সে এক বিচিত্র ভুবন।
সে হল প্রমীলাদের দেশ।
সেখানে ‘মেয়েলি’ বলে কাউকে নিয়ে মশকরা করার রেওয়াজ নেই। কাউকে ঠেস দিয়ে কথা বলতে হলে বলা হয়, ‘আপনি অনেকটা পুরুষভাবাপন্ন’। মানে জানতে চাইলে স্পষ্ট উত্তর মেলে, ‘আপনাকে পুরুষের মতো ভীরু ও লজ্জানম্র দেখায়’।
পৌরুষের সঙ্গে ভীরুতা, পুরুষালি ভাবের সঙ্গে লজ্জানম্রতার অন্বয় কস্মিনকালেও আমাদের চিন্তাভাবনার ভুবনে ঠাঁই পায় না। এই ২০২২-এও এমন ভাবনাচিন্তা মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারতে, পুরুষের সঙ্গে এমন অভিধা জুড়ে যেতে, ইতস্তত করে। কিন্তু দেখি, কীরকম অবলীলায়, কেমন সাবলীল ছন্দে, পুরুষ স্বাভাবিকতার বিপ্রতীপ এই ভুবনটি রচিত হচ্ছে এক নারীর হাত ধরে। সেই নারী আবার পরদানশিন সমাজের বাসিন্দা । সেই রচনাকাল আবার ১৯০৫ সাল। নবজাগরণের আলো তখনও বাংলার বুকে স্পষ্ট করে পড়েনি, বেশ আবছা, বেশ অস্পষ্ট।
আরও পড়ুন-কলেজিয়াম বৈঠকের তথ্য প্রকাশ নয় : সুপ্রিম কোর্ট
জাতীয়তাবাদের ঢেউ তখন উঠেছে বটে, তবে বাংলার জীবনসৈকত তখনও সেভাবে বীচিবিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি। এরকম একটা সময়ে চেনা ছকের বাইরে অবলীলায় পা রেখেছিলেন যে লেখিকা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বইয়ের পরিচিত বলয়ে আজও তিনি উল্লোল উদ্গাতা শক্তিরূপে মান্যতা পেলেন না। অথচ, জন্মেছিলেন আজ থেকে ১৪২ বছর আগে। প্রয়াণের পরও দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় ৯০ বছর। তাও তিনি খানিকটা উপেক্ষিতাই রয়ে গেলেন।
যে বইতে ওরকম একটা রমণী রসিত জগৎ, ‘লেডিল্যান্ড’, বর্ণিত, সেই বইয়ের খাঁজে ভাঁজে অন্য বিস্ময়, অনন্য কল্প-উদ্ভাস।
সারার হাত ধরে লেডিল্যান্ডে ঘুরে বেড়ান কাহিনির কথক, লেখিকার অন্তর্নারী। বিস্ময় লেপ্টে যায় ঘোরার অভিজ্ঞতায় । তিনি লেখেন, ‘I found no smoke, nor any chimney either in kitchen, it was clean and bright ; the windows were decorated with flower garlands. There was no sign of coal or fire.
How do you cook? I asked. With solar heat, she said, at the same time showing me the pipe, through which passed the concentrated sunlight & heat.’
