কল্পনা, তবু গল্প না

তিনি কল্পনা দত্ত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। যোগদান করেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখায়।

Must read

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বলেছেন ‘অগ্নিকন্যা’। তিনি কল্পনা দত্ত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। যোগদান করেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখায়। হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। পরে জেল-জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি। দিনটিকে স্মরণ করে চট্টগ্রাম বিপ্লবের বিদ্রোহী কন্যার জীবনসংগ্রামের উপর আলোকপাত করলেন ড. অন্বেষা আচার্য

ঘন অন্ধকার রাত। ঝুপ-ঝুপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। শহর থেকে অনেক দূরে একটি গ্রাম। একটি মেয়ে চণ্ডীমণ্ডপে মশারির মধ্যে দুরুদুরু বক্ষে বসে আছে। একটা টিমটিমে লন্ঠন জ্বলছে মণ্ডপের এক কোণে। মেয়েটির ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয় সে কারও প্রতীক্ষা করছে। রাত প্রায় দুটো। মেয়েটির মধ্যে এবার ফুটে উঠছে অস্থিরতা। প্রতীক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। কিন্তু খবর তো এসেছে তিনি আসবেন। তিনি তো মিথ্যে খবর দেবার লোক নন। আর কত দেরি হবে তাঁর? হঠাৎ অন্ধকারে একটা পায়ের শব্দে চমকে উঠল মেয়েটি। কে যেন আসছে। একটা লোক! লম্বামতো, চাদর জড়ানো মূর্তি। প্রায়ান্ধকারে তার মুখ স্পষ্ট নয়। লোকটি তার পরিচয় নিল ও কিছু প্রশ্ন করল। এবার আর একটি পায়ের শব্দ। মেয়েটি দেখল একজন ছোটখাটো রোগা মানুষ আপাদমস্তক চাদরে মুড়ি দিয়ে অন্ধকারের ভেতর থেকে তার সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি দুই আগন্তুকের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে ভাবতে লাগল আসল মানুষ কোনটি।

আরও পড়ুন-পায়েস-পিঠে লাগে মিঠে

দ্বিতীয় লোকটি তার কাছে এসে বসলেন। মেয়েটি দেখল অত্যন্ত সাদামাটা চেহারার স্বল্প দৈর্ঘ্যের বিরলকেশ একজন মানুষ। কিন্তু আশ্চর্য তার চোখদুটি। উজ্জ্বল, স্থির, বুদ্ধিদীপ্ত। সহাস্য মুখে মানুষটি তাকে বললেন, ‘এই বয়সে স্বদেশি করবে, তোমার ভয় করবে না?’ মেয়েটি সহজ কণ্ঠেই বলল, ‘না’। লোকটি তেমনই হাসিমুখে বললেন, ‘বেশ, তা হলে তোমাদের বাড়িতে কিছু জিনিসপত্র রাখতে দেব।’ এরপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তার পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলেন। মেয়েটি সদ্য আইএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। জানাল তার পরীক্ষার ফল ভাল হয়নি। মুহূর্তে মানুষটি গম্ভীর হয়ে গেলেন। সামান্য বিরক্তি মেশানো স্বরে বললেন, ‘তোমাকে কি খুব বেশি কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?’ বোঝা গেল, পড়াশোনার শৈথিল্য তিনি পছন্দ করেননি। আর সেইসঙ্গে এটাও বোঝা গেল, মেয়েটি যার জন্য প্রতীক্ষা করছিল, মানুষটি তিনি। বিপ্লবী নেতা, সমগ্র চট্টগ্রামের নয়নের মণি সূর্য সেন। সেই প্রথম মেয়েটি তার নেতাকে দেখল। তিনি তখন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর আত্মগোপন করে রয়েছেন। গোপন ডেরায় তিনিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন এই দুর্দান্ত সাহসী মেয়েটিকে।

