ব্যাদে সব আছে। এই ভাবনায় তাড়িত হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টারা স্কুলে বৈদিক শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে তৎপর। এনসিইআরটি-র এই প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? বিশ্লেষণে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের প্রদেশ-ব্যাপ্ত বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে এই অলৌকিক খবর এসেছে আমাদের শ্যাম বঙ্গদেশে— স্কুলের ছাত্রদের এবার থেকে বেদ পড়তে হবে। NCERT-র ডিরেক্টর সাহেব দীনেশপ্রসাদ সালকনি এখন তৈত্তিরীয় উপনিষদের আচার্যের ভূমিকায় আছেন। শিষ্যরা যখন আরও বেশি জ্ঞানলাভের মধ্যে যাবে, ঠিক তার আগে গুরুকুলের অন্তেবাসী শিষ্যদের উদ্দেশে তৈত্তিরীয় উপনিষদের আচার্য বলছেন—বৎসগণ! সত্য কথা বলবে অর্থাৎ প্রমাণের মাধ্যমে তুমি যা জেনেছ, সেই সত্যটাই তুমি বলবে— সত্যংবদ। ধর্মং চর। অর্থাৎ শাস্ত্র যেভাবে তোমার কর্তব্যকর্ম করতে বলেছে, তুমি সেই ধর্ম আচরণ করো। তারপরেই সেই বিখ্যাত কথাটা যেটা আচার্য দীনেশপ্রসাদ বলছেন— স্বাধ্যায়াৎ মা প্রমদঃ— অর্থাৎ ‘স্বাধ্যায়’ থেকে কখনও বিরত হোয়ো না।
আরও পড়ুন-ঝড়ে বিমান, তদন্তের নির্দেশ
যাঁরা সমাজ-সংরক্ষণশীল মানুষ তাঁরা ‘স্বাধ্যায়ে’র অর্থ বলেছেন বেদপাঠ। তার মানে, বেদ পড়া ছেড়ো না কখনও। আজ এতকাল পরে, মানে তৈত্তিরীয় উপনিষদ লেখার আড়াই হাজার বছর পরে সেই ঔপনিষদিক আচার্য সালকনি-রূপে অবতার গ্রহণ করে লোকশিক্ষে দিয়ে বলছেন— এখন থেকে বেদ-বেদাংশ তোমাদের পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে আসবে। বৎসগণ! তোমরা বেদপাঠ থেকে বিরত হোয়ো না— স্বাধ্যায় প্রবচনাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্।
আজকে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাই যে, ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় বেদ পড়তে আমাদের কোনও আপত্তি নেই, বিশেষত সেটা যদি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পঠিত হয়। কিন্তু সেখানেও আমাদের জিজ্ঞাসা হবে— ইতিহাসের কোন উপাদানগুলি আপনারা সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের পড়তে বলবেন। বেদ মোটেই ছোট্ট একখানি গ্রন্থ নয় এবং গ্রন্থটি যথেষ্ট life-affirming গ্রন্থ, তথাচ এখানে প্রায় অনন্ত মন্ত্রের মধ্যে অনন্ত ঐতিহাসিক উপাদান লুকিয়ে আছে। আর এইখানেই দীনেশপ্রসাদ সালকনির রাজনৈতিক উপাদানের প্রশ্ন উঠে যায়। বিচ্ছিন্নতাবাদের উপাদানে তৈরি এক সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে তো বেদের মতো এক উদার এক মহাগ্রন্থের ততোধিক উদার এক বেদমন্ত্র পাঠ্য হিসেবে উৎসারিত হতে পারে না।
আরও পড়ুন-ডাকঘরের গাফিলতি ভোগান্তি সাধারণের
