পঞ্জিকার তিথি মেনে শ্রীপঞ্চমী অতিক্রান্ত। এ বছরের মতো সরস্বতী পুজো হয়ে গেল। কিন্তু বিদ্যাদেবীর আরাধনায় সক্রিয় অংশ নেওয়ার স্মৃতি সাহিত্য কলা ও বিদ্যা চর্চার সঙ্গে জড়িত যাঁরা তাঁদের জীবনে ও স্মৃতিতে কাচের গুঁড়ো হয়েও চিরন্তন স্থায়িত্ব আদায় করে নেয়। নস্টালজিয়া টেনে নিয়ে যায় স্মৃতির সরণিতে। বর্তমানকে ঘিরে ফেলে অতীতের আবেশ। তেমনই স্মৃতি নস্টালজিয়ায় নিজেকে ভেজালেন শিল্পী শুভাপ্রসন্ন
আমাদের শৈশব জীবন অনেক আনন্দময়, স্বপ্নমাখা, ভাবনা-চিন্তাহীন ভেসে যাওয়ার টুকরো টুকরো মুহূর্তের ঝালমলে কোলাজ। সেই কোলাজ জুড়ে যেমন শীতে জবুথবু কুয়াশামাখা শহরের ধূসরতা ছিল, গাছেদের পাতা ঝরানোর অনুষঙ্গ ছিল, তেমন বসন্তের রঙিন চ্ছটায় জীবনের জয়গানও ছিল। সে রঙ জমাট বাঁধা আমের মুকুল হয়ে, রঙ বেরঙের দোপাটি, গাঁদা, ডালিয়া হয়ে ঝরে পড়ে আজও, অর্পনের ওঁম মেখে বীণাপানি বন্দনায়।
আরও পড়ুন-মাওবাদীদের বিস্ফোরক প্রাণ কাড়ল সাংবাদিকের
আমি তখন কলেজ স্ট্রিটে থাকি। হিন্দু স্কুলে পড়ি। সবার বাড়িতে পুজো হত। কিন্তু ইস্কুল ছিল সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গা। আমরা সকলে স্কুলে জড়ো হতাম। সুন্দর প্রতিমা আসতো। একতলার একটি শ্রেণীকক্ষে পুজো হত। সুন্দর করে সেই ঘরটি সাজানো হত। আমরা সহযোগিতা করতাম। ঠাকুরমশাই অঞ্জলি দেওয়াতেন। অঞ্জলি দেওয়ার পর খাওয়া দাওয়া হতো।আড্ডা হতো।সবাই মিলে বেঞ্চেতে বসে লুচি বেগুনভাজা খাওয়া হতো । হৈ হৈ করে কেটেছে সেসব দিন। যা কোনদিন ভোলার নয়!
এরপর নিজেদের স্কুল থেকে দলবেঁধে অন্য স্কুলে যাওয়া হত। দেখা হত কে কেমন সাজিয়েছে। আমাদের হিন্দু স্কুলের পাশেই হেয়ার স্কুল, সংস্কৃত স্কুল। আমরা সেখানে যেতাম। আর একটু এগিয়ে মেয়েদের স্কুলেও ঢুকে পরতাম। মেয়েরা কী সুন্দর পরিপাটি করে শাড়ি পরতো। অনেকের ওটাই হয়তো প্রথম স্বরস্বতী পুজো উপলক্ষে শাড়ি পড়া। এটাই যেন রীতি। যা চিরন্তন। আজও সেই উৎসাহে কোন ভাটা দেখিনা।
আরও পড়ুন-স্কুলের সরস্বতী পুজোর থিমে নারায়ণ দেবনাথ
আমরা টোপাকুল খাওয়ার জন্য স্বরস্বতী পুজোর অপেক্ষায় থাকতাম। নিয়ম ছিল স্বরস্বতী পুজোর আগে কুল, কুলের চাটনি খাওয়া যাবে না। আর এই প্রতীক্ষাই কুল খাওয়ার আনন্দকে আরও দ্বিগুণ করে দিতো !
বাকদেবীর আরাধনা কে কেন্দ্র করে প্রকৃতি ও আমাদের আটপৌরে জীবন এভাবেই অনাবিল আনন্দে মেতে উঠত। যার রঙ আমাদের গোটা জীবনের ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আরও পড়ুন-স্কুলের সরস্বতী পুজোর থিমে নারায়ণ দেবনাথ
আমরা যাঁরা ছবি আঁকি, কবিতা লিখি, গান গাই সকল সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষানুরাগী মেতে থাকি এই পুজোকে কেন্দ্র করে। সর্বত্রই পুজো হয়। যেমন দুর্গাপুজো নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় তেমন স্বরস্বতী পুজো নিয়েও হয়। আমার মনে আছে বহু আগে একটি প্রতিষ্ঠান আমাকে নিয়ে গেছিল স্বরস্বতী ঠাকুর দেখতে।যদিও সেটা কোন বড় বিষয় নয়।
তবে দেখেছি, মহাশ্বেতার যে অসাধারণ শ্বেত-শুভ্র রূপ তা অনেক সময়ই তালগোল পাকিয়ে যায় শিল্পকর্মের আতিশয্যে। অনেকে রঙিন করে তোলেন দেবীমূর্তিকে। যা আমার ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ।শুভ্রতার মধ্যে যে নিজস্ব সৌন্দর্য,সৌম্য, প্রজ্ঞা আছে , এক্ষেত্রে তা অন্য যে কোন রঙের ছোঁয়ায় অধরা থেকে যায়।
শীত কমে এসেছে, খয়েরি পাতা ঝরে সবুজ পাতা বেরোচ্ছে,ফুল ফুটছে, আমে মুকুল ধরছে, চারিদিক ফুলে ফলে ভরে যাচ্ছে,এই যে জীবন, বসন্তের জীবন, প্রকৃতির এতো আনন্দ আয়োজনের সাথে একাত্ম হওয়া,উপলব্ধি করাই তো বীণাপানি আবাহনের মূল উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন-সরস্বতী পুজোয় অভিষেক-পুত্রের হাতেখড়ি
এই যে প্রকৃতির শোভা, যা আমরা অনেকাংশে নষ্ট করে ফেলেছি।শহরাঞ্চলে দুষণের জন্য অনেকসময় শহরবাসীর কাছে তা অপ্রত্যক্ষই থেকে যায় । তবে আমি যেহেতু সল্টলেক বিধাননগরের বাসিন্দা, তাই জানি বিধাননগরে এখনও পর্যন্ত প্রচুর সবুজ আছে। গাছপালা আছে। আর এখানে প্রকৃতির রূপ, বসন্তের আগমনে দেখা দেয়, তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। বিদ্যা আমাদের সজাগ ও সতর্ক হতে শেখায়। মুক্তচিন্তার রসদ যোগায়। আমরা যা পালন করি, আনন্দ পাই, সেই নিয়েই জীবন চলে।তাই আমাদের কাছে বসন্ত কালে বাকদেবীর আরাধনা আসলে ‘প্রকৃতি-পূজা-প্রেমের’ ত্রিবেণী সঙ্গমে পুণ্যস্নান।বুকভরা তাজা বাতাস। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।
আর এই শ্রীপঞ্চমী তিথিতে অবগাহন করতে করতে মন গাইছে —“আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে।”