ভাস্কর ভট্টাচার্য : আগুন। দাউদাউ আগুন। তারই মধ্যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছেন এক নারী। এমন পুড়িয়ে মারার কথা বললেই আমাদের মনে পড়ে ইতিহাসের জোন অব আর্কের কথা। কিন্তু না, জোন অব আর্ক নন, তার অনেক আগে ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে ঠিক এমনিভাবেই জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল এক রমণীকে। যেমন সুন্দরী তেমনই প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য তাঁর। সেই সময়ের সমস্ত নামজাদা পণ্ডিতদের অনেক তত্ত্বকে, ধ্যানধারণাকে ভেঙে দিচ্ছেন এই নারী। আর তারই কারণে ধর্মগুরুর আদেশে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ প্রকাশ্য রাস্তায় ঢিল ছুঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছেন জীবন্ত প্রাজ্ঞ এক গণিতজ্ঞ বিজ্ঞানী নারীকে। পৃথিবীর প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এই নারী চিহ্নিত ছিলেন গ্রিক যুগের শেষ বিজ্ঞানী হিসেবে। নাম হাইপেসিয়া (Hypatia)। গণিত ছিল তাঁর ভালবাসা । শুধু তাই নয়, দর্শন এবং জ্যোতির্বিদ্যাতেও ছিলেন পারঙ্গম।
আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের আগে গ্রিক যুগে এক পণ্ডিতের ঘরেই জন্মেছিলেন এই নারী। বিদুষী এই নারী (Hypatia)।
পিতা নিজেই কন্যার শিক্ষার ভার হাতে তুলে নিলেন । পিতা লিওন বুঝেছিলেন নারীশিক্ষার গুরুত্ব। অন্ধকার থেকে টেনে তুলতে পারে একমাত্র শিক্ষাই। তাই নিজের মতো করে গড়তে চাইলেন মেয়েকে। লিওন ছিলেন সে সময়ের অঙ্কের বিরাট পণ্ডিত। বাবাও মেয়ের পড়াশোনা, অঙ্কের প্রতি গভীর অনুরাগ দেখে নিজের জ্ঞান পাণ্ডিত্য উজাড় করে দিলেন মেয়ের শিক্ষার জন্য। মেয়ের হাতে তুলে দিলেন দর্শন, ই্তিহাস থেকে সে-সময়ের বিখ্যাত গণিতজ্ঞদের বই। গণিতের জটিল ও দুরূহ তত্ত্বগুলো আয়ত্ত করে ফেলছেন দ্রুত। সেই নারীর চোখের সামনে উন্মেষ হচ্ছে একের পর এক গণিতের সত্য।
হাইপেসিয়া (Hypatia) খুব ছোটবেলা থেকেই গণিতের দুরূহ ও জটিল তত্ত্বগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ গবেষণাই ছিল বীজগণিত ও জ্যামিতি সম্বন্ধীয়। এই সময় হঠাৎ পিতা লিওন মারা গেলেন। একদম একা হয়ে পড়লেন এই কিশোরী। দিনরাত নিমগ্ন থাকলেন অঙ্কের জটিল আবর্তে। এক কথায় নিরলস গবেষক। নতুন নতুন গবেষণা ছাড়াও বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই দেখালেন যে পণ্ডিতদের অনেক ধারণাই ভুল। সেই ভুলগুলিই তিনি তুলে ধরলেন সমক্ষে। পণ্ডিতমহলে ঝড় উঠল। অনেকেই মেনে নিতে পারলেন না । এক কিশোরীর স্পর্ধা পণ্ডিতদের এই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি। তাঁদের আত্মশ্লাঘায় ঘা লাগল। কারণ ধর্মগুরুরা মনে করলেন প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতেরাই ছিলেন সত্যদ্রষ্টা ও অভ্রান্ত। তাঁদের তত্ত্বে ভুল থাকতে পারে না।
