ঘটনার ঘনঘটায় মোড়া রুদ্ধশ্বাস জীবন ক’জনেরই বা হয়। ভয়কে পায়ে মাড়িয়ে জয়ধ্বজা ওড়াতে পেরেছেন এমন মানুষ তো হাত- গুনতি। হার না মানার লড়াইয়ে শামিল হলেই তাঁকে নিয়ে গল্প লেখা হয়। বড় অদ্ভুত শর্ত জীবনের। সুন্দরবনের রীতা মণ্ডল তেমনই এক নারী। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী
আরও পড়ুন-গণিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন বাংলার নীনা গুপ্ত
কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। বাঘে ছুঁয়েছিল রীতা মণ্ডলের স্বামী শ্রীনাথ মণ্ডলকে। আর ফেরেননি তিনি। শ্রীনাথের রক্তে মাখা পোশাকটুকুই পেয়েছিলেন রীতা আর তাঁর পরিবার। সুন্দরবন এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অধিকাংশ মানুষ তাঁদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করেন জঙ্গলে মধুসংগ্রহ করে এবং মৎস্যজীবীরা তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করেন মিন এবং কাঁকড়া ধরে। গভীর গহন ম্যানগ্রোভের অরণ্যে জীবনের ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা কখনও তিনদিন, কখনও চারদিন কখনও বা তারও বেশি সময়ের জন্য বেরিয়ে যান দলবেঁধে মাছ আর কাকঁড়া ধরতে। লাঠিসোঁটা থাকলেও শ্বাপদসঙ্কুল গহীন বনে বিপদে পড়তে মুহূর্ত লাগে না।
আরও পড়ুন-দুর্গোৎসব আজ বিশ্বজনীন
রয়্যাল বেঙ্গলরা ওঁৎ পেতে থাকে শিকারের আশায়। আধুনিক যুগে মানুষ নিজের প্রাণের পরোয়া না করে তাকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে। সেই অপমান সইতে পারে না বনের রাজা। কোর এরিয়া অর্থাৎ ঘন জমাট ভয়াল অরণ্যভূমি যেখানে একেবারেই যাওয়া বারণ সেখানে ঢুকে পড়ে এই মিন আর কাঁকড়া ধরা মৎস্যজীবীর দল। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে চোরা নদী-খাঁড়ি পথ ধরে এগোতে গিয়ে আচমকা শিকার হয়ে যান তাঁরা অনেকেই। শ্রীনাথ মণ্ডলের পরিণতি অনেকটাই এমনতর হয়েছিল। সুন্দরবনের মথুরাখণ্ডের মেয়ে রীতা মণ্ডলকে বিয়ের পর থেকেই কম-বেশি শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার সহ্য করতে হত। বহুবার অনুনয় করেছিলেন স্বামীকে জঙ্গলে না যেতে।
আরও পড়ুন-Firhad Hakim: “টক টু মেয়র” এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, এবার লক্ষ্য আরও স্বচ্ছ প্রশাসন
অনিশ্চিত, দুশ্চিন্তার এই পেশা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন তিনি। কলকাতায় গিয়ে বসবাস করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। চেয়েছিলেন স্বামী কোনও কাজ কারবার জুটিয়ে সেই অর্থেই দুই সন্তানকে দু’জনে মিলে মানুষ করতে। এমন কথা শোনাও বোধহয় পাপ ছিল শ্রীনাথের পক্ষে। কলকাতায় আসার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি শ্রীনাথ। বরং এই কথা বলার অপরাধে স্ত্রীকে মারধর করছিলেন বেশ কয়েকবার। মেয়ের তখন আটবছর, ছেলের ছ-বছর সাত মাস। ২০১১ সালে এমনই একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন শ্রীনাথ মণ্ডল মিন এবং কাঁকড়া ধরতে। গভীর অরণ্যে যে নিষিদ্ধ, সংরক্ষিত এলাকায় বেপরোয়া পায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। একপা এগোলেই যেখানে ভয়। একমুহূর্তে ঘটে যেতে পারে বিপর্যয়, ঠিক সেখানেই ঘটে গেল অনর্থ। বাঘে আচমকা টেনে নিয়ে গেল শ্রীনাথ এবং তাঁর এক সঙ্গীকে। দেহ পর্যন্ত পাওয়া গেল না তাঁদের। দলের একজন জীবিত ছিল। ভয়ঙ্কর আহত হয়ে ফিরলেন তিনি। সুন্দরবনে এমন ঘটনা অহরহ শোনা যায়। স্বামীর মৃত্যুর মুহূর্ত হতে অথৈ জলে পড়লেন রীতা। একলহমায় তাঁর সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ।