আরও পড়ুন-মেসি মার্টিনেজই শেষ চারে তুলল আর্জেন্টিনাকে
সৌরশক্তির সৌজন্যে পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরের কথা লেখা হচ্ছে যখন, তখন বাংলার ঘরে-ঘরে মায়েরা-স্ত্রীরা কয়লা কিংবা কাঠের উনুনে আঁচ ধরাতে সাশ্রুনয়না। আর ভারতের ইতিহাস বলছে, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়, অর্থাৎ ১৯৬১-’৬৬ সালে এদেশে সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার নিয়ে আলোচনার শুরু। সোজা কথায়, লেডিল্যান্ডের চিন্তাভাবনা সমকালের চেয়ে কিছু না হলেও পঞ্চাশ বছর এগিয়ে ছিল। অর্ধ শতাব্দীর উল্লম্ফন স্পষ্ট এক পরদানশিন মুসলমান মহিলার ভাবনায়।
এখানেই শেষ নয়।
লেডিল্যান্ডে লগ্ন অন্য আশ্চর্যও।
সেই নারীস্থানে পুরুষ অন্তঃপুরবাসী। গৃহবন্দি। কারণটা খুব পরিষ্কার। পাগলের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য যেমন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষজন উন্মাদদের পাগলা গারদে পোরে, সেই যুক্তিতেই নারীস্থানে পুরুষের জায়গা গৃহাভ্যন্তরে। ‘পুরুষেরা নানা প্রকার দুষ্টামি করে, বা অন্তত করিতে সক্ষম, তাহারা দিব্য স্বাধীনতা ভোগ করে, আর নিরীহ কোমলাঙ্গী অবলারা বন্দিনী থাকে’, এটা চলতে পারে না বলেই নারীস্থানে পুরুষরা অন্তঃপুরের বাইরে আসতে পারে না। কাহিনির কথক নিশ্চিন্তে লেখেন, ‘You need not be afraid of comming across a man here. This lady land free from sin and harm.’
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় পেশ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল, তৃণমূলসহ বিরোধীদের ক্ষোভের মুখে সরকার
এহ বাহ্য!
নারীস্থানে আকাশে এরোপ্লেন ওড়ে। তাতে চেপে মেয়েরা এখান-ওখান দ্রুত যাতায়াত করে। আর এসব যিনি লেখেন, সেই মুসলমান নারী নিজে প্লেনে চেপেছেন লেখাটি প্রকাশের আড়াই দশক পর। ১৯০৫-এ প্রকাশিত হয় ‘আ সুলতানাজ ড্রিম’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’। আর সেই বইয়ের লেখিকা বেগম রোকেয়া একটা ছোট্ট হেলিকপ্টারে চড়ার সুযোগ পান ১৯৩০ সালে। সেটাই তাঁর প্রথম আকাশচারী হওয়ার অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা লাভের পর তিনি লেখেন, ‘২৫ বছর পুর্বে লিখিত সুলতানার স্বপ্নে বর্ণিত বায়ুযানে আমি সত্যিই বেড়াইলাম।’ তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘সুলতানার স্বপ্ন যখন লিখেছিলাম তখন এরোপ্লেন বা জেটপ্লেনের কোনও অস্তিত্ব ছিল না’। সুলতানার স্বপ্ন লেখা হচ্ছে ১৯০৫-এ। আর তার ২৭ বছর পর, ১৯৩২-এর অক্টোবরে প্রথম করাচি থেকে মুম্বই ফ্লাইট সাধারণের ব্যবহারের জন্য আকাশে ওড়ে। সৌজন্যে টাটা এয়ার সার্ভিসেস।
এরকম একটা পুরুষশাসিত, বিমানবর্জিত, সৌরশক্তির স্পর্শরহিত রান্নাঘর পরিবেষ্টিত প্রতিবেশে রোকেয়া অক্লেশে লেখেন, নারীস্থান বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে জল উৎপাদন করে। এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পেছনে রয়েছে লেডিল্যান্ডের মেয়েদের মেধা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতার অত্যুঙ্গ প্রকাশ।
