১৯৩০ সাল। সারা ভারত জুড়ে শুরু হয়েছে গান্ধীজির ডাকে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন। এ বছরই ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ‘পূর্ণ স্বরাজ’ প্রস্তাব গ্রহণ করার অব্যবহিত পরেই মহাত্মা গান্ধী আমেদাবাদের কাছে তাঁর সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করে ২৪ দিনে ২৪০ মাইল (৩৯০ কিলোমিটার) পথ পায়ে হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে সমুদ্রের জল থেকে লবণ প্রস্তুত করেন। বিরাটসংখ্যক ভারতীয় তাঁর সঙ্গে ডান্ডিতে আসেন। ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬টার সময় গান্ধীজি লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁর লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেন। এই আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই বদলে গেল।
আরও পড়ুন-বড় পর্দায় প্রথম মর্জিনা সাধনা বসু
আর এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই ভারতের ইতিহাসে একটি নাম উঠে এল, যাঁকে ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ বলেছেন আধুনিক ভারতের রূপকার। যিনি নিজের হাতে লবণের প্যাকেট বানিয়ে ‘মহাত্মা গান্ধীর জয়’ বলতে বলতে বোম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে এবং পরে হাইকোর্টের সামনে তা বিক্রয় করতে এসে নিয়মভঙ্গের কারণে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করলেন।
এই মানুষটি কোনও পুরুষ নন। গান্ধীর ডাকে যেসব মহিলা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়। জন্ম ৩ এপ্রিল ১৯০৩ সালে, ম্যাঙ্গালোরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাবা অননথায়া ধারেশ্বর ও মা গিরিজবাঈ। পেশায় সিভিল সার্ভিস পিতার চতুর্থ কন্যা কমলা অল্প বয়স থেকেই অন্য বালক-বালিকার থেকে অনেক বেশি দৃঢ়চেতা এবং সাহসী ছিলেন। তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, গোপালকৃষ্ণ গোখলে এবং রামাবাই রানাডে এবং অ্যানি বেসন্তের মতো মহিলা নেতা-সহ অনেক বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। ফলে ছোট থেকেই কমলাদেবী স্বদেশি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হন।
আরও পড়ুন-কবির সহধর্মিণী
১৯১৭ সালে ১৪ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়, কিন্তু বিয়ের দু বছর পরে তিনি বিধবা হন। তারপরে মায়ের উৎসাহে চেন্নাইয়ে রানি মেরি কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানেই সরোজিনী নাইডুর ছোট বোন ও ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির নেত্রী সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি কমলাদেবীকে তাঁর ভাই হারিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। হারিন্দ্রনাথ ছিলেন কবি-নাট্যকার-অভিনেতা। তাঁর সঙ্গে প্রেম করে কমলাদেবীর বিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়। সেইসময়ে বিধবাবিবাহ এক ভয়ঙ্কর কঠিন কাজ ছিল। তবে নিজেদের একই ভাবনাকে পাথেয় করে দুজনে একসঙ্গে অনেকদিন পথ চলেছিলেন। বিবাহের অল্পসময় পরে, হারিন্দ্রনাথ লন্ডন ভ্রমণে চলে যান এবং কয়েক মাস পরে কমলাদেবীও সেখানে গিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেডফোর্ড কলেজে ভর্তি হন ও সমাজবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। বহুবছর পর হারিন্দ্রনাথের সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কমলাদেবীই ছক ভেঙে বিচ্ছেদের আবেদন করেন।
আরও পড়ুন-বঞ্চনার জবাব চায় আইএনটিটিইউসি
