শীতের দিনে ঘরে-ঘরে তৈরি হয় পায়েস আর পিঠে। পাশাপাশি এখন পাওয়া যায় বিভিন্ন দোকানেও। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পৌষ উৎসব। সেখানেও পাওয়া যায় পিঠে-পায়েস। পেটুক বাঙালি এই উৎসবে গিয়েও নিজেদের রসনা মেটায়। এইভাবেই যুগ-যুগ ধরে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হয়ে থেকে গেছে পৌষপার্বণ, আদরের পিঠে-পায়েস। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী
পিঠে। নামটি ছোট্ট। কিন্তু তৈরিতে প্রচুর খাটুনি। তবু রসনাপ্রিয় বাঙালির পাতে এর কদর বিন্দুমাত্র কমেনি। যুগ যুগ ধরে একই আছে। বিশেষত শীতে। ঠাণ্ডা পড়লেই ঘরে ঘরে শুরু হয় দিন-গোনা, কবে পৌষ পার্বণ? ছোটদের পাশাপাশি অপেক্ষায় থাকেন বড়রাও। বাড়ির মহিলারা শুরু করে দেন প্রস্তুতি। এখন দোকানে দোকানে কিনতে পাওয়া যায় চালগুঁড়ো। আগে শিল-নোড়ায় গুঁড়ো করা হত চাল। খাটুনি ছিল। পাশাপাশি ছিল ভরপুর আনন্দ। সারাদিনের কাজ সেরে মূলত দুপুরবেলায় চাল গুঁড়োতেন মা-কাকিমা-জেঠিমারা। কম বয়সি মেয়েরাও হাত লাগাত। একান্নবর্তী পরিবারে চাল গুঁড়ো উপলক্ষে জমে উঠত আসর। গল্প, রসিকতা, হাসিঠাট্টা। পুরুষরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকতেন। তাঁদের ছুটতে হত দোকানে। কিনে আনতে হত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। তার মধ্যে অবশ্যই খেজুর গুড়।
আরও পড়ুন-নারীর স্বাধীন মানচিত্র
খেজুর গুড়কে নলেন বা নতুন গুড়ও বলা হয়। এর স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিউলি বা গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। সেই রস ফুটিয়ে হয় গুড়। গুড় ফোটানোর সময় সারা পাড়া গন্ধে ম-ম করে। চারপাশে জমে যায় উৎসাহী মানুষের ভিড়। তবে বর্তমানে দেখা দিয়েছে শিউলির আকাল। নতুন প্রজন্ম এই কাজে আগ্রহী না হলে আগামী দিনে উৎকৃষ্ট খেজুর গুড় পাওয়া সমস্যা হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে ভাবনাচিন্তা চলছে।
চালগুঁড়ো পর্ব চলে বেশ কয়েকদিন ধরে। এই গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় মূলত পুরপিঠে বা পুলিপিঠে। একে সিদ্ধপিঠেও বলা হয়। যাকে মনে করা হয় পিঠের রাজা। পুলিপিঠে না খেলে যেন শীতের পার্বণ অসম্পূর্ণ। এমন ধারণা ছড়িয়ে আছে গ্রামবাংলায়।
পিঠে তৈরি হয় মূলত সন্ধেবেলায়। ছেলেরা তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন। ছোটদের থাকে অঘোষিত পড়ার ছুটি। সবার নজর একদিকে। চলতে থাকে পিঠে তৈরি। অনেক বাড়িতে পিঠে তৈরিতে হাত লাগান সবাই। এমনকী ছোটরাও।
আরও পড়ুন-এক দলিত মেয়ে এক আকাশ স্বপ্ন
কীভাবে কোন পিঠে তৈরি হয়?
