ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামো হল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র বহুত্ববাদ, ব্যক্তি অধিকার। মনে করিয়ে দিলেন মইনুল হাসান
১৯৫০ সালে আমরা গর্ব করার মতো একটি বই উপহার পেলাম, তার নাম ভারতের সংবিধান। প্রায় ৮০ হাজার শব্দের পবিত্র বইটি গণপরিষদে দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনার পর সবাই একমত হয়ে গ্রহণ করা হয়েছিল। সংবিধানের মূল কাঠামো হল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র বহুত্ববাদ, ব্যক্তি অধিকার। আমরা সব ভারতবাসী বন্ধুভাবে পাশাপাশি বাস করছি এই সংবিধানে বর্ণিত স্তম্ভগুলোর জন্য। আশপাশের বহু দেশ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভারত রয়ে গিয়েছে অখণ্ড। তার প্রধান কারণ আমাদের সংবিধান। যা আমাদের জাতীয় ইচ্ছার প্রতীক। স্বাধীনতা সংগ্রামের নির্যাস তার মধ্যে রয়েছে প্রাণবন্ত হয়ে।
আরও পড়ুন-‘বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিতে ভুলবেন না’, সতর্কবার্তা টিকায়েতের
আজ যখন সাধারণতন্ত্র দিবসের কথা ভাবতে যাচ্ছি তখন সংবিধানে বর্ণিত মূল কাঠামোটি কেমন আছে তার দিকে নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে করছি। হিন্দু-মুসলমানে লড়াই করে, রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা এসেছে। আমরা দেশের কথা ভাবছি-ভেবেছি। ধর্ম আছে মনে আর বাড়িতে। ভারতবাসী বলে পরিচয় দিতে আমরা গর্ব অনুভব করি। কিন্তু হঠাৎ আজ সেখানেই আঘাত হেনেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। আমাদেরকে ধর্মের নামে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী পোশাক চিনে ধর্ম চিনে যাচ্ছেন। ধর্ম-সংসদের নামে কুৎসিত হিংসা ছড়ানো হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের নিকেশ করার আহ্বান জানাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। প্রধানমন্ত্রী নীরব। তাদের বিরুদ্ধে সংবিধানসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। মানুষকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তার মধ্যে কোনও গোপনীয়তা নেই। ভারত রাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চস্থান থেকে তার সমর্থন পাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন হবে, সেখানে বলা হচ্ছে মুসলমানদের ভোটের দরকার নেই। অলীক হিন্দুত্বকে উসকানি দিতে প্রধানমন্ত্রী নিজে অযোধ্যা ও বেনারসে উপস্থিত থেকেছেন। যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের চাইতে আলাদা। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আঁতকে উঠছেন। আমাদের সংবিধানে সব ধর্মের, সব সংস্কৃতির সমান অধিকার আছে। সারা দেশে তার নিদর্শন এখন বিরল। আর প্রধানমন্ত্রী এ-সব ব্যাপার নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন।
আরও পড়ুন-কাউন্সিলরদের পাঠ দেবেন ফিরহাদ, অতীনরা
