কবিতা উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতো। অসংখ্যের জন্য নয়। নির্দিষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ। একমাত্র দীক্ষিত পাঠকই পারেন কবিতার রস আস্বাদন করতে। যদিও পাঠকের মুখাপেক্ষী থাকেন না কবি। তিনি সৃষ্টি করেন আপন খেয়ালে। আসলে প্রকৃত কবির যাপন প্রত্যাশাহীন। প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তিনি কিছু করেন না।
চারটি কবিতার বই পড়তে পড়তে মনের মধ্যে জন্ম নিল এলোমেলো কথাগুলো। চার কবি, চার সময়ের। দুজন যাপন করেন চিরসবুজ গ্রামীণ জীবন। দুজন নাগরিক। সংক্ষিপ্ত আকারে সাজিয়ে দিলাম তাঁদের কাব্যগ্রন্থের পাঠ-প্রতিক্রিয়া।
অলক জানা-র কবিতার বই ‘শঙ্খরাগের ছায়া’। প্রকাশিত হয়েছে কবিতিকা থেকে। ৩২ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ২৬টি কবিতা। প্রত্যেকটি কবিতাই ছোট, এক পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। দীর্ঘদিন ধরেই এই কবি কাব্যচর্চায় নিমগ্ন। আগেও প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই। তাঁর কবিতার মধ্যে বারবার ফিরে ফিরে আসে প্রকৃতির কথা, মানুষের কথা।
আরও পড়ুন-প্রয়াগরাজ নিয়ে কেন চুপ বিজেপি ? বিজেপিকে তোপ চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের
প্রথম কবিতা ‘সুচেতনা’। কবি লিখছেন :
‘সাবালক ইচ্ছে ভাগ করে নিতে হয়,/ দায় থাকে, দায় ছিল বলেই তো সুচেতনা/ লতা হয়ে যায়, আশ্রয় খোঁজে/ হৃৎস্পন্দনের অগভীর তলায়।’
বিশুদ্ধ প্রেমের উচ্চারণ। তবে গতানুগতিক নয়। ‘সাবালক ইচ্ছে’ এবং ‘দায় থাকে’ উচ্চারিত হয়েছে গভীর তলদেশ থেকে। শুরুতেই পাঠককে বাধ্য করে কবিতার শেষ পর্যন্ত, বইটির শেষপর্যন্ত যেতে। এই সুচেতনা আশ্রয়ের খোঁজে লতা হয়ে যায়। লতা। মানবী যেন মুহূর্তেই হিস-হিস সর্পিনী হয়ে ওঠে। ঘটে একীভূত কল্পনার প্রকাশ।
পরের স্তবকের শুরুতে কবি লিখছেন :
‘ছায়া দিতে হয়, সব গাছের জানা নেই’।
সরল পঙক্তি। বুনে দেওয়া হয়েছে কর্মসচেতনতার প্রসঙ্গ। এই গাছ শুধুমাত্র গাছ নয়, মানুষও। সমগ্র কবিতা জুড়ে লেগে রয়েছে অদ্ভুত এক মায়া। পাঠের পরেও কিছুক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
আর একটি কবিতায় যাওয়া যাক। শিরোনাম ‘পত্রালাপ’। শুরুতেই চমকে দেওয়ার মতো একটি পঙক্তি :
‘আপত্তি কিংবা না শব্দ দুটি অন্ধকার চরিত্রের মতো।’
তারপরে কবি লিখছেন :
‘কেবল বাদসাধতেই জানে—/ এই নির্জন রেখার ওপর সান্ধ্য উদাস কথারা/ জোনাকি চঞ্চলতায় ঝুলে পড়লে, অন্তর্গত/ গুমোট দহনে হঠাৎ বৃষ্টি-প্রলাপ/ সমস্ত অবিশ্বাস ভেঙে রোগমুক্তি উপাখ্যান।’
অংশটি যথেষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন। অন্ধকার চরিত্রের মতোই। দীর্ঘ মনোনিবেশ দাবি করে।
আরও পড়ুন-অসমের রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি পদে রিপুন বোরা
পরের স্তবকে কবি লিখছেন :
‘তোমার মুখে ওই শব্দ দুটি বেমানান বেশ/ গাছ হতে চেয়ে করতলে তুলে নিয়েছ সম্ভাবনার/ ছাড়পত্র, অতল নৈরাশ্য থেকে মুক্তি দিতেই না/ তোমার ওই আগুন তপস্যা?/ একটা সকাল লিখতে গাছ জরুরী একটা/ কবিতা কিংবা একটা দেশ!’
