কথায় বলে নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা। তা হলে নৃত্যপটীয়সী যিনি নাচেন বা আসলে নাচতে জানেন, তাঁর পায়ের তলার শক্ত মাটিটা কেমন হয়? তাঁর পায়ের ছন্দে বোধহয় নেচে ওঠে মাটিও। নেচে ওঠে গোটা প্রকৃতি। নেচে ওঠে অডিয়েন্স। তাঁর জন্য কোনও প্রবাদ প্রবচন হয় না। প্রবাদের অর্থ যা-ই হোক না কেন নৃত্যশিল্পী সঞ্চয়িতা মুনশির যাত্রাপথ শিল্পসুষমামণ্ডিত, ছন্দে, রূপে, রঙে, বর্ণিল। তাঁর ‘নৃত্যাভাস অ্যাকাডেমি অফ পারফর্মিং আর্ট’ একটি যাত্রাপথ যেখানে শত শত নৃত্যের অভিসার। তিনিই অভিসারিকা। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী
শৈশবে ছোটকাকাই ছিলেন তাঁর প্রথম নৃত্যগুরু। ভরতনাট্যমে হাতেখড়ি তখনই। মাত্র নয়-দশ বছর বয়স তখন, নাচের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয়নি তেমন। পড়াশুনোয় মেধাবী একটা সময় ভূগোল নিয়ে পড়বেন ভেবেছিলেন। বাবা, মা, কাকার ইচ্ছেতেই নাচ নিয়ে এগোনো সঞ্চয়িতা মুনশির। নাচেই ছিল তাঁর মুক্তি তাই ধীরে ধীরে দক্ষ হতে থাকলেন নৃত্যকলায়।
আরও পড়ুন-ফিরছে ধূসর নেকড়ে, আর বাদামি হায়না
প্রথাগত নৃত্যশিক্ষার পাশে ওই সময় কিশোরবাহিনী নামের একটি ক্যাম্পের সদস্যা হয়ে কাকার সঙ্গে রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে বহু স্থানে পারফর্ম করেন। তখন শুধু ভরতনাট্যম নয় নানাধরনের আঞ্চলিক লোকনৃত্যও পরিবেশন করেছিলেন। অভিজ্ঞ নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠার ভিত্তিপ্রস্তর তখনই প্রোথিত হয়। ওই সময় ১৯৯৬ সালে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রাষ্ট্রীয় যুবা উৎসবে ষোলো হাজার শিশুর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন তিনি। নিজের স্কুলকে প্রতিনিধিত্ব করেন। পড়াশুনোর পাশাপাশি আঠারো বছরেই সংগীত ভারতী নামে নিজস্ব একটা নাচের ট্রুপও তৈরি করেন। বিভিন্ন জায়গায় পারফর্মও করে সেই ট্রুপ। যদিও সেটি পরে বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় ক্লাসিক্যাল বা রাগাশ্রয়ী নৃত্যের শেখার স্পৃহা তৈরি হয় সঞ্চয়িতার মধ্যে। তিনি বুঝেছিলেন ভরতনাট্যম একটা মহাসমুদ্র যা পরিপূর্ণভাবে না শিখলে অনেক কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই ভাবনা থেকেই জোরদার তালিম নিতে শুরু করেন নৃত্যগুরু আচার্য অনসূয়া ঘোষ ব্যানার্জির সান্নিধ্যে। ২০০৫-এ ভরতনাট্যম এবং ২০০৭-এ রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি থেকে ওডিসি নৃত্যের প্রশিক্ষণ শুরু নৃত্যগুরু কাকলি ঘোষের কাছে। এই সময়েই ভারত সরকারের জাতীয় বৃত্তি বা ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেলেন এবং নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ২০০৫ এই শুরু করলেন ডান্স অ্যাকাডেমি ‘নৃত্যাভাস অ্যাকাডেমি অফ পারফর্মিং আর্ট’। তাঁর এই সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদন প্রাপ্ত। রাজ্য সরকারের অনুমোদন খুব সহজ কাজ ছিল না। কিছু বিশেষ শর্তাবলি থাকে এই অনুমোদন পেতে। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ হত ভরতনাট্যমের উপর, তালের উপর, রবীন্দ্রনৃত্যের উপর। এর সঙ্গে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিত তাঁর সংস্থা। এই বহুমুখী কর্মকাণ্ডর জন্য সরকারি অনুমোদন মেলে এই অ্যাকাডেমির। এই কর্মকাণ্ড কিন্তু আজও একইরকমভাবে জারি রয়েছে।
আরও পড়ুন-১০ লক্ষ কুইন্টাল ধানক্রয় মুর্শিদাবাদ জেলা