এমন তো হতে পারে না যে, সালকনি-সাহেব বৈদিক কালের খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে সেই অংশটা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়তে দেবেন, যেখানে বলা যাবে যে দ্যাখো ছাত্ররা! পরিপূর্ণ বৈদিক কালে যে বিরাট যাগ-যজ্ঞের আড়ম্বর তৈরি হয়েছিল, সেখানে যজ্ঞে ষাঁড়ের মাংস কিংবা বন্ধ্যা গরুর মাংস দেবোদ্দেশে আহুতি দেবার জন্য ঋষিরা বলছেন— হে ইন্দ্র, তোমার জন্য পুরোহিতদের দিয়ে স্থূলকায় একটি বৃষ পাক করেছি, সঙ্গে সোমরসও আছে, তুমি এসো— অমা তে তুম্রং বৃষভং পচানি। কিংবা দেবেন কি পাঠ্য হিসেবে এই অংশটা যেখানে ইন্দ্রদেবতার এক পুত্র একটি যজ্ঞ করছেন, যেখানে অন্য দেবতাদের সঙ্গে ইন্দ্রেরও আসার কথা ছিল, কিন্তু তিনি আসতে পারেননি। এই অবস্থায় ইন্দ্রপুত্র বসুক্রের স্ত্রী একটু দুঃখ করেই বলছেন— সমস্ত দেবতারাই এই যজ্ঞে এলেন, কিন্তু আমার শ্বশুরমশাই ইন্দ্রই এলেন না। যদি তিনি আসতেন, তাহলে ঘিয়ে ভাজা যবের ছাতু খেতে পেতেন, সোমরসও পান করতে পারতেন— জক্ষীয়াদ ধানা উত সোমং পপীয়াৎ। ইন্দ্রের পুত্রবধূ অবশ্য এখনও আশা ছাড়েননি। তিনি শ্বশুর ইন্দ্র-দেবতার উদ্দেশে বলছেন— খানিক লোভ দেখিয়েই বলছেন— পাচকরা খুব ভাল করে ষাঁড়ের মাংস রান্না করেছে, তুমি খাবে এসো, আহুতি এখনও চলছে— পচন্তি তে বৃষভাঁ অৎসি, তেযাং পৃক্ষেণ যন্মঘবং হূয়মানঃ।
আরও পড়ুন-ডাকঘরের গাফিলতি ভোগান্তি সাধারণের
এই তো বৈদিক যুগের খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস— ধানা, করম্ভ, অপূপ-পিঠের সঙ্গে ষাঁড়ের মাংস এবং সোমরস। এবং ইতিহাসের এই উপাদানও তো আছে যে, কীভাবে আস্তে আস্তে বৈদিকেরা এটাও বুঝলেন যে গোমাংসের থেকে গরুর দুধের উপযোগিতা বেশি এবং যজ্ঞে গোবধ বন্ধ হয়ে গেল বৈদিকের সপ্রশংস মন্ত্রবর্ণে— হে হত্যার অযোগ্য অহনণীয়া গাভী! তুমি শোভন শস্য-তৃণাদি ভক্ষণ করো এবং প্রভূত দুগ্ধবতী হও— অদ্ধি তৃণমঘ্ন্যে বিশ্বদানীং/পীব শুদ্ধমুদকমাচরণ্ডী।
গোমাংস ভক্ষণ থেকে গোবধ বন্ধ হয়ে যাবার এই যে ইতিহাস— এই পাঠ্য কি দীনেশপ্রসাদ অনুমোদন করবেন? অনুমোদন করবেন কি ঘোষা, অপালা অথবা লোপামুদ্রার মন জাগানো ‘উইমেন সেক্সুয়ালিটি’র ইতিহাস? অথবা দার্শনিক ভাবনা বহু দেবতার যাগ-যজ্ঞে ক্লান্ত ঋষি যখন একেশ্বরবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে মনের ‘ফ্রাস্ট্রেশন’ ব্যক্ত করছেন এই ভাষায়— দিন দিন কত আর আগুনে ঘি পুড়িয়ে কোন দেবতাকে আহ্বান করব আমরা— কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। বৈদিক ঋষির এই ক্লান্ত বিপর্যস্ত মন্ত্রই কিন্তু ঔপনিষদিক ব্রহ্মের তত্ত্ব-তালাশের প্রথম সোপান— ইতিহাসের এই উপাদানটা কি গ্রহণ করবেন মহান-সাজা কেন্দ্রীয় বিদ্বানেরা।
আরও পড়ুন-বন থেকে আয়ের লভ্যাংশ পাচ্ছেন বনরক্ষকরা, রাজ্য বন দফতরের অভিনব উদ্যোগ
কেন্দ্রীয় বিদ্বান, যাঁরা স্কুল-সিলেবাসের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত পণ্ডিতদের মতামত গ্রহণ করেন না। নিজেরাই যাঁরা স্বনির্বাচিত ‘আত্মমতভক্ত’ তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে স্বমেহনী ‘সিলেবাস চর্চা’ করেন, তাঁরাই মাঝে মাঝে আকাশবাণী করে বলছেন— বেদের অংশ আসতে পারে সিলেবাসে, আসতে পারে বৈদিক কালের অঙ্ক-ভাবনার ইতিহাস? এই সব শব্দ করে দীনেশপ্রসাদ জল মাপার চেষ্টা করছেন। —এরপর আগামিকাল