এইখানেই কবিতাটি আলোকিত হয়, পৌঁছে যায় অসামান্য উচ্চতায়। একজন প্রকৃত কবিই লিখতে পারেন ‘গাছ হতে চেয়ে করতলে তুলে নিয়েছ সম্ভাবনার/ ছাড়পত্র।’ সম্ভাবনা। এক বৃহৎ প্রকাশের।
ভালো লাগে ‘বারান্দাপুরের কোণ’, ‘স্নানঘর’, ‘বারান্দা’, ‘বিষাদ’, ‘শঙ্খরাগের ছায়া’, ‘নির্ভরতা’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। কমলেশ নন্দর প্রচ্ছদ প্রশংসনীয়।
পরের বই লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডলের ‘মনস্কাম ছুঁয়ে দেখো’। গতবছর প্রকাশিত হয়েছে শব্দরং হাউস থেকে। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ৪৮টি কবিতা। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরেই। এর আগে প্রকাশিত হয়েছে কবির বেশ কয়েকটি কবিতার বই।
আলোচ্য বইটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে ছকভাঙা কবিতা। প্রায় প্রতিটি কবিতাই লিখিত হয়েছে টানা গদ্যে।
আরও পড়ুন-ইউক্রেনকে এবার ফিনিক্স ঘোস্ট ড্রোন দেবে আমেরিকা
‘রোমান্টিক’ শীর্ষক কবিতায় চোখ রাখা যাক :
‘রাতপাখির কোন সাঁঝবেলা নেই, জ্যোৎস্না থাক আর না থাক ঝিঁঝির শব্দে মিশে যায় ডানা/ তেড়েফুঁড়ে উঠে যাওয়া কাণ্ডের মাথায় আকাশের ভার; সে রমনী ঈশ্বরী হতেই মাথার কাপড়ে পলিমাটির নিত্যদিন/ হাতের নৈবেদ্য নিয়ে এত স্থির হতে পারিনি কোনদিন; অসুখের সময়ে রক্তজবার টব পুড়িয়ে দেয় বিছানার আকার/ অথচ জীবনের একটাই শর্ত– হাঁটতে হবে ঋণ নিয়ে– শালিকের বাসাভরা চোখে যখন সমুদ্রের উচ্ছ্বাস/ ফুলের পায়েল বাজুক; নদী ভেজাতে ভেজাতে ছটপট করা চাঁদে নির্বাসন ফেলে রাখি, হত্যা করি নিজের সকাল সন্ধ্যা দুপুর।’
অনবদ্য একটি কবিতা। ‘রাতপাখির কোন সাঁঝবেলা নেই’ প্রকাশটি মন ছুঁয়ে যায়। আসলে রাতপাখির সাঁঝবেলা তো ভোরের সমান। একটা শুরু। কবিতা জুড়ে দেখা যায় বাস্তব এবং পরাবাস্তবতার মিশ্রণ, অসমতলের মতো ওঠানামা। ‘জীবনের একটাই শর্ত– হাঁটতে হবে ঋণ নিয়ে’ উচ্চারণে ঘটে এক অমোঘ সত্যের প্রকাশ। বার বার নিতে হয় সার্থক কবিতাটির সুবাস।
‘অনাত্মীয়া নীলসন্ধ্যা’ কবিতায় কবি লেখেন :
‘নীল সন্ধ্যার আকাশে নৌকাটি পাল তুলে ভেসে যায়– সন্ধান করে গাঙচিলের বিষাদ। বাতাসের উন্মাদকাল ভেদ করে এগিয়ে যায় দিগন্ত নেশায়, রং-বেরঙের কৃতকর্মের ফল খুঁজে মৃত্যুর পোশাক : কত গভীর এই বৈশাখের বিকেল আর উষ্ণ স্বর— সজোরে হাল ধরে থাকি— ভিজে যায় পেশির ভাঁজ দিয়ে যতসব অমাবস্যার মরা কোটাল ভরা কোটাল/ এই নৌকার মাঝি আমিই।’