লন্ডনে থাকাকালীনই কমলাদেবী ১৯২৩ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে উৎসাহী হন। এবং অবিলম্বে দেশের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত গান্ধী সংগঠন সেবা দলে যোগদান করার জন্য ভারতে ফিরে আসেন ও এই দলের মাধ্যমে নারীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে একত্রিত করতে শুরু করেন।
১৯২৬ সালে তিনি মাদ্রাজের প্রাদেশিক বিধানসভায় অংশ নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স (এআইডাব্লিউসি)-এর প্রতিষ্ঠাতা মার্গারেট ই ক্যাসিন্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরের বছর তিনি অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার প্রথম সংগঠনিক সচিব হন। তিনিই প্রথম ফ্যাক্টরিতে এবং খামারে নারীদের কাজের উন্নততর পরিবেশ এবং মাতৃকালীন ছুটির ব্যবস্থা করতে নারীদের হয়ে আন্দোলন শুরু করেন।
আরও পড়ুন-পেগাসাস কমিটির মেয়াদ বাড়িয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট
অবশ্য স্বাধীনতার পর প্রথাগত রাজনীতি থেকে দূরে সরে সামাজিক কাজে নিয়োজিত হন। প্রথমেই তিনি শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য মনোনিবেশ করেন। তাঁর ইন্ডিয়ান কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের জমির ব্যবস্থা, গৃহনির্মাণ, ক্ষুদ্র কর্মশালা ও কারখানা তৈরিতে সাহায্য করে। এরপর শুরু হয় সমবায় সংগঠন বিদ্যালয়, হাসপাতাল।
১৯৫০ সাল থেকে ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ও ঐতিহ্যমণ্ডিড, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং লুপ্তপ্রায় হস্তশিল্পের উন্নয়নের জন্য অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্রাফট বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। কুড়ি বছর এই দায়িত্ব সামলাবার সময় দেশের কোনায় কোনায় হস্তশিল্পীদের সমবায় সংস্থা গড়ে তোলেন। শুধু তা-ই নয়, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজের উৎকর্ষতাকে সম্মান দেবার জন্য পুরস্কার প্রদান শুরু করেন। রাজ্যগুলিকেও হস্তশিল্পীদের থেকে সরাসরি সামগ্রী কেনার জন্য অনুরোধ করেন।
আরও পড়ুন-সৌরভের নতুন ঠিকানা রডন স্ট্রিট
এ-ছাড়াও তাঁর সক্রিয় উৎসাহ ও পরিচালনায় গড়ে ওঠে ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা, সংগীত নাটক আকাদেমি, ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশানাল সেন্টার।
তিনি এর আগে অবশ্য স্বামীর পরিচালিত কয়েকটি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন, এমন এক যুগে যখন অভিনয় ভদ্র পরিবারের মহিলাদের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হত। হারিন্দ্রনাথের পরিচালনায় মৃত্তিকাটিকা, তানসেন, শঙ্কর পার্বতী, ধনা ভগতে তাঁকে পাওয়া যায়। নাটক থেকে শুরু করে সিনেমায় অভিনয়, তারপরে গান্ধীজির ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়া, একইসঙ্গে প্রথম মহিলা হিসাবে বিধানসভা ভোটে লড়া, আবার প্রথম মহিলা হিসাবে ব্রিটিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া— বারবার সামাজিক প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন কমলাদেবী। ভারত সরকার ১৯৫৫ সালে পদ্মভূষণ ও ১৯৮৭ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন তাঁকে। ১৯৬৬ সালে পান রামন ম্যাগসেসে পুরস্কার ও ১৯৭৪ সালে সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার।
আরও পড়ুন-কংগ্রেসের আশা নেই, গুজরাত–হিমাচলের ভোট নিয়ে মত পিকের
একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা এই আধুনিক নারীর মৃত্যু ১৯৮৮ সালে মুম্বইয়ে। তাঁকে হয়তো আজ অনেকেই ভুলে গেছেন, কিন্তু ভারতের আধুনীকীকরণের পুরোধা কমলাদেবী এক যুগের স্রষ্টা নারী হিসাবে ইতিহাসের পাতায় নীরবে স্থান করে নিয়েছেন।