কোভিডের সঙ্গে আমাদের অনেক দিন কাটানো হয়ে গেল। এই গোটা কোভিড পর্বে আমাদের শিক্ষাও কম হল না! লক ডাউন, আর তারপরে আনলক এক, আনলক দুই আর আনলক তিন পার হয়ে এল আত্মশাসন পর্ব। এত সব কিছু সত্ত্বেও কোভিডকে শাসন করা গেল না।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে, এখন বিজ্ঞানের এত অগ্রগতি ঘটেছে, বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞান এত এগিয়েছে যে এখন তো আর অসুখের ভয় নেই। তাহলে মারি নিয়ে ঘর এখনও করছি কেন আমরা? বিজ্ঞান ম্যাজিক নয় তা আমরা জানি। বিজ্ঞানের কাজ হল প্রশ্ন করা আর সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, পরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের পদ্ধতির মাধ্যমে। সেই লক্ষ্যেই বিজ্ঞান কোনও পরীক্ষা বারবার করে তার যথার্থতা যাচাই করে নিতে চায়। সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে কাজ করতে থাকে।
সমস্যা হল বিজ্ঞান এই লক্ষ্যে কাজ করলেও বিজ্ঞানকে জনস্বার্থে ব্যবহার করেন যাঁরা তাঁরা তো যথেষ্ট বিজ্ঞানমনস্ক নন। আমেরিকায় এমন শাসক হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এদেশে মোদি- বাহিনী। আমেরিকার আগের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প কোভিডকে তো মানতেই চাননি। অস্বীকার করেছিলেন, কোভিডজনিত বিধিনিষেধ মানতে। মাস্কে মুখ ঢাকতে বেজায় আপত্তি ছিল তাঁর। আর তার ফলে আমেরিকায় কোভিড নিয়ন্ত্রণের বিশেষ কোনও উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বের সময়ে।
আমেরিকা থেকে আসা যাক এবার আমাদের দেশে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কোভিড নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক পর্বে রোগ প্রতিরোধের যেসব নিদান হেঁকেছিলেন তাতেই একথা স্পষ্ট যে তাতে না ছিল সঠিক নীতি আর না ছিল বিজ্ঞানমনস্কতা। এই নীতিহীনতার ছাপ পদে পদে। দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের ঘরে ফেরার কোনও সুযোগ না দিয়ে হুট করে ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল জনতা কার্ফু। তারপর দেখেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের দীর্ঘ পদযাত্রার করুণ কাহিনি। রাষ্ট্র তার জনকল্যাণের দায়িত্ব অস্বীকার করে শ্রমিকদের একরকম মৃত্যুমুখে ফেলে দেয়। একদিকে রেললাইন আর হাইওয়ে ধরে বাড়ির পথ ধরা শ্রমিকদের পিষে দিচ্ছে মালগাড়ি, বিশেষ ট্রেন আর ট্রাক, রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁদের আধখাওয়া শুখনো রুটি আর অন্যদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন থালা আর ঘণ্টা বাজাতে। এই অবস্থাই ছিল কোভিড প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্বের ছবি। তারপরেই বা অবস্থা কতটা বদলেছে?