আরও পড়ুন-সেই মেসিই আজ ভরসা, রণকৌশল তৈরি ভ্যান গলের
তবু, তবুও, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কল্পবিজ্ঞানের জ্যঁরে জগদানন্দ রায়ের ‘শুক্র ভ্রমণ’ কিংবা জগদীশচন্দ্র বসুর ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’ বা ‘অব্যক্ত’ যে গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়, ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বঙ্গসাহিত্যের ঐতিহাসিক বৃত্তে উল্লিখিত হলেও সেই গুরুত্বে বিশ্লেষিত হয় না।
আজও হয় না।
লেখিকার জন্মের পর ১৪২ বছর কেটে গেলেও। প্রয়াণের পর ন’টি দশক অতিবাহিত হলেও।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সুকুমার সেন— কেউই তাঁদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বইয়ে বেগম রোকেয়াকে যথাযোগ্য জায়গা ছেড়ে দেননি। এ-বিষয়ে লক্ষণীয়ভাবে ব্যতিক্রমী হলেন ক্ষেত্র গুপ্ত। তাঁর লেখা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বইয়ে বেগম রোকেয়ার প্রসঙ্গ যথোচিত মর্যাদা সহকারে আলোচিত।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রতিবাদে আজ থেকে পথে শ্রমিকরা
একটা সুন্দরতর আগামীর ছবি। তাতে প্রগতিশীলতার মনস্বিতা দ্যোতিত একধিক বিন্দুতে। পুরুষতান্ত্রিকতার নিগড় খসে পড়া সময়। সূর্য সেখানে শক্তি জোগায়। হাওয়াকল জল এনে দেয়। আকাশে ওড়ে বিমান। মেয়েরা তাতে যাতায়াত করে। এতকিছু। কিন্তু কোনও কিছুই ধরা পড়ল না বঙ্গলোকের বিদগ্ধ চোখে! ভারি আশ্চর্য!
এমন বিস্ময় আবেশ জারিত করে এক বেদনা বেদনকে। মনে হয়, এটা বেগম রোকেয়ার পাওনা ছিল না।
যেখানে বড় হয়েছেন সেখানে স্ত্রীশিক্ষা বলতে বোঝাত ‘টিয়া পাখির মতো কোরান শরীফ’ পাঠ, নামাজ, রোজা আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান। এছাড়া স্বামী বা নিকট আত্মীয়কে চিঠি লিখতে পারা, দু-একটি উর্দু-ফারসি পুঁথি পুস্তক পড়ার ক্ষমতা, সেলাই, রান্না এসবের মধ্যেই আটকা পড়েছিল। তখন মেয়েদের বাংলা শেখাটাই ছিল অনেকটা নিষিদ্ধ। এমন সামাজিক আবহে বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা একটু আধটু বাংলা পড়েছিলেন। ছদ্মনামে বেশ কয়েকটা কবিতাও লিখেছিলেন। দিদিকে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। দাদা-দিদিদের সাহায্যে বাংলা শিখেছিলেন।
আরও পড়ুন-ঘুষ নেওয়ায় ধৃত সরকারি কর্মী
বিয়ে যখন হল, তাঁর বয়স তখন সবে ষোলো। আর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের বয়স তখন ৩৮। দ্বিগুণের বেশি বয়সি স্বামীও উর্দুভাষী। বাংলা শিক্ষার প্রবল বিরোধী। রোকেয়া স্রোতের উল্টোদিকে হাঁটলেন। স্বামীকেই বাংলা শেখাতে বসলেন। বাংলা ভাষার চর্চা বজায় রাখার জন্য তাঁকে যে দারুণ লড়াই লড়তে হয়েছিল তার বর্ণনা ‘মতিচূর’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের করিমুন্নেসার নামে উৎসর্গপত্রে রয়েছে। সেখানে রোকেয়া তাঁর আপাজানকে উদ্দেশ্য করে লিখছেন, ‘আমি শৈশবে তোমারই স্নেহের প্রসাদে বর্ণপরিচয় পড়িতে শিখি। অপর আত্মীয়গণ আমার উর্দু ও পারসি পড়ায় তত আপত্তি না করিলেও বাঙ্গালা পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাঙ্গালা পড়ার অনুকূলে ছিলে।’ করিমুন্নেসার ভয় ছিল, বিয়ের পর হয়ত রোকেয়া অবাঙালি প্রতিবেশে বাংলা ভাষা একেবারে ভুলে যাবে। সেটা হয়নি। রোকেয়া ওই উৎসর্গ পত্রে লিখছেন, ‘চৌদ্দ বৎসর ভাগলপুরে থাকিয়া বঙ্গভাষায় কথাবার্তা কহিবার একটি লোক না পাইয়াও’ বাংলা ভাষাটা তিনি ভোলেননি। আড়ালে নিরবচ্ছিন্ন চর্চা করে গিয়েছেন। এর পর কলকাতায় এসে স্কুল চালিয়েছেন। এগারো বছর ধরে উর্দু স্কুলের দায়িত্ব সামলিয়েছেন। সেই স্কুলে শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী থেকে শুরু করে ছাত্রীর দল, সবাই উর্দুভাষী। ‘প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি পর্যন্ত উর্দু ভাষাতেই কথা কহিতে হয়।’ তাও রোকেয়া বাংলা ভাষা ভোলেননি। বাংলা চর্চা বজায় রেখেছেন।
আরও পড়ুন-দ্রুত গোল পেতে চাইবে নেইমাররা
এসব শুনলে, পড়লে, জানলে টের পাই, উর্দুর বিরুদ্ধে যে লড়াই, যে ভাষা সংগ্রাম ২১ ফেব্রুয়ারির রক্ত মেখে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত গড়েছিল, তার সিমেন্ট-বালি এসেছিল রোকেয়ার জীবন থেকে। অথচ, বাংলা ভাষার লড়াইয়ের কথা বলতে বসলে আমরা রোকেয়াকে ভুলে যাই। বাংলা ভাষা নিয়ে সংগ্রামের লিখিত পরিধিতে আমরা রোকেয়াকে খুঁজে পাই না।
জন্মদিন মৃত্যুদিন একই তারিখে। ৯ ডিসেম্বর। একটা ১৮৮০-তে। আর একটা ১৯৩২-এ। জন্মের পর প্রায় ১৪২ বার ঋতু পরিবর্তন দেখল পৃথিবী। প্রয়াণের পর ৯০ বার। তবু রোকেয়াকে ঘিরে আমাদের বৌদ্ধিক শীত যেন কাটতেই চায় না।
এই শৈত্যপ্রবাহে একচিলতে রোদ্দুর যেন আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। বেগম রোকেয়া আর ভগিনী নিবেদিতাকে পাশাপাশি বসিয়েছিলেন তিনি। লিখেছিলেন, ‘নিবেদিতার কর্মক্ষেত্র আরও ব্যাপক ছিল; তিনি মুখ্যত ছিলেন সেই ভারতের যে ভারত নিজেকে বিশ্বের মধ্যে ছড়াইয়া দিয়াছে; আর রোকেয়া মুখ্যত ছিলেন সেই ভারতের, যে ভারত সংসারের মধ্যে গৃহকোণে নিজের নীড় বাঁধিয়া রাখিয়াছেন।’
আরও পড়ুন-১৫ বছর পলাতক থাকার পর দিঘা থেকে গ্রেফতার খুনি
কবীর সুমনের বাঁধা গানে বোধহয় এই মহীয়সীকে কিছুটা হলেও ধরা যায়, একটু হলেও চেনা যায়, খানিকটা হলেও প্রণতি জানানো যায়।
‘অবরোধ খোলা, প্রতিরোধ তোলা/লেখাপড়া শেখা, খোলা মনে দেখা/যেভাবে আপনি দেখেছেন/
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
শালীনতা থাক, অবরোধ যাক/গ্রামের মেয়েটা, সাহস পাক
বই তুলে নেয়া, স্কুলে নাম দেয়া/বিজ্ঞানে যাওয়া , এগোতেই চাওয়া/যেভাবে আপনি এগিয়েছেন/বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।…
মেয়েদের স্কুল ডুমুরের ফুল/সে ফুলের টানে বাতাস আকুল/কাহিনি লেখিকা, প্রবন্ধটাও/যুক্তি তর্কে কলমখানাও, আপনি শানিয়েছেন/বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।’