প্রায় ছয় দশক জুড়ে বড় পর্দায় যিনি দাপটের সঙ্গে বিরাজ করেছেন, সেই অনন্য অভিনেত্রী ছায়া দেবীর কথা ড. শঙ্কর ঘোষ–এর কলমে।
নিঃসন্তান বিধবা আনন্দময়ী। তিন কূলে কেউ নেই। আছে দশ-বারো বিঘা ধানের জমি। আছে পুকুর। শেষ বয়সে এসে সে সব সামাল দিতে গিয়ে দিন শেষ হয়। হঠাৎ করে আনন্দময়ীর কাছে এলেন মন্টু। সম্পর্কে তাঁর ভাগনে। একরকম জোর করে মন্টু তাঁর এই রাগ মামিমাকে কলকাতায় নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখলেন। ভাগনে বউ লতুকেও ভাল লেগে যায় আনন্দময়ীর। আসল উদ্দ্যেশ্যটা পরে জানতে পারেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই সেখানে চাকরিজীবী, সেখানে তাঁদের সন্তানকে সারাদিন দেখভালের জন্যই রাগ মামিমাকে নিয়ে আসা হয়েছে। বাচ্চা কোলে নিয়ে পার্কে মাঠে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরতে আনন্দময়ীর ভালই লাগে।
আরও পড়ুন-অবিচলিত
অনাথ দুটি বাচ্চার সঙ্গে আলাপ হয়। পাড়ার শিক্ষিত বেকার সন্তান রবি ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গেও পরিচয় হয়। অনাথ একটি বাচ্চাকে বাড়িতে নিয়ে এসে খাওয়ানোর সময় লতু ও মন্টু অফিস থেকে ফেরেন। লতু চূড়ান্ত অপমান করে বসেন রাগ মামিমাকে। তিনি এ অপমান সইতে না পেরে অনাথ বাচ্চাটিকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। রবি তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। রবিদের সৎপথে আসার অনেক উপদেশ দেন আনন্দময়ী। কিন্তু রাজনৈতিক জাঁতাকলে কে শোনে কার কথা। প্রতিপক্ষ দলের ছেনোর সঙ্গে মারদাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।
এদের থামাতে এসে ছেনোর বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে এসে লাগে আনন্দময়ীর বুকে। পুলিশ, ডাক্তার সব হাজির। ডাক্তার জানালেন আনন্দময়ী আর নেই। মানুষে-মানুষ সম্পর্ক, সত্তরের দশকের গোড়ার উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তপন সিংহ তৈরি করলেন তাঁর ছবি ‘আপনজন’। দর্শকদের যিনি তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন তিনি ছায়া দেবী, আনন্দময়ী চরিত্রের অভিনেত্রী। পথভ্রষ্ট, উদভ্রান্ত ছেলে-ছোকরাদের সঠিক পথ দেখায় যে মানুষ, তিনি তো আপনজনই বটে। ছায়াদেবীর অভিনয় জীবনের মাইলস্টোন হয়ে থাকবে ‘আপনজন’ ছবিটি।
আরও পড়ুন-দুর্গোৎসব আজ বিশ্বজনীন
ছায়াদেবীর জীবন বৈচিত্রে ভরা। ১৯২১ সালের ভাগলপুরের রাজবাড়িতে তাঁর জন্ম। ডাক নাম কনক। প্রাথমিক লেখাপড়া ভাগলপুরের মেচেদা গার্লস হাইস্কুলে। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় অধ্যাপক ভূদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে বেশিদিন সংসার করা হয়নি তাঁর। চলে এলেন কলকাতা বাবার সঙ্গেই। উত্তর কলকাতায় তাঁদের প্রতিবেশী কৃষ্ণচন্দ্রদের কাছে সংগীতে তালিম নেন। শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখলেন বেলা অর্ণবের কাছে। গাড়ি চালানো, ঘোড়ায় চড়া এসবও শিখলেন। ভাগলপুর ও দিল্লিতে থাকার সুবাদে হিন্দি ভাষায় সাবলীল ছিলেন। এসব শিক্ষা তাঁর অভিনয় জীবনে কাজে লেগেছিল। সেই সময়ের অভিনেত্রীদের (চন্দ্রাবতী দেবী, মলিনা দেবী, সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতী দেবী, যমুনা বড়ুয়া) দিকে নজর দিলে, বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন-কলকাতা পুরভোট: শেষদিনের প্রচারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শোতে জনজোয়ার