পুলিপিঠে : একটি পাত্রে নারকেল কোরা এবং গুড় একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে পুর তৈরি করে নিতে হয়। একেবারে শুকনো হবে নারকেলের পুর। সেটা নামিয়ে জল গরম করে তাতে চালের গুঁড়ো এবং ময়দা দিয়ে ভাল করে গুলে নিতে হয়। চালের গুঁড়ো সিদ্ধ হয়ে গেলে সেটি নামিয়ে সাবধানে লেচি তৈরি করতে হয়। লেচি যেন বেশি পাতলা যেন না হয়। লেচির ভিতরে নারকেলের পুর দিয়ে অর্ধেক ভাঁজ করে মুখটা বন্ধ করতে হয়। ডাল ও তরকারির পুরও দেওয়া হয়। তারপর উনুনে জল ফুটিয়ে সিদ্ধ করতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ রাখলেই পিঠে তৈরি। পুলিপিঠের পাশাপাশি তৈরি হয় দুধপুলিও।
পাটিসাপটা : শুরুতে চালের গুঁড়ো, ময়দা, সুজি, দুধ এবং নুন একসঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়। তাতে ভাল করে মিশিয়ে নিতে হয় খেজুর গুড়। খুব ভাল করে তৈরি করতে হয় ব্যাটার। ব্যাটারটি ঘন এবং পাতলার মাঝামাঝি হয়। ব্যাটারটি ঢাকা দিয়ে রেখে কড়াই গরম করে তাতে নারকেল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। এরপর এতে মেশাতে হয় ক্ষোয়াক্ষীর এবং গুড়। খুব ভাল করে পাক দিতে হয়। তবে পাক যেন শক্ত না হয়। এবার পাটিসাপটা তৈরির পালা। চালু বা ফ্রাইং প্যানে তেল ব্রাশ করে নিতে হয়। তেল গরম হলেই তাতে গোলাকার হাতা দিয়ে গোল করে ব্যাটারটি দিয়ে সাবধানে সেটি ছড়াতে হয়। আঁচ একেবারেই কমিয়ে রাখলে ভাল। এবার পাটিসাপটার মাঝে লম্বা করে ক্ষীরের পুর লম্বা করে দিতে হয়। তারপর ভাঁজ। অনেকটা অমলেটের মতো। আরও কয়েক মিনিট উলটে পালটে ভেজে নামিয়ে নিলেই পাটিসাপটা। একদম রেডি।
আরও পড়ুন-রাজ্যকে প্যাঁচে ফেলতে গিয়ে আবারও মুখ পুড়ল রাজ্যপালের
ভাপাপিঠে : ভাপাপিঠে তৈরির নির্দিষ্ট পাত্র থাকে। সেটি না থাকলে ইডলি তৈরির পাত্রেও ভাপাপিঠে তৈরি করা যায়। শুরুতে একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো নিয়ে তাতে সামান্য জল ছিটিয়ে ঝরঝরে করে মেখে নিতে হয়। পাত্রে গরম করে উপরে ইডলির পাত্র রাখতে হয়। তার আগে নির্দিষ্ট জায়গায় চালের গুঁড়ো ইডলির আকারে গড়ে তাতে রেখে দিতে হয়। উপরে ছড়িয়ে দিতে হয় নারকেল কোরা এবং গুড়। আবার চালের গুঁড়োর মাঝে নারকেল-গুড়ের পুর ভরেও ইডলির পাত্রে ভাপিয়ে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে কচুরিতে পুরভরার মতো করে চালের গুঁড়োয় নারকেল-গুড়ের পুর ভরে দু হাত দিয়ে চেপে দিতে হয়। তারপর সেটি ইডলির পাত্রে রেখে দিতে হয়। গরম জলের ভাপে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাপাপিঠে তৈরি হয়ে যায়।
সরুচাকলি : এই পিঠের প্রধান উপকরণ বিউলির ডাল, সামান্য মটর ডাল, অল্প চাল ও ঘি অথবা তেল। তৈরির জন্য লাগে একটি তাওয়া অথবা চাটু। প্রথমে বিউলির ডাল, সামান্য মটর ডাল ও সামান্য চাল মিশিয়ে সেটা মিহি করে বেটে নিতে হয়। তাতে সামান্য নুন সহযোগে জল মিশিয়ে গোলনা গোলা বা লেই তৈরি করা হয়। গরম চাকু বা তাওয়ায় ঘি বা তেল মাখিয়ে তারপর গোলনাটি ছড়িয়ে দিতে হয়। তালপাতার একটি টুকরো দিয়ে আস্তে আস্তে চাটুতে মেলে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড রেখে ভেজে নিতে হয়। খেজুর গুড়ে ডুবিয়ে খেতে দারুণ লাগে।
আসকে পিঠে : মাটির তৈরি ঢাকনা দেওয়া খোলা চাই। চালের গুঁড়ো জলে গুলে গরম খোলায় ভাপিয়ে এই পিঠে তৈরি হয়। এই পিঠে মূলত ঝোলাগুড় দিয়ে খাওয়া হয়। এটি শুকনো অথবা দুধ ও গুড়ের তৈরি সিরায় ভিজিয়েও খাওয়া হয়। পিঠে তৈরির জন্য চালের গুঁড়ি ও জলের মিশ্রণ অল্প তাপে মাটির খোলায় ভাপাতে হয়। আসকে পিঠেকে অনেকেই চিতই পিঠে বলে।
আরও নানা রকমের পিঠে রয়েছে। কয়েকটি জনপ্রিয় পিঠের কথা উল্লেখ করলাম। তবে বাঙালির পৌষপার্বণ অসম্পূর্ণ থেকে যায় নতুন গুড়ের পায়েস ছাড়া। গুড়ের পায়েসের সত্যিই কোনও তুলনা নেই। ছোট থেকে বড় সবার প্রিয়। ঘরে ঘরে তৈরি হয়। বহু স্বাস্থ্য-সচেতন মানুষও এর স্বাদ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে চান না। যদিও এখন বিভিন্ন কারণে বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠে-পায়েসের চল কিছুটা হলেও কমেছে। এখন পিঠে-পায়েস পাওয়া যায় বিভিন্ন দোকানে। কয়েক বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পৌষ উৎসব। সেখানেও পাওয়া যায় পিঠে ও পায়েস। পেটুক বাঙালি এই উৎসবে গিয়ে নিজেদের রসনা মেটান। যদিও এই ছবি মূলত শহরের। গ্রামের ছবি মোটামুটি আগের মতোই। এইভাবেই যুগ যুগ ধরে বঙ্গজীবনের অঙ্গ থেকে গেছে পৌষ পার্বণ, আদরের পিঠে-পায়েস।