এই যাত্রাপথে তিনি মা-বাবার পাশাপাশি পেয়েছেন স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়ির অকুণ্ঠ সহযোগিতা। স্বামী অভিনেতা রাজা মুনশি প্রায় বারো বছর বাংলা সিরিয়াল এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন কিন্তু বহু ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যেও সাহায্য করেছেন সঞ্চয়িতাকে। সন্তানকে বড় করেছেন শ্বশুরবাড়ির সাহচর্যেই। ছোট্ট ছেলেকে নিয়েই কিন্তু রবীন্দ্রভারতী থেকে নাচে মাস্টার্স করেন সঞ্চয়িতা, একবছরের স্কলারশিপও পান। ছেলে শ্রীজিত মুনশি মায়ের কাছ থেকেই একটা বয়সের পর নৃত্যের তালিম নেওয়া শুরু করে। সেও একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত দক্ষ শিশুনৃত্যশিল্পী। মাত্র বারো বছর বয়সেই বিদেশ থেকেও ডাক পেয়েছে। সঞ্চয়িতা এবং তাঁর ডান্স অ্যাকাডেমি ‘নৃত্যাভাস’-এর ছাত্রছাত্রীরা উদয়শংকর নৃত্য উৎসব, ইজেডসিসির প্রতিভা উৎসবে ও আরও বেশকিছু ফেস্টিভালে সফলভাবে যোগদান করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ছাত্রযুব উৎসবে গ্রুপ নিয়ে পারফর্মও করেন এবং প্রথম স্থানাধিকারী হয়। রাজ্য সরকারি রেজিস্ট্রেশন রয়েছে বলে বিভিন্ন রাজ্য সরকারি হলগুলোতে নৃত্য পরিবেশন করে ‘নৃত্যাভাস’। সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত তাই এই ডান্স অ্যাকাডেমি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ফোরাম অফ আর্ট অ্যান্ড কালচার, হিন্দুস্থানি আর্ট অ্যান্ড মিউজিক সোসাইটি গ্লোবাল এগজামিনেশন এই তিনটে বোর্ডের অ্যাফিলিয়েটেড।
আরও পড়ুন-উদয়নারায়ণপুরে দু’দিন বন্ধ দোকান
সঞ্চয়িতা শুধু নিজে সফল এমনটা নন তাঁর হাতে তৈরি এখানকার ছাত্রছাত্রীরাও সফল নৃত্যশিল্পীর মর্যাদা পেয়েছে। এই অ্যাকাডেমি শুধু নৃত্যের প্রশিক্ষণই দেয় না গ্রুমিং শেখায়, মেকআপ, প্রপস, নাচের পোশাক তৈরি এমনকী সেট তৈরির প্রশিক্ষণও দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দক্ষ করে তোলে। একটা গোটা প্রোডাকশন মঞ্চস্থ করতে হলে যে ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন সবটাই দেওয়া হয় এখানে। এখানকার স্টুডেন্টরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ছাত্র যুব উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে পুরস্কৃতও হয়েছে। এই মুহূর্তে একশোর উপর ছাত্রছাত্রী রয়েছে এই অ্যাকাডেমিতে। ‘নৃত্যাভাসের’ ছাত্রছাত্রীরা কলকাতায় আয়োজিত ভারত সাংস্কৃতিক উৎসবে যোগদান করেছে।
আরও পড়ুন-পর্যটকহীন দিঘায় পরিযায়ী অতিথিরা
নৃত্যাভাস অনেক নৃত্যনাট্যই সফলভাবে মঞ্চস্থ করেছে যার মধ্যে অন্যতম হল চণ্ডালিকা এবং কৃষ্ণা। সঞ্চয়িতার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অঢেল। এক এক করে যার বাস্তবায়নে তিনি অগ্রসরমান। নৃত্যাভাসের নিজস্ব নৃত্য উৎসব হয় যার নাম নৃত্যম উৎসব। এই উৎসবে শুধু এই রাজ্যের নয়, সারা ভারতবর্ষ এবং সুদূর বাংলাদেশ থেকে শিল্পীরা এসেছিলেন অংশগ্রহণ করেছিলেন। লকডাউনে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নৃত্যাভাসের পেজে অনলাইনের মাধ্যমে বহু নামী শিল্পী দেশ এবং বিদেশ থেকে অংশগ্রহণও করেছেন এই নৃত্যম উৎসবে। আরও ভাল ভাল ওয়ার্কশপ করার ভাবনা রয়েছে ভবিষ্যতে। পদ্মশ্রী শিল্পী চিত্রা বিশ্বেসরণ বর্তমানে সঞ্চয়িতার নৃত্যগুরু। ভরতনাট্যমের বিস্তৃত ক্ষেত্রের পুরোটাই করায়ত্ত করতে চান সঞ্চয়িতা। কারণ নিজে পরিপূর্ণ না হলে অপরকে সম্পূর্ণ শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলা যায় না। আরও বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌছতে চান তিনি।