তাঁর দুই পিসতুতো দাদা শ্রীশচন্দ্র ও শৈলেশচন্দ্র ছিলেন পুরোদস্তুর কাপ্তেন। দুই দাদা অনুভব করতেন বোনের মনে কোথায় যেন একটা ব্যথা আছে। বিয়ের পর স্বামীর সান্নিধ্য যে পায়নি, তার চাপা বেদনা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই শ্রীশচন্দ্র বোনকে অভিনয় জগতে নিয়ে এলেন। শ্রীশচন্দ্রের বন্ধু উপেন গোস্বামী ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির ম্যানেজার। তাঁরই সহযোগিতায় ছায়া দেবী জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পথের শেষে’ (১৯৩৬) ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সেই সময়ে ৭৫০ টাকা পেয়েছিলেন তিনি। দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ‘সোনার সংসার’ ওই বছরেই মুক্তি পেল, যেখানে নায়িকা হিসাবে তিনি শুধু খ্যাতিই পেলেন না, সোনার মেডেলও পেলেন। তিরিশের দশকে তাঁর অভিনীত অন্যান্য ছবিগুলি হল ছিন্নহার, বিদ্যাপতি, রজনী, হাল বাংলা, রিক্তা প্রভৃতি। একাধিক ছবিতে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি গানও গাইলেন।
আরও পড়ুন-Saugata Roy: বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে সংসদে প্রশ্ন সৌগত রায়ের
এরকম জনপ্রিয় থাকতে থাকতেই মনস্থির করলেন আর ছবি করবেন না। গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। ছায়াছবির অমোঘ আকর্ষণ সহজে কি উপেক্ষা করা যায়? আবার ফিরে এলেন। ছবির নাম ‘অভের বিয়ে’ (১৯৪২)। পরিচালক সুশীল মজুমদার। সরমার চরিত্রে তিনি দেখালেন তাঁর অভিনয়ের দাপট। এরপর নব্বই দশকের গোড়া পর্যন্ত টানা অসংখ্য ছবিতে নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছিলেন। তপন সিংহ, মৃণাল সেন, অজয় কর, অগ্রদূত, অসিত সেন, সুধীর মুখোপাধ্যায়, সলিল দত্ত, ব্রজ বসু, পীযূষ বসু, দ্বিজেন গুপ্ত, সলিল সেন, হীরেন নাগ, তরুণ মজুমদার, বিকাশ রায়, অরুন্ধতী দেবী সহ বাংলার সব বিখ্যাত পরিচালকদের ছবিতে তিনি ছিলেন নিয়মিত শিল্পী। একদা নিউ থিয়েটার্সে যখন ডবল ভার্সান ছবি হত, তখন ছায়া দেবী অপরিহার্য শিল্পী ছিলেন। ‘বিদ্যাপতি’ সহ একাধিক ডবল ভার্সান ছবির তিনি অভিনেত্রী। ‘উত্তর ফাল্গুনী’র হিন্দি ভার্সান ‘মমতা’তে একই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘অবলাপ’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চন ও রেখার পাশে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করলেন। এ ছাড়াও ‘রঙ্গী-বিরঙ্গী’, ‘কিসিসে না কহনা’ প্রভৃতি ছবিতেও তাঁর দুরন্ত অভিনয়ে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছেন।
আরও পড়ুন-Bank Strike: ব্যাঙ্ক ধর্মঘট
ছায়া দেবীর কিছু স্মরণীয় চরিত্রায়ণ দর্শকদের স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। অর্চনা-সুখেন্দুর বিবাহিত জীবন তছনছ হয়ে যায় অর্চনার মায়ের খবরদারিতে। পরিণতিতে অর্চনাকে ফিরতে হয় বাপের বাড়িতে। অর্চনাকে সান্ত্বনা দিয়ে মা বলেন, ‘‘যা করেছি তোর ভালর জন্যই করেছি।’’ অর্চনা প্রতিবাদ করে, ‘‘আমার ভালর জন্য। জানো মা, আমার ঘরে ঘরে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করে তোমার মতো কত মা তার মেয়ের ভাল করতে গিয়ে কত সংসার তছনছ করে দিয়েছে।’’ অর্চনার (সুচিত্রা সেন) মায়ের ভূমিকায় তিনি। ছায়া দেবী এখানে জেদি, অহঙ্কারি, নিজের কর্তৃত্ব সম্পর্কে সজাগ, সচেতন। আর এক মা রিনা ব্রাউনের (সুচিত্রা সেন) মা। রিনা জানতেন এ তাঁর আয়া মাত্র। কিন্তু রিনা ক্রমে জানলেন তাঁর খ্রিস্টান বাবার এক সময়ের লালসার শিকার হলেন এই রমণী। যার ফলশ্রুতিতে ওই রমণীর গর্ভে রিনার জন্ম। এই চরিত্রে ছায়া দেবী।
আরও পড়ুন-উত্তরবঙ্গে প্রথম ডিজিটাল পুরসভা
