কলকাতা বদলাচ্ছে। কলকাতার উন্নতি এখন অনুভববেদ্য। পরিষেবার উন্নতির সমান্তরালে সৌন্দর্যায়ন, সবকিছুই অব্যাহত। আপন অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার
আমার কৈশোর বা যৌবনে দেখা কলকাতা অর্থাৎ আশি বা নব্বইয়ের দশকের কলকাতা আর আজকের কলকাতার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
সেসময় ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো জঞ্জাল। যত্রতত্র আস্তাকুড়ে দিনের পর দিন আবর্জনার স্তূপ জমত, পচত, দুর্গন্ধ ছড়াত। বর্ষাতে সেই জমা জঞ্জাল ড্রেনের মুখে জমত। রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে থাকত দিনের পর দিন। আমার ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনসের বাড়ির সামনেও জল জমত। মনে আছে, আমরা বুকজল ঠেলে গড়িয়াহাটে বাজার করেছি। বর্ষা তো নয়, তখন যেন বিভীষিকা! তবে এখন সেসব অতীত।
শহরে সর্বত্র পর্যাপ্ত আলো ছিল না। ফলে রাতের বেলায় বিভিন্ন অঞ্চলে অসামাজিক কাজকর্মের আবহ তৈরী হত। সাধারণ মানুষ এরই মধ্যে ট্রামে বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাতায়াত করতেন। দুর্ভোগের অন্ত ছিল না।
আরও পড়ুন-নতুন বিদেশি নিয়ে ধীরে চলো নীতি, ইস্টবেঙ্গলে শুরু হচ্ছে যোগা ক্লাস
এখন এসব ফেলে আসা দুঃস্বপ্ন। রাস্তাঘাট ভালো হয়েছে। গণপরিবহণে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোগান বেড়েছে, গতির সাথে পাল্লা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে। ফলে, যাতায়াত সহজ হয়েছে, যাতায়াত করতে সময় কম লাগছে। আধুনিক গার্বেজ ডিসপোজাল প্ল্যান্ট বসেছে শহরের বিভিন্ন জায়গায়। এর ফলে শহরের রাস্তাঘাট অনেক পরিষ্কার পরিছন্ন হয়েছে, শহরের অনেকাংশে জল জমলেও তা নেমে যাচ্ছে দ্রুত। এখানে একটা কথা বলা দরকার, কলকাতা তিনশো বছরেরও পুরনো শহর , তাই জল নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। এটা কোনও চটজলদি সমাধানে সেরে যাওয়ার বিষয় নয়। একদিকে খাল এবং অন্যদিকে ভুগর্ভস্থ পাইপ লাইনের সংস্কার, একটি সময়সাপেক্ষ কাজ যা আগামীতে যদি এঁরা ফিরে আসেন, তাহলে অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই, এই পৌরপ্রশাসকমন্ডলী দ্বারাই তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে, এতে কোন দ্বিমত নেই।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবার এমপি কাপ, ফলতায় ম্যাচ উদ্বোধনে প্রাক্তনরা
আমি কর্মসূত্রে কয়েকবার লন্ডন গেছি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কলকাতাকে লন্ডনের মতো গড়ে তোলার ইচ্ছা সর্বজনবিদিত। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, লন্ডনে খুব সুন্দর সুন্দর কিছু পার্ক আছে। এগুলির থেকে আমাদের এই ঢাকুরিয়া লেক কোন অংশে কম নয়। শহরে আরও বেশকিছু জলাশয় আছে। যেমন সুভাষ সরোবর। এগুলি পুরসভার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমি প্রায়শই প্রাতঃভ্রমণ করতে ঢাকুরিয়া লেকে যাই। অব্যবস্থার কোন ছাপ চোখে পড়ে না। বরং এখানে নির্দিষ্ট সময়ের পর আর কেউ ঢুকতে পারে না। তাই কোনও অসাধু ক্রিয়াকলাপ মাথা চাড়া দিতে পারে না, তার জন্য সাধুবাদ জানাই কলকাতা কর্পোরেশনকে ।
আরও পড়ুন-চোট, টেস্ট সিরিজে নেই রোহিত
আমাদের এই ইতিহাসসমৃদ্ধ শহরের ঐতিহ্যময় বাড়িগুলির সংরক্ষণেও কলকাতা পুরসভা যে অত্যন্ত যত্নশীল তার প্রতিফলন এখনকার নয়নাভিরাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। বলা বাহুল্য, এসবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ সুদৃশ্য আলোকস্তম্ভে উদ্ভাসিত রাজপথ থেকে গলিঘুঁজি। শহরের সর্বত্র শুধুমাত্র রক্ষনাবেক্ষণ নয়, প্রকারান্তরে মানুষের সুরক্ষা নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও কলকাতা কর্পোরেশন প্রশংসার দাবি রাখে।
আসলে এই সবকিছুই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ এই নাগরিক পরিষেবা প্রদানের জন্য কলকাতা পুরসভাকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়।
এই টাকা আসে কীভাবে?