আরও পড়ুন-মহানগরে প্রচারে তৃণমূলের সুনামি
শ্বশুরবাড়িতে শুরু হল ভীষণ অত্যাচার। শ্বশুর-শাশুড়ির মারধর, গালিগালাজ, কটূক্তি দিনে দিনে বাড়তে থাকল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার হুমকি দিতেন তাঁরা। ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী করতেন তাঁরা রীতাকেই। এমতাবস্থায় দিশেহারা রীতা। ছেলেমেয়ে ছোট। এত ভয়ঙ্কর অত্যাচার। পাশাপাশি সংসার অচল। একই বাড়িতে আলাদা অংশে থাকতেন রীতা দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে। খাওয়া কখনও জুটত,কখনও জুটত না। রীতার বোন আর বোনাই এই সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়। সন্দেশখালির আমতুলিতে থাকতেন তাঁর বোন। মেয়েকে সেই বোনের বাড়িতে রেখে আসেন রীতা। নিজের সঙ্গে ছিল ৬ বছরের ছেলে।
আরও পড়ুন-পুর প্রচারে প্রণবপুত্র অভিজিৎ বিজেপি পরাজিত দিদির রাজ্যে
তখন লোকের বাড়িতে ধান রোয়া-ধান কাটা— এইসব কাজ করতেন। কিন্তু এই সবে দিন চলছিল না তাঁর। এরপরেই ছেলেকে নিয়ে সোজা কলকাতা পাড়ি দেন তিনি। রীতার মা থাকতেন তখন কলকাতাতেই। কাজ করতেন লোকের বাড়িতে। ওখানে একটা প্লাস্টিক কারখানায় কাজ জুটে যায় রীতার। মায়ের সঙ্গেই একটা বস্তিতে থাকতে শুরু করেন। ছেলেকে একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও তা বেশিদিনের হয়নি। ওখানে ছেলের পড়াশুনো হচ্ছিল না ঠিকমতো। ছেলেটি কুসঙ্গে পড়ে যাচ্ছিল কারণ কারখানার কাজে দিনের মধ্যে অনেকটা সময় রীতাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হত।
আরও পড়ুন-উত্তরবঙ্গে প্রথম ডিজিটাল পুরসভা
ছেলের স্কুলের পর বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থেকে কু-অভ্যাস ও ভাষা শিখতে শুরু করেছিল। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় রীতার জীবনসংগ্রাম। সেই সন্তানই যদি ভাল করে মানুষ না হয় তা হলে এত লড়াইয়ের মানে কী। এরই মাঝে গ্রামে যেতেন তিনি যাতে শ্বশুরের ভিটে তাঁর হাতছাড়া না হয়ে যায়। যখনই যেতেন, শ্বশুর-শাশুড়ির দুর্ব্যবহার, কুশ্রী আচরণের মুখোমুখি হতে হত। আবার ফিরে যেতেন কলকাতা। প্রায় পাঁচবছর কলকাতায় থাকার পর আবার সুন্দরবনেই ফিরে যান তিনি। মেয়েকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে। সুন্দরবনে তখন বাসন্তীর শিবগঞ্জের বাসিন্দা অমল নায়েকের কথা সবাই জানেন। তিনি পেশায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। যাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ওখানকার দুঃস্থ শিশু এবং মহিলাদের জন্য কাজ করা। তিনি গড়ে তুলেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী, দুঃস্থ শিশুদের স্কুল।
আরও পড়ুন-কারও জন্য দল বিন্দুমাত্র কলুষিত হলে তাঁকে বহিষ্কার স্পষ্ট জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