আরও পড়ুন-নারীর স্বাধীন মানচিত্র

মেয়েটির নাম কল্পনা দত্তগুপ্ত। রায়বাহাদুর দুর্গদাস দত্তগুপ্তর নাতনি। চিকিৎসক হিসাবে চট্টগ্রাম শহরে রায়বাহাদুরের ভারি সুনাম। ইংরেজরা তাঁকে ডাকেন ‘ডাট’ বলে। সেই থেকেই তার পরিচয় দুর্গদাস ডাট।দাদুর দেখাদেখি কল্পনাও তাই— কল্পনা দত্ত। বাবা বিনোদবিহারী দত্তগুপ্ত, মা শোভনাবালা দেবী। ড. খাস্তগিরস ইংলিশ হাই স্কুল ফর গার্লসে তার শিক্ষার শুরু। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। দুজনেই সমান ডানপিটে, আর ব্যাডমিন্টন খেলায় পটু। ১৯২৯ সালে সংস্কৃতে আর অঙ্কে লেটার মার্ক্স নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশনে পাশ করে কল্পনা ভর্তি হলেন কলকাতার বেথুন কলেজে। বেথুন কলেজের হোস্টেল হল তার নতুন ঠিকানা। সেসময় কলকাতায় একটি ছাত্রী সংঘ গড়ে উঠেছিল বেণীমাধব দাশের কন্যা কল্যাণী দাশের নেতৃত্বে। একই সঙ্গে কলেজের খুব কাছেই ছিল সিমলা ব্যায়াম সমিতি। এখানে যুযুৎসু, ছোরা খেলা, লাঠি খেলা প্রভৃতির শিক্ষা দেওয়া হত। কল্পনা অবিলম্বে এই আখড়ায় ভর্তি হয়। এই কলেজে পড়তে পড়তেই তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মনোরঞ্জন রায় প্রভৃতি বিপ্লবীদের, যাঁদের সঙ্গে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের যোগাযোগ ছিল।

আরও পড়ুন-ফের গোয়া সফরে অভিষেক

ঠিক এই সময় ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের পুলিশ অস্ত্রাগার লুন্ঠন, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস, রেললাইন ধ্বংস, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ ও পাহাড়তলির অক্সিলিয়ারি আর্মারি রেড হয়। সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে সে খবর। বাংলার ছেলেদের সাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় সমস্ত দেশ। কল্পনার পক্ষে কলকাতায় বসে থাকা আর সম্ভব হয় না। তিনি ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। আর কোনওদিন কলকাতায় পড়া শেষ করতে ফিরে আসেননি। চট্টগ্রাম থেকেই আইএসসি পরীক্ষা দেন। এসময় পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মারফত সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নির্মল সেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, যিনি মাস্টারদাকে কল্পনার কথা বলেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি পুলিশের সন্দেহের বাইরে। কাজেই সেটি অস্ত্রশস্ত্র, ডকুমেন্ট রাখার আদর্শ জায়গা। কল্পনা তাই ক্রমশ বিপ্লবীদের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে লাগল। আর সেইসঙ্গে হলেন পুলিশের সন্দেহভাজন।