আরও পড়ুন-লড়ব-জিতব-করব, বিজেপির বিকল্প তৃণমূল কংগ্রেস
অবশ্যই আমার আপনার দেওয়া সম্পত্তি কর হিসাবে প্রাপ্ত অর্থ থেকে। এই সম্পত্তি কর দেওয়ার পদ্ধতিকে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত বর্তমান পুর প্রশাসন অনেক সহজ করে দিয়েছেন। চালু হয়েছে ইউনিটারি এরিয়া অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেম। ফলে, কর আদায় সহজ হয়েছে। নাগরিক পরিষেবার বিভিন্ন খাতে আদায়ীকৃত অর্থ খরচ করা সম্ভব হয়েছে যা কলকাতা পুরসভার সার্বিক কাজকর্মকে সচল রেখেছে, উজ্জ্বলতর করেছে।
পূর্বতন সরকারের আমলে এই কর ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে একটা ইন্সপেক্টর রাজ প্রায় পুরো মাত্রায় বহাল ছিল। সহজভাষায় বললে, আমার একটি জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে। আমি সেই সম্পত্তির নির্ধারিত মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পত্তি কর জমা করব। এখন সেই সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ করতে আমার জমি,বাড়ি বা ফ্ল্যাট দেখতে আসবেন একজন ইন্সপেক্টর। এখন আমি যদি সেই ইন্সপেক্টরকে চা মিষ্টি সহযোগে ‘খুশি’ করতে পারি, তবে তিনি আমার সম্পত্তির মূল্য কমিয়ে দেবেন, ফলে আমার এবং সেই ইন্সপেক্টরের লাভ হবে ঠিকই কিন্তু বিশাল ক্ষতি হবে কর্পোরেশনের। এখানে এই অনুশীলনই বহুদিন ধরে চলছিল। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কলকাতা কর্পোরেশন ‘ইউনিট এরিয়া অ্যাসেসমেন্ট’ বলে একটি নতুন পদ্ধতি চালু করে। এর ফলে আমরা যেভাবে আয়কর প্রদান করি, ঠিক সেভাবে আমরাই আমাদের সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে সম্পত্তি কর প্রদান করতে পারব। কলকাতাকে এলাকার ভিত্তিতে কয়েকভাগে ভাগ করা হয়েছে একটি রেট চার্টের মাধ্যমে। যেমন বড়বাজার বা ধর্মতলা এলাকা হলে স্বভাবতই মূল্য বেশি হবে, আবার সুদূর বেহালা হলে কম হবে।
আরও পড়ুন-টক টু এমএলএ দ্বিতীয় পর্ব শুরু
এই চার্টের মাধ্যমেই করদাতা নিজের সম্পত্তির অবস্থান অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করেন এবং নিজেকেই সেই নির্ধারিত মূল্যের ভিত্তিতে কর প্রদান করতে হয়। পুরোনো প্রক্রিয়াটির সাথে এই নতুন কর প্রদানের প্রক্রিয়াটিকে ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে। অচিরেই এই নতুন সহজ পদ্ধতিতে করদাতারা অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অভ্যস্ত হয়ে উঠবেনও। মাঝে মাঝে ইউনিট এরিয়ার একটা নমুনা পরীক্ষা হবে ঠিক যেমনটা আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে করা হয়, করদাতারা সঠিকভাবে কর দিচ্ছেন কিনা সেটা দেখার জন্য। ফলে সামগ্রিকভাবে এই কর ব্যবস্থায় একটা স্বচ্ছতা এসেছে যা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর করেছে কলকাতা পুরসভাকে।
আরও পড়ুন-আধার না মিললেও মিলবে রেশন
আগামীতে এই স্বনির্ভরতা এই উদ্যমী প্রশাসকমন্ডলীকে বাড়তি অক্সিজেন যোগাবে এবং কলকাতাবাসীকে আরও অত্যাধুনিক নাগরিক পরিষেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে।
এক কথায়, কলকাতা পুরসভার সৌজন্যে কলকাতা গত এক দশকে অনেক বদলেছে। অনেক উন্নত হয়েছে। আগামীতেও এই উন্নতির ধারাই অব্যাহত থাকবে। সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।