এখানে তিনি ধীর, স্থির, চুপচাপ। দুটি ভিন্ন ছবিতে দু’রকমের মা। প্রথমটি ‘সাত পাকে বাঁধা’, দ্বিতীয়টি ‘সপ্তপদী’। সমান সাফল্য দেখিয়েছেন দুটি ভিন্ন চরিত্রে। জীবন মশাইয়ের পতিব্রতা স্ত্রী আতর বউকে তিনি মূর্ত করে তুলেছিলেন ‘আরোগ্য নিকেতন’ ছবিতে। শুধু স্বামীর নির্দেশ মতো বিধর্মী পুত্রকে যিনি সারাজীবন ক্ষমা করতে পারেননি, সেই ব্যক্তিত্বময়ী মাকে ছায়া দেবী ফুটিয়ে তোলেন ‘রাজা রামমোহন’ ছবিতে। শিবনাথের পিসি হিসাবে ছায়া দেবী উপন্যাসের পাতা থেকে পর্দায় উঠে এসেছেন অনায়াসে ‘ধাত্রীদেবতা’ ছবিতে। আরেক পতিব্রতার রূপ তিনি তুলে ধরলেন ‘দাদাঠাকুর’ ছবিতে। শুচিবায়ুগ্রস্ত বড় বউয়ের চরিত্রটি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুললেন ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রী গড়বেন নয়া Darjeeling
দেবযানীকে পান্নাবাইতে রূপান্তরিত করার যে পাঠ বড় বাইজি দেন, সে চরিত্রে ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিতে অননুকরণীয় অভিনয় নৈপুণ্য দেখালেন। একদল বিধবার পুরী যাত্রায় প্রধানা বিধবার ভূমিকায় নজর কাড়া অভিনয় তাঁর ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে। পর্দায় পদি পিসিকে জীবন্ত করতে পারেন তিনিই ‘পদি পিসির বর্মী বাক্স’ ছবিতে। ‘আরোহী’ ছবিতে এক ভোজপুরী রমণী হিসাবে তিনি যেভাবে হুঁকো টানলেন, তাতে মনে হয় এ অভ্যাস বহুকালের। শেষের দিকে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয় ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে। নিষিদ্ধ পল্লির রমণীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় এবং স্বকণ্ঠে গান (ছল করতে জল আনতে আমি যমুনাতে যাই) দর্শকের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল। বিকাশ রায় তাঁর আত্মকথায় স্বীকার করেছেন ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে তাঁর অভিনের জন্য বারবার দেখতে যাওয়া যায়। তাঁর শেষ অভিনীত ছবি ‘তােমার রক্তে আমার সোহাগ’ (১৯৯৩)। ১৯৬৩ সালে ভারতের তৃতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার সম্মিলিত ভাবে পেয়েছিলেন ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে। তপন সিংহের স্বীকারোক্তি হল, ‘‘সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীদের একজন। প্রায় আন্তর্জাতিক স্তরের।’’
আরও পড়ুন-Swasthya Sathi: চাঁচলে ৯৭ শতাংশ স্বাস্থ্যসাথীতে
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় রয়েছে দুটি ছবি। প্রথমটি সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নতুন তীর্থ’ (১৯৬৪)। পাক্কা এক মাস আটটাকার শুটিং-এ তাঁর স্নেহ- ভালবাসা বিস্মরণের নয়। দ্বিতীয়টি নির্মল চৌধুরী পরিচালিত ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’ (১৯৬৮)। আমি ছোট মুকুন্দদাস, তিনি মায়ের চরিত্রে। কঠোরে কোমলে মেশানো মায়ের চরিত্রটিতে তিনি যে অভিনয় করলেন, তা যে কোনও শিল্পীর কাছেই শিক্ষণীয়।
বহু শিল্পী জীবনকথা লিখে গেছেন। তিনি কিছু লেখেননি। একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের কাছে নিজের কথা বলেছিলেন তিনি। ধারাবাহিকভাবে কয়েক প্রস্থ লেখা একটি মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। তাঁকে আগলে রেখেছিলেন ঝুমুর গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর ভাইঝি। কয়েকটি ছবিতেও ঝুমুর অভিনয় করেছিলেন। বিয়ে করে বিদেশে চলে গেলে ছায়া দেবী খানিকটা একাকী হয়ে পড়লেন। আর কোনও সাক্ষাৎকার দিলেনও না। কিছুকাল অসুস্থ থাকার পর ২০০১ সালের ২৫ এপ্রিল উত্তর কলকাতার এক নার্সিংহোমে তিনি মারা যান। চোখের সামনে তিনি নেই ঠিকই, কিন্তু তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে তিনি দর্শকদের অন্তরে চিরজীবী হয়ে থাকবেন।