গড়ে তুলেছেন চম্পা মহিলা সোসাইটি এবং আরও অনেক কিছু। সর্বোপরি ব্যাঘ্রবিধবা মহিলা বা বাঘের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এমন ব্যক্তির স্ত্রীদের জন্য চালু করেছেন নানা উন্নয়নমূলক কর্মসূচি কারণ এইসব মৎসজীবী পরিবার এমনিতেই ভীষণ দারিদ্র্যে জর্জরিত। এরপর তাঁদের অভাবী সংসারে পেট চালানোর লোকটা বাঘের পেটে গেলে জীবিত সদস্যরা আরও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। তাঁদের খাওয়া জোটা মুশকিল হয়ে পড়ে। অমলবাবুর প্রচেষ্টায় এই সময় ব্যাঘ্র-বিধবা মায়েদের মাসিক রেশন, মশারি, চাল, শাড়ি, কম্বল দেওয়া এবং বিভিন্ন উপায় তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলার একটা কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। যার অংশীদার হলেন রীতাও। চম্পা মহিলা সোসাইটির গোসাবা শাখার দায়িত্বে ছিলেন স্বপন মণ্ডল। তাঁর সহায়তায় দশ এগারো জন তাঁর মতো মহিলাদের নিয়ে একটা স্বনির্ভর গ্রুপ তৈরি করলেন রীতা। গ্রুপের নাম ছিল রাইমণি। এই গ্রুপের সম্পাদিকা হলেন রীতা।
আরও পড়ুন-কলকাতা পুরভোট: শেষদিনের প্রচারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শোতে জনজোয়ার
এমন বহু মহিলা গ্রুপ রয়েছে ওখানে। সেখানে তিনি কাজ করলেন, ঋণ পেলেন ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য। এই ঋণ নিয়ে পশুপালন, পুষ্টিবাগান (বাড়ির বাইরে ঋতুভিত্তিক সবজি চাষ), মাছ চাষ এই ধরনের বিভিন্ন কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করলেন রীতা। তাঁর ছেলে এবং মেয়ে— দুজনকেই চম্পা মহিলা সোসাইটির অন্তর্গত অবৈতনিক দুঃস্থ শিশুদের স্কুলে পড়ানোর সুযোগ করে দিলেন স্বপনবাবু। মেয়ে এবং ছেলের টিউশন খরচ লাগত না, ওরা খাওয়াও দিত। বাঘে আক্রমণে মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য কিছু অর্থের ব্যবস্থা রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু রীতা তা পেলেন না কারণ তাঁর স্বামী বিনা অনুমতিতে কোর এরিয়াতে চলে গিয়েছিলেন। কাজেই নিষিদ্ধ অঞ্চলে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ খোওয়ানোর দোষটা তাঁর স্বামীর উপরেই বর্তাল। ইতিমধ্যে মেয়ের বিয়ে দিলেন রীতা। কারণ আঠারো বছর পেরলেই দেশ-গাঁয়ের মেয়ের বিয়ে না হলেই নানা সমালোচনা কটূক্তির সম্মুখীন হতে হয় দরিদ্র বাবা-মাকে।
আরও পড়ুন-Primary Education: প্রাথমিক শিক্ষায় ‘ভারত সেরা’ পশ্চিমবঙ্গ, মমতা সরকারকে স্বীকৃতি মোদি সরকারের
মেয়ে খুব ভাল নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলেও আর পড়ানো সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। কারণ একটা ক্লাসের পর আর পড়াশুনো পুরো অবৈতনিক হত না। তাই মেয়েকে ভাল ঘর আর ভাল বর দেখে পাত্রস্থ করলেন রীতা। কাজের পাশাপাশি মহিলা কো-অপারেটিভে টাকা জমানো শুরু করলেন। ওই অর্থ দিয়ে ভবিষ্যতের নানা পরিকল্পনার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এবার ছেলের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। এদেশে পুরুষ সন্তানের জন্যই বাবা-মায়েরা সব আশা ভরসায় বুক বেঁধে থাকেন।
ছেলেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিয়ে আরও অনেকটা পড়ানোর অদম্য ইচ্ছা তাঁর। কারণ আজও শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার বন্ধ হয়নি যে। ছেলের জন্যই আরও অনেকদিন কাজ করতে চান রীতা। থেমে থাকেননি তিনি, হেরে যাবার মানসিকতাকে নিজের মধ্যে প্রশ্রয় দিয়ে লালন করেননি শুধু মনোবলকে পুঁজি করে এগিয়ে চলেছে। তাঁর বর্তমান লক্ষ্য ছেলেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। সেই লক্ষ্যে অগ্রসরমাণ রীতা। ভবিষ্যতের পথে হয়ত অনেক পরিকল্পনাই তাঁর বাস্তবায়িত হবে, অনেকগুলোই হবে না, কিন্তু থেমে থাকবে না তার পথ চলা।