আরও পড়ুন-কল্পনা, তবু গল্প না

১৯৩১ সাল। কল্পনা তখন চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট কলেজে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। সেসময় অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ প্রভৃতি চট্টগ্রামের জেলবন্দি বিপ্লবীরা জেলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জেল ভেঙে বেরিয়ে আসার এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করেন। কল্পনা তাতে সাধ্যমতো বাইরে থেকে সাহায্য করেন। বাড়িতে বহু গোপন ডকুমেন্ট, অস্ত্রশস্ত্র রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের ছাত্রী হবার সুবাদে বাড়িতে বসে কিছু বিস্ফোরকও বানান। এমনকী কলেজ ল্যাবরেটরিকেও তিনি বিস্ফোরক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু ভাগ্য সঙ্গ দিল না। একটি সামান্য ভুলে ১৯৩১ সালের এই ‘ডিনামাইট ষড়যন্ত্র’ প্রকাশ পেয়ে গেল। আরও অনেকের মতো কল্পনার ‘হোম রেস্ট্রেন্ড’ অর্ডার হয়ে গেল। এদিকে বাড়ির লোকদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। বাধ্য হন কল্পনা নির্মল সেনকে সেকথা জানাতে।
মেয়েদের কতটা বিশ্বাস করা যায়, সে-নিয়ে সন্দেহ ছিল বলে প্রথমাবস্থায় মেয়েদের দলে নেবার ঘোর বিরোধী ছিলেন মাস্টারদা। অনন্ত সিংহ প্রভৃতি নেতারাও মেয়েদের দলে নেবার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাঁদের মত বদলাতে থাকে। মেয়েদের দিয়ে অ্যকশন করানোর কথা ভাবা হতে থাকে। এই সময়ে এক রাতে পুরুষের পোশাকে সজ্জিত হয়ে নিবারণ নামক এক সঙ্গীর সঙ্গে কল্পনা যাচ্ছিলেন পাহাড়তলির দিকে। কিন্তু হঠাৎ করেই পথে তাঁরা স্থানীয় লোকেদের হাতে ধরা পড়ে গেলেন। পুলিশ এল। একটি মেয়ে পুরুষের পোশাকে কোথায় যাচ্ছে সেটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল কল্পনাকে। ইতিমধ্যে কল্পনার বাড়িতে পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে তিনি মিসিং। কল্পনা জানালেন তিনি কলকাতায় চলে যাচ্ছিলেন। কারণ এখানে তাঁকে অযথা সন্দেহ করে হোম রেস্ট্রেন্ড রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব কথায় কোনও লাভ হল না। গ্রেফতার হলেন। দুমাস পরে জামিনে ছাড়া পেলেও প্রতিদিন থানায় হাজিরা দিতে হত। ইতিমধ্যে মাস্টারদার কাছ থেকে নির্দেশ এল আত্মগোপন করার। সেই নির্দেশ পালন করলেন কল্পনা। ততদিনে নির্মল সেন নিহত হয়েছেন ধলঘাটের সংঘর্ষে, আর প্রীতিলতা পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে হয়েছেন শহিদ।
পলাতক জীবনে বারবার বিপদকে ফাঁকি দিয়ে তাঁরা নানা শেল্টারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মাস্টারদা মোট দু বছর নয় মাস আঠাশ দিন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পলাতক জীবন যাপন করেছেন। কোথাও দু’একদিনের বেশি থাকেননি। কিন্তু কল্পনার পলাতক জীবন অল্পদিনের। এই স্বল্পকালীন অবসরে দুটি মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। একজন মাস্টারদা সূর্য সেন, ও অন্যজন তারকেশ্বর দস্তিদার, যিনি ফুটুদা নামে পরিচিত ছিলেন। বিপদের মধ্যে মাথা ঠান্ডা রাখার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল মাস্টারদার, যা কল্পনাকে বারবার অবাক করত। এতটা স্থিতধী না হলে এতবড় একটা অ্যকশন পরিচালনা করা যায় না, নেতাও হওয়া যায় না। আর অন্য মানুষটি, অর্থাৎ ফুটুদার তাঁর প্রতি ছিল এক অন্যরকম মুগ্ধতাবোধ, যে বিষয়ে তিনি পরবর্তী কালে একটি সাক্ষাৎকারে খোলাখুলি জানিয়েছেন। তাঁদের দুজনের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বারবার মাস্টারদার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, যা সেসময় তাঁরর ভাল লাগেনি।
যাই হোক, পলাতক জীবনে তাঁদের কৃচ্ছ্রসাধনের শিক্ষা দিতেন মাস্টারদা। যেসব বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় নিতেন, সে বাড়িতে অতিথি সৎকারের জন্য তাঁরা যেটুকু ব্যবস্থা করতে পারতেন, তাই হাসিমুখে গ্রহণ করতে হত সকলকে। জনমানসে সূর্য সেনের সম্মোহনী প্রভাব ছিল। সকলে তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। তাই সেযুগে তাঁর মাথার দাম দশ হাজার টাকা ধার্য হওয়া সত্ত্বেও কেউ সে প্রলোভনে পা দেবার কথা ভাবতে পারতেন না। তাই সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্রতম ব্যক্তি, কারও ঘরেই আশ্রয়ের অভাব তাদের হত না। তিনি যেখানেই গেছেন, সেখানেই পেয়েছেন শ্রদ্ধা সম্মান আর ভালবাসা। শেষ পর্যন্ত পলাতকরা যখন দুভাগে ছড়িয়ে পড়বেন ঠিক হল, তখন মাস্টারদার সঙ্গে রইলেন কল্পনা, আর অন্য দলের দায়িত্বে রইলেন তারকেশ্বর দস্তিদার।