সমসাময়িক গণিতজ্ঞ অ্যাপোলনিয়াস ও ডায়াফান্টাসেরও ভুল ধরলেন এই কিশোরী। তখন তাঁরা খ্যাতির চূড়ায়। বরদাস্ত করলেন না হাইপেসিয়ার পাণ্ডিত্যকে। অনেকেই মনে করলেন এটা এই নারীর ঔদ্ধত্য। ফলে গণিতবিজ্ঞানী এই নারীর কপালে জুটল অপবাদ। রাতারাতি গণিতবিদ বিজ্ঞানী থেকে এই নারী হয়ে উঠলেন ‘ডাইনি’ হাইপেসিয়া।
অপবাদ রটল। খোদ আর্চ বিশপ সিরিল এবং সে সময়ের খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু থিয়োফিলাস চেঁচিয়ে বললেন, ‘এই নারী ডাইনি’। রব উঠল গোটা সমাজে। এই থিয়োফিলাস এতই গোঁড়া ছিলেন যে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত বহুমূল্যবান বইকে ‘ধর্ম বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন ধর্মান্ধ মানুষ এক নারীর এই পাণ্ডিত্য সইবেন কেমন করে? তাঁর ধারণা হল এ নারী যে সে নারী নয়। এমন সুন্দরী মহিলা একজন ‘ডাইনি’ ছাড়া আর কেউ নয়। এক ছদ্মরূপ। আর সে সময়ে ডাইনির একমাত্র শাস্তি ছিল আগুনে পুড়িয়ে হত্যা। হাইপেসিয়ার কপালেও জুটল তাই। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ্য দিবালোকে জনবহুল রাজপথের ধারে উত্তেজিত জনতা তাঁকে ধরে ছুঁড়ে দিয়েছিল জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে।
আরও পড়ুন-খাদের ধারের রেলিংটা… হাতছানির দার্জিলিংটা…
সেদিন হাইপেসিয়ার (Hypatia) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রিক বিজ্ঞানচর্চার যুগে নেমে এসেছিল গভীর অন্ধকার। সেই অন্ধকার কাটতে সময় লেগেছিল অনেক অনেক বছর। আর সেই অন্ধকার চিরেই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন আরেক মহিলা বিজ্ঞানী মাদাম কুরি। তিনি আপন কৃতিত্বে নিজের প্রতিভার স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন এই পৃথিবীতে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে যে বিজ্ঞানীর নাম কখনও ভোলার নয়। যদিও মাদাম কুরির জন্ম অন্য দেশে, অন্য পরিবেশে।
হাইপেসিয়া থেকে মাদাম কুরির সময়ের দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার বছর। হাইপেসিয়ার মৃত্যুর দেড় হাজার বছর পর জন্মেছিলেন মাদাম কুরি। সে আরেক কাহিনি।
হাইপেসিয়া ইতিহাসে তত খ্যাতি পাননি বটে, তবে মাদাম কুরির মতোই তাঁর নাম স্মরণীয় পৃথিবীর প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে। তাঁর মানসিক দৃঢ়তা ও অনমনীয়তায় পণ্ডিত পিতার যথার্থ কন্যা হয়ে উঠেছিলেন হাইপেসিয়া। তাঁর সময় এই বিজ্ঞানীকে যথার্থ চেনেনি। ইনিই প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করতে প্রথম শহিদ হয়েছিলেন।
হাইপেসিয়ার কথা এত কমে ফুরোয় না। এক অকল্পনীয় অবিস্মরণীয় প্রতিভা ছিল যেন। তাঁর কথা বলতে গেলে আমাদের মনে পড়ে যায়, এই ভারতবর্ষের এক উজ্জ্বল জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের কথা। লিওনের মতোই ভাস্করাচার্য তাঁর কন্যা লীলাবতীকে শিখিয়ে ছিলেন গণিত। পারদর্শী করেছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায়।
ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনায়ক থেকে অসংখ্য এমন সব নারী তাঁদের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে অবস্থান করছেন কালের ইতিহাসের পাতায় পাতায়।