দিল্লির বুকে আজাদির মহোৎসবে ব্রাত্য বাংলার নেতাজি। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, এই মাতব্বরদের চিরটাকালই না-পসন্দ বাংলার দামাল প্রাণের প্রতিবাদী উদ্গীরন। সিলেবাস ভাঙা, ভালত্বের তকমা ওড়ানো ছাত্রজীবন এদের অসহ্য। অথচ, তেমন ছাত্রদের প্রতিই ছিল নেতাজির প্রীতিপক্ষপাত। মনে করিয়ে দিলেন ঋত্বিক মল্লিক
আরও পড়ুন-প্রয়াত বিশিষ্ট ফুটবলার সুভাষ ভৌমিক, শোকবার্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে মধ্যপ্রদেশের একটি ছাত্রসম্মেলনে সভাপতির ভাষণে আশ্চর্য একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু—‘জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়’। তাঁর শিক্ষা নিয়ে যাবতীয় চিন্তাভাবনাকে এই শব্দবন্ধে সংহত করে আনা যায়। এই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন: ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়া বাহির হইবার পর প্রায় দশ বৎসর আমার কাটিয়া গিয়াছে। এখনও কিন্তু আমি নিজেকে ছাত্র ছাড়া আর কিছুই মনে করিতে পারি না। তবে আমার এই বিশ্ব-বিদ্যালয় আপনাদের বিশ্ব-বিদ্যালয় হইতে একটু বড়ো এবং ব্যাপক। ইহাকে “জীবনের বিশ্ব-বিদ্যালয়” বলিলেই ঠিক হয়।’ তাঁর এই কথার মধ্যে দুটো স্পষ্ট বিভাজনের ইঙ্গিত আছে—‘আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়’ আর ‘জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়’। ‘আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়’ বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন, প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাঁর আত্মজীবনীতে ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গেও এই শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব সবিস্তারে ধরা পড়েছে।
আরও পড়ুন-ঈশ্বরগঞ্জের অমৃতরস
সুভাষের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘ভারত পথিক’ থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯০২ সালে তিনি ব্যাপটিস্ট মিশন পরিচালিত একটি প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন—যা আদতে ছিল ভারতীয় জলহাওয়ার মধ্যেই ছাত্রদের ইংরেজ বানানোর প্রতিষ্ঠান। সেখানে গ্রেট ব্রিটেনের ভূগোল আর ইতিহাস পড়তেই হত, ভারতীয় প্রসঙ্গ সামান্য যেটুকু বরাদ্দ ছিল, সেখানে যাবতীয় ভারতীয় শব্দ উচ্চারণ করতে হত বিদেশি কায়দায়। বাধ্যতামূলক বাইবেল পড়ার সঙ্গে গানের ক্ষেত্রেও ‘সা-রে-গা-মা’র বদলে গাইতে হত ‘ডো-রে-মি-ফা’। ভারতীয় ছাত্রদের ব্রিটিশ মনোভাবাপন্ন করে তোলার যাবতীয় প্রয়াস ছিল পাঠ্যসূচিতে, যা নিয়ে প্রবল অসন্তোষ ছিল সুভাষের:
ভারতে কোন কোন অভিজাত মহলে ছেলেদের ইংলন্ডে পাবলিক স্কুলে পড়তে পাঠানোর যে রীতি প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে, সে সম্বন্ধেও আমি একই কথা বলব। … যে শিক্ষাব্যবস্থা ভারতের অবস্থা, প্রয়োজন ও তার ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানকে অস্বীকার করে, তা নিতান্তই অবৈজ্ঞানিক মনস্তাত্ত্বিক উপায়, শৈশবে ভারতীয় ছেলেদের উপর জোর করে ‘ইংরেজী’ শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং তারা বয়োপ্রাপ্ত হলে তাদের ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিমের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিয়ে আসা। সেক্ষেত্রে তারা নিজেরাই বিচার করতে পারবে যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যে কোনটা ভালো আর কোনটা নয়।
আরও পড়ুন-মেয়েদের খেলা দেখে বাইচুংরা মুগ্ধ
‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ’—একথায় আস্থা ছিল না সুভাষের। পাঠ্যবই পড়া আর মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়ার অধ্যয়ন কোনোদিন তপস্যা হতে পারে না বলেই বিবেচনা ছিল তাঁর। তপস্যার উদ্দেশ্য সত্যকে উপলব্ধি। অধ্যয়নের ফলে উচ্চভাব ও আদর্শ শেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু সেই আদর্শকে হৃদয়ঙ্গম করে কাজে পরিণত করার মাধ্যমে চরিত্র গঠনই তপস্যার লক্ষ্য। পরীক্ষা পাসের ফলে স্বর্ণপদক জুটলেও প্রায়োগিক জীবনে অধ্যয়নের প্রকৃত অর্থ বা উদ্দেশ্য বুঝতে পারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। স্বাভাবিকভাবেই, সুভাষের পক্ষপাত ‘বকাটে’ ছেলেদের দিকে। শ্রীহট্টের ছাত্রসম্মেলনের বক্তৃতায় তিনি লিখছেন:
আজকাল স্কুল ও কলেজে “ভালো ছেলে” নামে একশ্রেণির জীব দেখিতে পাওয়া যায়; আমি তাহাদিগকে কৃপার চক্ষে দেখিয়া থাকি। তাহারা গ্রন্থকীট—পুথির বাহিরে তাহাদের অস্তিত্ব নাই এবং পরীক্ষার প্রাঙ্গণে তাহাদের জীবন পর্যবসিত হয়। ইঁহাদের সহিত তুলনা করুন—“বকাটে” রবার্ট ক্লাইভকে। এই “বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো” ছেলে সাত-সমুদ্র-তের-নদী পার হইয়া অজানার সন্ধানে ভ্রমণ করিতে করিতে ইংরাজ জাতির জন্য সাম্রাজ্য জয় করে। ইংলন্ডের ভালো ছেলেরা যাহা করিতে পারে নাই, করিতে পারিত না, তাহা সম্পন্ন করিল “বকাটে” রবার্ট ক্লাইভ!
