বুলডোজার এখন আর শুধু যন্ত্র নেই। বিজেপি’র হাতে একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। দিল্লি সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একটার পর একটা এলাকা, বস্তি, বাড়িঘর, দোকানপাট ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। কোনও কোনও জায়গায় আদালতের স্থগিতাদেশ মানছে না। বেশির ভাগ জায়গায় ভাঙবার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ঘর-বাড়িগুলোকে। শাহিনবাগ, ফ্রেন্ডস্ কলোনি, মদনপুরী, জাহাঙ্গিরপুরী ও মদনপুর খদর— দিল্লির এই এলাকাগুলিতে ‘বুলডোজ’ করা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের। এলাকার নামগুলি গালভরা। কিন্তু খেটে খাওয়া নিরন্ন মানুষরা সেখানে বাস করেন বেশি।
আরও পড়ুন-বিএসএফের অত্যাচারের প্রতিবাদে পথ-অবরোধ
জাহাঙ্গিরপুরীতে তো রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? খলের কোনও ছলের অভাব হয় না। সবাই নাকি দেশদ্রোহী? বিজেপি’র গড়পড়তা মনোভাব মুসলমান মানেই দেশদ্রোহী। সে কারণে তাদের পাঠানো বুলডোজার যন্ত্রটি বেছে বেছে মুসলমানদের বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙছে। সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে একটা সরকার নাগরিকদের ন্যূনতম অধিকার রক্ষা করতে পারছে না। এমন দুর্যোগ ভারতে কোনওদিন আসেনি। দেশের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করছেন। এই নীরবতা যে তাঁর সম্মতি তা ভাবতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। শুধুমাত্র দিল্লি নয়, দেশের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে একই কাণ্ড ঘটছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের মূলস্রোতের জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। হরিয়ানা সহ ২-৩টি রাজ্যে প্রকাশ্যে নমাজ পড়া বন্ধ করা হয়েছে আইন করে।
আরও পড়ুন-উত্তর দিনাজপুরে কৃষকরত্ন ৯ জনকে
ইদের দিনে গুরগাঁওতে জাতীয় সড়কে বিশাল জামাত হত। মাত্র ১ ঘণ্টার জন্য রাস্তাটি বন্ধ থাকত। এখন সেসব বন্ধ। উত্তরপ্রদেশে আইন করে পশু কোরবানি বন্ধ করা হয়েছে। সংবিধানে নির্দিষ্ট করা আছে, সব ধর্ম সম্প্রদায়ের ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের অধিকার থাকবে। এসবের কোনও তোয়াক্কা বিজেপি সরকার করছে না। আদতে এটা একটা সংবিধান বিরোধী সরকার। জনবিরোধী সরকার। কেবলমাত্র মুসলমান নয়, নিম্নবর্গের সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
আরও পড়ুন-চালসা স্টেশনে গাছ পড়ে বন্ধ ট্রেন চলাচল
ইতিহাসের পাতা থেকে সমস্তরকম মুসলমান অনুষঙ্গ বাদ দেবার পরিকল্পনা বিজেপি’র বহুদিনের। সেই কারণে সর্বভারতীয় ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রগুলির ধর্মনিরপেক্ষ অবয়ব নষ্ট করে আরএসএস-র মানুষদের বসানো হয়েছে। তাদের মাথা থেকে অদ্ভুত সিলেবাস পরিকল্পনা বেরিয়েছে। ঔরঙ্গজেব নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিছু মানুষ জানে আকবর কেমন শাসক ছিলেন। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের মতে, ভারত অতীতে দু’জন খুবই জনদরদি শাসক পেয়েছে— যাঁরা কেউ হিন্দু নন। মহামতি আকবর ও মহামতি অশোক। আজ গেরুয়া পক্ষের তথাকথিত পণ্ডিতরা আকবরকে খলনায়ক ও অত্যাচারী শাসক হিসাবে ইতিহাস লিখেছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে সরকারি সমর্থনে বিভিন্ন শ্রেণিতে তা পড়ানো হচ্ছে। একটা জাতির মেরুদণ্ড ভাঙতে হলে তার শিক্ষাক্ষেত্র তছনছ করে দিতে হবে। এই পথে এগিয়ে যাচ্ছে বিজেপি সরকার।
আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাজমহল ও কুতুবমিনার নিয়ে বিতর্ক। তাজমহল নাকি তেজো মহালয়। তার ২২টি ঘরে নাকি নানারকম প্রতিমা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বিজেপি’র পক্ষ থেকে এই মর্মে একটি মামলা করা হয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্টে।
উচ্চ আদালতের রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মামলাকারীদের বলেছেন, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, পিএইচডি করে, প্রকৃত ইতিহাস জেনে এখানে আসবেন। কবে হাইকোর্টের এজলাসে এসে বলবেন— এর নিচে কী আছে তা দেখবেন। এসব চলতে পারে না। এমনই ঘটনা ঘটছে কুতুবমিনার নিয়ে। একটার পর একটা মামলা হচ্ছে ‘বিষ্ণুস্তম্ভ’ নাম করার জন্য। এখন কেউ কুতুবমিনার চত্বরে গেলে দেখতে পাবেন পরিবেশ একেবারে পাল্টে ফেলা হয়েছে। কেন্দ্রের সরকার নীরব। দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদের উপর এতবড় আঘাত আসেনি।
আরও পড়ুন-ময়নাগুড়ি নাবালিকা-কাণ্ডে মুখ পুড়ল বিজেপির, রাজ্যের তদন্তে হাইকোর্টের আস্থা
উত্তরপ্রদেশের জ্ঞানব্যাপী মসজিদ নিয়ে মামলা চলছে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরে অবস্থিত জ্ঞানব্যাপী মসজিদে থাকা শৃঙ্গার গৌরী স্থলে প্রতিদিন প্রবেশ-অনুমতি চেয়ে মামলা হয়েছে। যদিও সীমিত প্রবেশের অনুমতি আছে। আসলে বিজেপি মসজিদটিকেই বন্ধ করে দিতে চায়। মসজিদের গেট ভেঙে ফেলার হুমকি দিচ্ছে বিজেপি। এছাড়াও মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি ও শাহি ইদগাহ মসজিদ নিয়ে মামলা চলছে। বিজেপি-র দাবি, শাহি ইদগাহ মসজিদ-এর প্রায় ১৪ একর জমি শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমিকে ফেরত দিতে হবে। মুঘল আমলে মন্দির ভেঙে নাকি শাহি ইদগাহ মসজিদ তৈরি হয়েছে। কিন্তু কত বৌদ্ধস্তূপ নষ্ট করে যে মন্দির তৈরি হয়েছে তার হিসাব কে রাখে?
আরও পড়ুন-অবশেষে হেরিটেজ তকমা পেল পশ্চিম মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি গড়
কর্নাটকে নির্বাচন ২০২৩ সালে। তার আগে তীব্র হয়ে উঠল বোরখা বিতর্ক। পোশাক বিধি বনাম শিক্ষা। বিশেষ করে নারীশিক্ষা। আদালতে আপাতত রাজ্য সরকার জিতেছে। কিন্তু মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে নির্বাচনে যাবে বিজেপি। বোরখা বিতর্কে এটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে কোথাও সংবিধান নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু ও দলিতদের অধিকারে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে না। কোটি কোটি মানুষ মানসিক দিক দিয়ে বিপন্ন। সেখানে কোনও ৩৫৫ বা ৩৫৬-র গল্প নেই। কারণ ঘটনাগুলির পক্ষে আছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। কিন্তু সেদিনের আর দেরি নেই যেদিন তাঁদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সমগ্র ভারতবাসীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।