয়েছে একযুগ আগের মহাপরিবর্তনে। আর ২০২৩-এর একুশে জুলাই ধর্মতলায় একটাই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে লক্ষ লক্ষ জনতার সমবেত মহাসমুদ্রে। নরেন্দ্র মোদি সরকারকে দিল্লির তখত থেকে হটানোর। সঙ্গে নেত্রীর সখেদ উচ্চারণ, অনেক হয়েছে আর বিজেপিকে সহ্য করা যাচ্ছে না। শত সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রচারকে হারিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র সাফল্য এখনও টাটকা। কয়েকদিন আগেই জন্ম নিয়েছে ২৬ দলের মহাজোট, ‘ইন্ডিয়া’। তার নামকরণ থেকে শুরু করে রণকৌশল রচনা, দীর্ঘ সময় পেরিয়েও মধ্যমণি সেই তিনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে সমগ্র দেশের পটভূমিতে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সঙ্গে যোগ্য উত্তরাধিকারী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে তিন দশক পরেও সেই অপ্রতিরোধ্য আবেগ, সেই থামতে না-জানা দ্যোতনা।
আরও পড়ুন-কুয়োয় পড়ে গেল ৩ বছরের শিশু, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধারকাজে এনডিআরএফ
১৯৯৩ সালে তিনি উঠে এসেছিলেন পূর্বভারতের এক অঙ্গরাজ্যের বিরোধী নেত্রী হিসেবে। আজ তিনিই প্রায় দেড় দশক একটানা মুখ্যমন্ত্রীর পদ সামলানোর দৌড়ে অবিচল। সঙ্গে আসন্ন চব্বিশের মহারণে ইন্ডিয়া মহাজোটের অন্যতম মুখ। একশো দিনের কাজের টাকা বন্ধ করে বাঙালিকে ভাতে মারার চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি এক জোরালো প্রতিবাদ। তাঁকে ঘিরে এখনও বাঙালির আবেগ উসকে যায় এক লহমায়। অপ্রতিরোধ্য। তিনি আজও অপ্রতিরোধ্য।
আরও পড়ুন-বেঙ্গালুরুতে অনলাইন অ্যাপ বাইকে যৌন হেনস্থার শিকার যুবতী
একুশে জুলাই মানেই শ্রাবণ মাস। বরিষন-মুখরিত সেই সুরে সুর মিলিয়েই অঝোর ধারার ভেসে যায় আবেগ। মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি উপেক্ষা করে এবারও সেই আকাশের দিকে ছোঁড়া নেত্রীর মুষ্টিবদ্ধ হাত। শপথ, সঙ্কল্প ও জেদের বজ্রনির্ঘোষ মিশেল। তাঁর সঙ্গে একযোগে ভিজেও নিজের জায়গা থেকে একচুল নড়েনি জনতা। সব আগের মতো, বদলায়নি কিছুই। নিটোল ফ্রেমে বাঁধানো ছবি যেন। এই জনসমর্থনের প্লাবনকে রুখতে না পেরে নিজের অজান্তেই একদল হার্মাদ কখন যেন খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছে ১২ বছর আগে। সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটেও অযুত মিথ্যে ছড়িয়েও তারা খুঁজে পায়নি কূল। শেষ হয়নি তাদের গত দেড় দশক ধরে ক্রমাগত রক্তক্ষরণও। পাশাপাশি এবার গেরুয়া জনসমর্থনেও ভাটা। পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরে তৃণমূল পেয়েছে ৫২ শতাংশ ভোট। দূরবিন দিয়ে দেখতে কষ্ট হয় ক্লাসের দ্বিতীয়কে। ব্যবধান ৩০ শতাংশ। আবেগ আর মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগ ছাড়া অন্য কোনওভাবে এই ফল কোনও দিন সম্ভব? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো জোড়া ফুলের অন্ধ বিরোধিতাসর্বস্ব রাজনীতিকরা!
আরও পড়ুন-কুয়োয় পড়ে গেল ৩ বছরের শিশু, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধারকাজে এনডিআরএফ
এবারও কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ, দূরদূরান্তের জেলা থেকে জনতার দল বেঁধে পায়ে পা মিলিয়ে রাজপথে ঢেউ তোলা— সবই আছে আগের মতো। কে বলবে মধ্যিখানে কেটে গিয়েছে তিন দশক! সময় ও ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে সামনে এসেছেন আরও অগ্নিশুদ্ধ হয়ে। ইস্পাত-কঠিন মন এবং হার না মানা সাহস, দুই-ই তাঁকে করে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য, অনবদ্য, তুলনারহিত। পুলিসের অত্যাচার, রাজপথে ফেলে মার। আবার কখনও বিজেপির সংগঠিত আক্রমণ, ৩৫৫ ধারার ‘পরিবেশ তৈরির’ মিথ্যে আস্ফালন। চক্রান্ত। সেসব ব্যর্থ করে দিয়ে চব্বিশে বিজেপি সরকারের এক দশকের ব্যর্থতা ও মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনিই সামনের সারির অগ্নিময়ী ‘স্ট্রিট ফাইটার’।
আরও পড়ুন-দেশের লজ্জা বিজেপির মণিপুর, আরও এক ভয়ঙ্কর ঘটনা চেপে যায় বিজেপি সরকার
১৯৯২-এর ২৫ নভেম্বর ব্রিগেড সমাবেশে বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর ঐতিহাসিক সমাবেশের পরই শাসকবাবুদের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। ফলে একুশে জুলাই বাড়তি সতর্ক ছিল আলিমুদ্দিন থেকে রাইটার্স। সেই মতোই মেয়ো রোড থেকে ব্র্যাবোর্ন রোড পেরিয়ে হাওড়া ব্রিজ— সর্বত্র শুধু মানুষের কালো মাথা দেখেই সেদিন অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ পুলিস। বিনা প্ররোচনায় চলে লাঠি, গুলি। ঝরে গেল ১৩টি তরতাজা প্রাণ।
আরও পড়ুন-দেশের লজ্জা বিজেপির মণিপুর, আরও এক ভয়ঙ্কর ঘটনা চেপে যায় বিজেপি সরকার
সেই ইতিহাস গেরুয়া পক্ষ ভালমতোই জানে। আর জানে বলেই, বাংলায় অরাজকতা তৈরি করে ৩৫৫ জারির জন্য তারা মরিয়া।
এই আবহেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপ্রতিরোধ্য।
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে চোখে দেখিনি, আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি।
জয়তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।