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গৈরলা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন মাস্টারদা। কল্পনা ছাড়াও সঙ্গে ছিলেন ব্রজেন সেন, মণি দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী ও সুশীল দাশগুপ্ত। কিন্তু স্থানীয় মানুষ নেত্র ঘোষের বিশ্বাসঘাতকতায় পুলিশ সন্ধান পেল সেই আশ্রয়স্থলের। খবর পেয়ে মাস্টারদা সকলকে নিয়ে অন্য আশ্রয়ে চলে যাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ততক্ষণে বাড়ি ঘিরে ফেলেছে গোর্খা পুলিশ। কল্পনার চোখের সামনেই সামনের ছেলেটি গুলি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। মাস্টারদা জানতেন ওদিকের রাস্তাঘাট কল্পনার অচেনা। তাই তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পেছনের অন্ধকার পথ দিয়ে এগিয়ে চললেন। কিন্তু বিধি বাম। অন্ধকারের মধ্যে একটি ডোবার মধ্যে মাস্টারদার হাত ছাড়িয়ে পা হড়কে পড়ে গেলেন কল্পনা। একই সঙ্গে সেই ডোবায় পড়ে গেলেন মণি দত্ত। ততক্ষণে গোর্খা পুলিশ জড়িয়ে ধরেছে মাস্টারদার কোমর।
বহুক্ষণ জলের মধ্যে শুধু নাক ভাসিয়ে ডুবে রইলেন দুজন। গোর্খা ফৌজ একধরনের হাউই বাজি ব্যবহার করছিল, যার ফলে সমস্ত জায়গা আলোয় ভরে যাচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ জলের মধ্যে লুকিয়ে থাকার পর দুজনে সন্তর্পণে সে-স্থান ত্যাগ করেন। মনের মধ্যে প্রবল আলোড়ন, মাস্টারদাকে ছেড়ে আসার আক্ষেপ।
অবশ্য বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পেয়েছিল নেত্র ঘোষ। সূর্য্য সেনের ফাঁসির দশ দিন আগেই তিনি বিপ্লবীদের হাতে নিজের বাড়িতেই নিহত হন, যদিও সেই বিপ্লবীর নাম পুলিশ জানতে পারেনি। আর সকলে সেই বিপ্লবীর পরিচয় জানা সত্ত্বেও কেউ এগিয়ে আসেনি তাঁর বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে।
সূর্য সেন ধরা পড়ার তিনমাস পর বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী গহিরা গ্রামের পূর্ণ তালুকদারের বাড়ি থেকে ধরা পড়েন কল্পনা ও তারকেশ্বর দস্তিদার। ধরা পড়ার আগে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের প্রচুর গুলি বিনিময় হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে বৃদ্ধ পূর্ণ তালুকদার, তাঁর ভাই নিশি তালুকদার ও বিপ্লবী মনোরঞ্জন দাশগুপ্ত মারা যান। কল্পনা ও তারকেশ্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এক সুবেদার এসে সপাটে চড় মারেন তাঁকে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে অন্য সৈন্যরা প্রতিবাদ করেন সে ঘটনার। সুবেদার আর তাঁকে আঘাত করার সাহস দেখাননি। তাঁদের গ্রেফতার করে হাত বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে। এসময় তাঁর পাশে হাঁটতে থাকা মেজর কিং এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিলেন কল্পনাকে। তিনি তাঁর হাতের চুড়িটা চেয়ে বসলেন বউকে উপহার দেবার জন্য। কল্পনা জ্বলে উঠলেন এই প্রস্তাবে। সতেজে বললেন, ‘তুমি যদি জোর করে খুলে নাও তো আলাদা কথা, কিন্তু আমি নিজে থেকে কিছুই দেব না।’ বিদ্রোহী কন্যার একথা শোনার পর আর চুড়ি খুলে নেবার সাহস দেখাননি মেজর কিং।
শেষপর্যন্ত বিচারে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের হল ফাঁসি, আর কল্পনার হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিচারকের রায় ঘোষণার আগে সবার অলক্ষ্যে তারকেশ্বর দস্তিদার কল্পনাকে বলেছিলেন, ‘তোকে ভাল লাগে। আমার জন্য অপেক্ষা করিস।’ হয়ত তিনি আশা করেছিলেন তাঁর ফাঁসি হবে না। কল্পনা এর উত্তরে কিছুই বলতে পারেননি। তাঁর নীরবতাই ছিল তাঁর স্বীকৃতি। পরে রবীন্দ্রনাথ ও সি এফ অ্যান্ড্রুজের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জেলজীবন থেকে মুক্তি পান কল্পনা। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জেলে সমস্ত প্রোটোকল ভেঙে রাত বারোটায় ফাঁসি হয়ে যায় সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের। বেশ কয়েকদিন পর এ-খবর জানতে পারেন কল্পনা।
পরবর্তী জীবনে কমিউনিস্ট নেতা পি সি‌ জোশীর সঙ্গে বিবাহ হয় কল্পনা দত্তের। তাঁর অগ্নিময় জীবনের এই অতুলনীয় অধ্যায়টি অশোককুমার মুখোপাধ্যায়কে এক সাক্ষাৎকারে জানান তিনি যা সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ১৯৯১ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই সাহসিনীর জীবনাবসান হয়।

Latest article