সমাজবিচ্ছিন্ন গ্রন্থকীট নয়, সুভাষ চাইলেন চিন্তাশীল, সক্রিয়, আন্দোলনের পথে-হাঁটা ছাত্রসমাজ। ১৯২৮-২৯ সাল থেকেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র ও যুবসম্মেলনে সভাপতি হিসেবে ছাত্রদের উদ্দেশে দেশ গড়ার ডাক পাঠাতে থাকলেন তিনি। ‘নূতনের সন্ধানে’ গ্রন্থে মেয়েদের জন্য আলাদা করে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের অধিকার, ব্যায়াম-লাঠিখেলা-ছোরাখেলা শেখা এবং স্বাবলম্বনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থকরী শিক্ষার কথাও প্রস্তাব করলেন।
আরও পড়ুন-আইপিএল হয়তো এপ্রিলের শুরুতেই
লাহোরে পাঞ্জাব ছাত্রসম্মেলনে বললেন দুটি বিশেষ কর্মধারার কথা। প্রথমত, ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকে নতুন জীবনসন্ধানের নির্দেশ ও নিজস্ব সমস্যার সমাধানের পরামর্শ দিলেন। দ্বিতীয়ত, যাবতীয় বিরুদ্ধ শক্তি, বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যতের প্রশ্নে, সংগ্রামের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে আহ্বান করলেন তিনি। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকছে রাষ্ট্রের কোপে পড়ার। তার জন্য সামরিক শিক্ষার দাবি তুললেন।
এই বক্তৃতাতেই তিনি ছাত্রসংঘগুলোকে এক-একটি যৌথ স্বদেশি ভাণ্ডার (Co-operative Swadeshi Store) খোলার দায়িত্ব নিতে বললেন যাতে, ছাত্রেরা অল্প মূল্যের স্বদেশি জিনিস ব্যবহার করতে পারে এবং তা ক্ষুদ্রশিল্পেরও সহায়ক হয়। তাছাড়া, ছাত্রসমাজের কল্যাণে এর লভ্যাংশ ব্যয় করার সঙ্গে সঙ্গে যৌথ কারবারের অভিজ্ঞতাও হবে তাদের। ব্যায়াম সমিতি, পাঠচক্র, মাসিকপত্র পরিচালনা, সঙ্গীতসমাজ, পাঠাগার, সমাজকল্যাণ সংঘ ইত্যাদি স্থাপন করে সামাজিক স্রোতে সক্রিয় অংশগ্রহণের পরামর্শও দিলেন তিনি।
আরও পড়ুন-রণবীর যেন ’৮৩-র কপিল, বলিউড অভিনেতায় মুগ্ধ সান্ধু
বোঝাই যাচ্ছে, সুভাষের কাছে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফল—‘স্পিরিট অফ অ্যাডভেঞ্চার’! তাঁর আদর্শ ‘জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়’-এর সিলেবাসে রয়েছে স্বাধীনতা, যুব-আন্দোলন, শৃঙ্খলাবোধ এবং সর্বোপরি, মুক্ত মন। বস্তুতপক্ষে সুভাষের শিক্ষাভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে পরাধীন জাতির নৈতিক স্বাবলম্বনের পথসন্ধান—বইয়ের শিক্ষার বদলে ‘সামরিক শিক্ষা’, গুরুর বদলে ‘স্বদেশানুগত্য’ আর স্বার্থের বদলে ‘নিজের দলের সম্মান সম্পর্কে সচেতনতা’ দিয়ে গড়া সুভাষের এই স্বপ্নের পাঠক্রম।