আরও পড়ুন-ঠিকাদাররাজ চলবে না
কোথাও কোথাও অসামান্য চিত্রকল্প ফুটে ওঠে। পরমুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। কোথাও আলো, কোথাও কালো। একটি অক্ষর থেকে আর-একটি অক্ষর ছুঁয়ে পৌঁছে যাই এক অচেনা জগতে। অভিজাত কুয়াশায় মোড়া। আকাশের বুকে নৌকা ভাসাতে গিয়ে কোনো এক ‘আমি’ও ঢুকে পড়ে কবিতার অন্দরে। কে এই আমি? কবি? নাকি সময়? রাতের চাঁদের মতো প্রশ্ন জেগে থাকে।
ভাল লাগে ‘ধূপগন্ধী’, ‘নিঃসঙ্গ পাঁচালি’, ‘উত্তরীয়’, ‘আস্তিক’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। অর্পণের প্রচ্ছদ যথাযথ।
গত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে শঙ্কর ঘোষের কবিতার বই ‘দীপক দাসকে খুঁজি’। ২২ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ২১টি ছোট কবিতা। আগেও প্রকাশিত হয়েছে কবির একাধিক বই।
আলোচ্য বইটির কয়েকটা কবিতার উপর চোখ রাখা যাক। ‘গনগনে দৃশ্যপটের দিকে’ কবিতায় কবি লেখেন : ‘লাঙলের ফলায়, কখন যে আটকে ছিল/ মহামূল্যের স্বর্ণমাদুলি– বুঝিনি আগে…/ হঠাৎ, ঝাঁক থেকে ছিটকে আসা একটা পাখি/ গনগনে দৃশ্যপটের দিকে– লাল কালিতে/ লেখে কবিতা– রাঢ় রুক্ষ মহিমান্বিত/ সোঁদা মাটির গন্ধ মেখে…।’
অসামান্য একটি সৃষ্টির কবিতা। নবজন্মের কবিতা। রুক্ষ জমিতে ফসল ফলানোর কবিতা। আধার কি শুধুই মাটি? দেহ নয়? অজান্তেই কবিতাটি হয়ে ওঠে তুমুল শরীরী। তবে ছকবাঁধা শরীরী নয়। আরও কিছু, আরও আরও কিছু। চোখের সামনে এক অজানা জগৎ উন্মোচিত হয়। যে জগতের শীর্ষে রয়েছে এক আলোকবিন্দু। যেতে হয় অন্ধকার ফুঁড়ে।
আরও পড়ুন-জল অপচয় বন্ধে ফিরহাদের পদক্ষেপ
‘দীপক দাসকে খুঁজি’ কবিতায় কবি লিখছেন :
‘ওহে করিম, বহুকাল ঘুম নেই/ দীপক দাসকে খুঁজি—বোশেখের/ তপ্ত শহরের মাথার উপর/ ভাঙা কাঠামোয়…/ দীপটাকে ঘষে দিলেই শৃঙ্গভাঙা বরফের চাঙড়/ সুন্দরবনের বাঘ তোমার সামনে/ দাসানুদাস…।’
কে এই দীপক দাস? মনে প্রশ্ন জাগে। দীপক যদি হয় আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ, তাহলে দাস হতে পারে আজ্ঞাবহ দৈত্য। পাশাপাশি মনে হয়, দীপক দাস তিনিই, যিনি মুহূর্তে করেন অসাধ্যসাধন। সমাজে, সংসারে। এক অসামান্য জাদুকর। তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেন কবি। অবিশ্বাস্য অসাধ্যসাধনের। তাই তিনি নিদ্রাহীন, অনন্তকাল। কবিতাটির মধ্যে একটা অদ্ভুত টান আছে। কিছুতেই বেরোতে দেয় না। শব্দ ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন কবি।