সারা দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার নেই বললেই চলে। আমরা পশ্চিম বাংলায় বসে ব্যাপারটা ততখানি বুঝতেই পারি না। অন্য রাজ্যে গেলেই দেখা যাবে নিজ ইচ্ছায় কাজ করা প্রায় অসম্ভব। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি সব কিছু ঠিক করে দিতে চাইছে। তার জন্য আইন পর্যন্ত করছে। কে কোন পোশাক পরবে, কে কাকে বিয়ে করবে, কে কী খাবে অথবা খাবে না সব কিছু ঠিক করছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। আমরা ভুলে যাইনি লম্বা পোশাক আর মুখে দাড়ি থাকার জন্য খুন হয়েছে জুনাইদ। বাড়িতে নিষিদ্ধ মাংস থাকার অজুহাতে খুন হয়েছে দাদরির আখলাক। গোহত্যা করে চামড়া ছাড়াচ্ছে বলে মার খেয়ে হাসপাতালে গিয়েছে উনার মহেন্দ্র ও তার বন্ধুরা। সমস্ত কাগজপত্র থাকলেও স্বাধীন ব্যবসা করতে পারছে না বহু মানুষ। কারণ হয় তারা সংখ্যালঘু অথবা নিম্নবর্গের মানুষ। বিজেপি তাদের মানুষ বলেই মনে করে না। দেশের সংবিধানে এই আক্রান্ত মানুষের কিন্তু সমানাধিকার আছে। নরেন্দ্র মোদিজি সাধারণতন্ত্র দিবসের ভাষণ দেওয়ার আগে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের চাই।
আরও পড়ুন-টাকিতে ভেষজ উদ্যান
নানা ভাষা নানা মতের দেশ আমাদের। বিশাল দেশে ছড়িয়ে রয়েছে নানা বৈচিত্র। তার সৌরভ নিয়েই আমরা বেঁচে আছি এবং বেঁচে থাকতে চাই। সব কিছুকে ‘এক’ করার খেলায় মেতেছেন আপনি। এই কুৎসিত খেলা সংবিধান মান্য করে না। সব রাজ্য নানা বৈচিত্র নিয়ে আছে। যা সংবিধানসম্মত। কিন্তু নরেন্দ্র মেদি সরকার এ-সবের তোয়াক্কা না করে আরএসএসের কুৎসিত সংস্কৃতিকে সবার জন্য লাগু করতে বদ্ধপরিকর। যা সংবিধান-বিরোধী তো বটেই, দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম যে ভাবনায় হয়েছিল তার বিরোধী। দেশে বহুত্ববাদ না থাকলে নানা ইতিবাচক সমৃদ্ধ চিন্তার সুযোগ থাকবে না। এই সুযোগ সংবিধান আমাদের দিয়েছিল। কেন্দ্রের সরকার তা হরণ করতে চায়। আর যাই হোক সংবিধান নিয়ে তাদের ভাষণ দেওয়া সাজে না।
আরও পড়ুন-লাদাখের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ভারতীয় জাওয়ানদের
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো চলবে দেশে। এটা সংবিধানের উপহার। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এককেন্দ্রিক শাসন চালাতে চান। রাজ্যগুলির কোনও কথা শুনছেন না। রাজ্যগুলির পাওনা টাকা দিচ্ছেন না। কর বিতরণে বৈষম্য। রাজ্যের অংশ থাকলেও কেন্দ্রের নামে প্রকল্প হচ্ছে। রাজ্যপালকে দিয়ে সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীদের উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে এবং তা শালীনতার সীমা পেরিয়ে গিয়েছে। পশ্চিম বাংলা, মহারাষ্ট্রের বা কেরলের রাজভবন যেন বিজেপির দলীয় অফিসে পরিণত হয়েছে। যেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কামান দাগা হচ্ছে। সম্প্রতি আইএএস-দের নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মোদি সরকার, তাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নষ্ট হবে, নষ্ট হবে সংবিধানের মাধুর্য।
আরও পড়ুন-লাদাখের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ভারতীয় জাওয়ানদের
সংবিধান তৈরির পিছনে গণপরিষদে যেমন আলোচনা হয়েছে এবং গৃহীত হয়েছে। তেমনি সারা দেশের দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রামের ছায়া আছে সংবিধানের পাতায়। সেটাই নন্দলাল বসুর তুলি-অলঙ্কৃত হয়েছে। সংবিধান আমাদের সকলের। সকল ভারতবাসীর। মোদিজি এটা পাল্টে কেশব ভবনের বই চালু করতে চান। আমরা তা হতে দেব না, দেশবাসী তা হতে দেবে না।
প্রধানমন্ত্রীজি সংবিধান নিয়ে আপনার ভাষণ সাজে না।