দিল্লির এমসের কমিউনিটি মেডিসিনের ডাক্তার অধ্যাপক আনন্দ কৃষ্ণন একটি জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারি নীতির মধ্যে এত অবিজ্ঞান আর যুক্তিহীনতার রমরমা দেখে তাঁর প্রশ্ন, এই নীতিগত ভ্রান্তি কি অজ্ঞতাপ্রসূত নাকি ইচ্ছাকৃত? তাঁর বক্তব্য, আগেকার ক্ষেত্রে ভুল নীতি প্রণয়নের পেছনে যদি অজ্ঞতা কার্যকর থেকেও থাকে তবে সাম্প্রতিক ভুল নীতিগুলো ইচ্ছাকৃত। আর তার পেছনে রয়েছে শাসকের স্বার্থ। একদিকে ভুয়ো জাতীয়তাবাদের প্রসারের জন্য আর অন্যদিকে ব্যবসায়িক স্বার্থে চলছে শাসকের এই অবিজ্ঞানের সাধনা। বিজ্ঞান তো বিশ্বজনীনতার কথা বলে; সাধারণ সূত্র মেনে চলার কথা বলে। আর তার বদলে বলা হচ্ছে ‘আমরা অনন্য, তাই আমাদের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র প্রযোজ্য নয়’। তাই কখনও কোভিড নিধনের নিদান হিসেবে পেশ করা হচ্ছে ভাবিজি পাঁপড়, আবার কখনও বা দেওয়া হচ্ছে যাগ-যজ্ঞের বিধান।
আরও পড়ুন-প্রকাশ্যেই বিজেপি লাট খাচ্ছে, দল ছাড়া চলছে
অপবিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে ছদ্মবিজ্ঞানের প্রচার। তা না হলে ভাবতে পারেন কোনও সরকারি পরামর্শে বলা হচ্ছে দরজা জানলা ভাল করে মুছতে কারণ কোভিডের জীবাণু নাকি সেই পথ দিয়ে ঢুকবে। এমন কথা বলা হয়েছিল ২০২০-র গোড়ার দিকে যখন সবে কোভিডের কথা শোনা যাচ্ছে! সরকারি নীতির অসারতার আরও যদি প্রমাণ চান তাহলে বলা যায়, এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে ঢোকার সময়ে কোভিড পরীক্ষার বিধানের কথা। এতে কোভিডের প্রাদুর্ভাব এড়ানো যায়নি। উলটে বেড়েছে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়া মানুষের হয়রানি। আবার ভেবে দেখুন, ভিড়ে ঠাসা বিমানবন্দরে আর রেলস্টেশনে বলা হচ্ছে দু’গজ দূরে থাকার দূরত্ববিধি মেনে চলতে। প্রহসন ছাড়া একে আর কী বলবেন!
সরকারি ভুল নীতির ফলে লাভ যদি কারও হয়ে থাকে তবে তারা হল বড় ব্যবসায়ী। সরকার লকডাউনের আতঙ্ক ছড়িয়েছে। মধ্যবিত্তরা সেই আতঙ্কে বিপদের আশঙ্কায় দরকারি জিনিসের মজুতদারে পরিণত হয়েছে। আর ক্রয়ক্ষমতাহীন মানুষকে সামান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার মতো অর্থও জোগায়নি দেশের সরকার। না খেতে পেয়ে মরতে হয়েছে গরিব মানুষকে। দূরে কাজ করতে যাওয়া ভিনরাজ্যের শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন আর সেখানে কেন্দ্রের সরকার সামান্য সামাজিক দায় পালন করার নীতি নিতে পারেনি।
দেশের প্রধান শাসক নিজের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতেই তৎপর থেকেছেন এই পৌনে দু’বছর ধরে। তাই টিকাকরণের শংসাপত্রে তাঁর ছবি, চতুর্দিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রচারের (পড়ুন আত্মপ্রচারের) ঢক্কানিনাদ! যাঁরাই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁদেরকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু ভুল নীতি, অপবিজ্ঞান আর ছদ্মবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ প্রতিবাদী হয়েছেন।
কোভিড যেন আরও ভাল করে বুঝিয়ে দিল সাধারণ মানুষ আর নীতিপ্রণেতা উভয়েরই দরকার বিজ্ঞানের মেজাজ। বিজ্ঞানবোধ আর জনকল্যাণের ভাবনাই দেশ আর দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে পারে এই ক্ষতিকারক শাসননীতির করাল কবল থেকে। কে বলতে পারে, এই খারাপ অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ শাসকের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে মুক্তির লড়াই শুরু করবে না? কৃষকদের প্রাণ বাজি রেখে লড়াই করার সাম্প্রতিক ইতিহাস কি সে-ইঙ্গিতই দেয় না?