ভালো লাগে ‘পথের শেষ’, ‘নারী বলি’, ‘সমাজ’, ‘যামিনীর তৃতীয় প্রহরে’ প্রভৃতি কবিতা। প্রচ্ছদশিল্পী কৌশিক দাস।
অঞ্জনা দেব রায়-এর কবিতার বই ‘রেডহাউস ও অন্যান্য কবিতা’। প্রকাশিত হয়েছে গতবছর। এটাই কবির প্রথম কবিতার বই। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে ৫৬টি কবিতা।
আলোচ্য বইটির প্রথম কবিতা ‘রেডহাউস’। শুরুটা এইরকম :
‘মহাকাশের ভিতরে পৃথিবীর মানচিত্র জ্বলজ্বল করছে/ আকাশ জুড়ে অস্তমিত সূর্যের লাল রঙ ছড়িয়ে পড়েছে।/ গায়ে গায়ে পর্বত, জঙ্গল, পার্বত্য নদীর দস্যিপনা/ মানুষের লোকালয়, অন্নময় শরীরের উদ্বেগ ও আশা।’
দ্বিতীয় পঙক্তির ‘অস্তমিত সূর্যের লাল রঙ’ কি কোনো বিশেষ সময়ের উল্লেখ করে? হয়তো। কবিতাটিকে জীবন্ত করে তোলে ‘পর্বত, জঙ্গল, পার্বত্য নদীর দস্যিপনা’ অংশটি।
আরও পড়ুন-বাটলার বিক্রমে দিল্লির হার, বিতর্ক
পরে কবি লেখেন :
‘সবুজ গাছের ঢিবি, ঘরে ঘরে আশা প্রত্যাশার মজলিস/ নানা রঙের পোশাক ঘুরছে, নাচছে, হাসছে/ বাতাসে উড়ে যাচ্ছে/ একঝাঁক লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা।’
এই কবি সমাজ সচেতন। প্রকাশের জন্য নিয়েছেন কিছুটা সান্ধ্যভাষার আশ্রয়। হেঁটে যাচ্ছেন বলা ও না-বলার মাঝের আলপথ ধরে। কবিতাটি এখানেই শেষ নয়। বাকিটা তোলা রইল আগ্রহী পাঠকের জন্য।
এরপর যাওয়া যাক ‘শপিং মল’ কবিতায়। কবি লিখছেন :
‘শব্দের পর শব্দ ছুঁয়ে যায় এখানে/ শব্দের ইশারা চলতে থাকে/ দোকানে দোকানে ঘিরে ঝুঁকে থাকে/ সারি সারি মুখ/ টেবিলে টেবিলে সাজানো থাকে/ ফার্স্ট ফুডের সমাহার/ অযথা উৎসুক সবাই/ অর্থহীন শব্দদূষণে/ পরিবেশ হয়ে ওঠে ভার/ কর্মহীন ব্যস্ততার মগ্ন অলসতায়/ গড়ে ওঠে শব্দের উৎসব।’
শুরু হয়েছে খুব সাধারণ ভাবে। মাঝখানে এসে নিয়েছে অদ্ভুত এক বাঁক। প্রথম ধাক্কা লাগে ‘অর্থহীন শব্দদূষণে’ অংশে। শোনা যায় শঙ্খনাদ। তারপরে কবি লিখছেন ‘কর্মহীন ব্যস্ততার মগ্ন অলসতায়/ গড়ে ওঠে শব্দের উৎসব।’ তীব্র শ্লেষ ঝরে পড়েছে উচ্চারণে। ‘কর্মহীন ব্যস্ততা’য় ঘটেছে তার চরম প্রকাশ। কবিতাটি সার্থক।
ভাল লাগে ‘নীল আকাশ’, ‘বৃষ্টির দিনে’, ‘একঝাঁক পাখি’, ‘স্পর্শকাতর’, ‘অবিশ্বাসের ঝড়’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। কুমকুম দাশের প্রচ্ছদ কবিতার মতোই সুন্দর।
বিশুদ্ধ কবিতার জলে ভিজতে চাইলে চারটি বই সংগ্রহে রাখা যেতে পারে।