২০২১, পশ্চিমবঙ্গ (Trinamool Congress Government) রাজ্য বিধানসভায় কংগ্রেস শূন্য, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট শূন্য। কেউ কি এটা ভাবতে পেরেছিলেন? বহু দাপাদাপি ও আস্ফালন সত্ত্বেও বিজেপি পেয়েছে ৭৭টি আসন। ‘দোশো পার’ সম্ভব হয়নি। মমতা একাই ২১৩+। মানতেই হবে বিজেপি আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে অনেকটাই।
কেন এমন হল? সরকারের সামাজিক প্রকল্পগুলির সাফল্য একটা বড় কারণ। বিশেষ করে নারী ক্ষমতায়নে সরকারি উদ্যোগ, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতি বুনিয়াদি ক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রম পশ্চাদ্পদ পশ্চিমবঙ্গেকে (Trinamool Congress Government) অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া জেলাগুলি এখন অনেকটাই অগ্রসর। অনেক প্রাণবন্ত।
আসলে, একটি সরকারের সার্বিক সাফল্য নির্ভর করে সরকারের মূল পলিসি বা নীতির উপর। সেই নীতিসমূহই আমাদের আলোচ্য বিষয়। সরকারের অভিনব সামাজিক প্রকল্পগুলির তথ্যভিত্তিক আলোচনা চলছে, চলবে। বিরোধীদের নেতিবাচক সমালোচনা আছে, থাকবে। আমরা সরকারের পলিসিগুলির উপরই আলোচনায় জোর দিচ্ছি। বর্তমান আলোচনার ক্ষুদ্র পরিসরে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। সরকারি নীতির মূল কয়েকটি বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। সেই আলোচনায় প্রবেশ করছি।
প্রথমত, রাজ্যের (Trinamool Congress Government) মুখ্যমন্ত্রী রূপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিকাঠামো ও মানবোন্নয়নকে একসূত্রে গ্রথিত করে ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার চালু ধরার বিপরীতে এক মানবমুখী উন্নয়নের বিকল্পধারা গড়ে তুলেছেন। মৌলিকভাবে জোর দেওয়া হয়ছে পশ্চাদ্পদ অঞ্চল ও সেখানকার মানুষের উন্নয়নে। অতিমুনাফার অর্থনীতিকে লাগামছাড়া প্রশ্রয় না দিয়ে সামাজিক প্রয়োজনীয়তার অর্থনীতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্ব-নির্ভর গোষ্ঠীগুলির বিকাশে, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে। বিনিয়োগের অভিমুখ বদলানো হয়েছে। গরিব মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে নিয়মিতভাবে। কৃষিক্ষেত্রে নগদ সাহায্য, বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষতিপূরণ, বিনামূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন-সহ নানা ক্ষেত্রে সরকার থেকেছে মানবমুখী। প্রতিটি ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। নজর রাখা হয়েছে পরবর্তী বিকাশের দিকে।
আরও পড়ুন: সমস্যার কথা শুনতে দুয়ারে অঞ্চল সভাপতি
দ্বিতীয়ত, রাইটার্স বা নবান্নের ঠান্ডাঘর থেকে প্রশাসনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তৃণমূল স্তরে। জেলায়-জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকের এক বিরল নজির সৃষ্টি করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই বৈঠকগুলিতে রাজ্যস্তর থেকে শুরু করে জেলা, মহাকুমা, ব্লকস্তরের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা, বিভিন্ন চেম্বার অফ কমার্সের প্রতিনিধিরা, শিক্ষক-ছাত্র প্রতিনিধি-সহ জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন। জেলাগত কাজের সার্বিক পর্যালোচনা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হয় এই বৈঠকগুলিতে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক পরিচালনা করেন। এরই বর্ধিত রূপ হল দুয়ারে সরকার ও পাড়ায় সমাধান কার্যক্রম। এর মাধ্যমে ব্যাপক জনসংযোগ হয়। সরকারি প্রকল্পগুলির সাহায্য যাঁরা পাননি, তাঁদের দ্রুত সেগুলি পাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এতে সরকারি কাজের ঘাটতি মেটে। নাগরিক সচেতনা বাড়ে। সরকারি কাজে বহু মানুষের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত হয়। পার্টি নির্ভরতা কমে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এ-হেন নজির পশ্চিমবাংলায় সম্ভব হয়েছে।
তৃতীয়ত, বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশ প্রশাসনকে সংযত রেখে পুলিশি গুলিচালনার সুদীর্ঘ জনবিরোধী ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তিকে রোধ করা গেছে। কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট আমলের ধারাবাহিক গণহত্যার ঘটনা এখন ঘটে না। বগটুইয়ের ঘটনা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
চতুর্থত, গত ১১ বছরে পশ্চিমবাংলায় সরকারি নির্দেশে কোথাও কারও এক ইঞ্চি জমিও জোর করে দখল করা হয়নি। রাজ্যে বিকল্প পুনর্বাসন না দিয়ে কাউকে তাঁর জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়নি। বরং বহু মানুষকে দখলিকৃত জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে। জমি থাকলে অনেককে বাড়ি তৈরির জন্য সাহায্য দেওয়া হয়েছে। কখনও গীতাঞ্জলি প্রকল্পে, কখনও-বা বাংলা আবাস যোজনায়।
পঞ্চমত, এই ১১ বছরে গণ-আন্দোলনে গুলিচালনার ঘটনা একেবারেই বিরল। বরং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করেছেন। বামফ্রন্টের আমলে নীতি-বহির্ভূত অল্পবেতনে বহু নিয়োগ হয়েছিল। বর্তমান সরকার তাঁদের সকলকেই কাজে বহাল রেখেছেন এবং সম্মানজনক মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
ষষ্ঠত, সরকারি ক্ষতিপূরণ এবং সহায়তা বিলির ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের বরাবরের নির্দেশ হল, কোনও ক্ষেত্রেই ‘আমরা’ ‘ওরা’ না-করা। যোগ্যতা অর্জনকারী সকলেই যেন সরকারি সহায়তা পান। সরকার সর্বদা এই অবস্থানে অনড় থেকেছে।
সপ্তমত, রাজ্য সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্ম-নিরপেক্ষতার নীতিতে অবিচল থেকে বিভাজনের রাজনীতির বিরোধিতা করে। মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেন, ধর্ম যাঁর যাঁর, উৎসব সবার। তাই এ রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমরা নিরাপদে বসবাস করেন। সাম্প্রদায়িক হানাহানির অপচেষ্টা দেখা দিলেই তাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার কাজে সরকারি প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর।
অষ্টমত, পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নন্দন-চত্বর থেকে বের করে গণ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে সরকার। সংস্কৃতি জগতের পুরোধাদের সরকারি স্বীকৃতি প্রদান, খেলাধুলা-মেলার সুযোগ বৃদ্ধি-সহ একটা মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বহুল প্রশংসিত। সভ্যসমাজে সাংস্কৃতিক জাগরণ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রকে আলোকিত করে, মূল্যবোধের উন্নতি ঘটায়। রাজ্য জুড়ে সেরকম এক অভিযান চলছে। যেতে হবে বহু দূর।
নবমত, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বারবার যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছেন। লড়ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিট কর্তৃত্ববাদী-স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। বাংলা ও বাঙালির উপর যে কোনও আক্রমণের বিরুদ্ধে সরকার রুখে দাঁড়ায়। বাংলা ও বাঙালিকে হেয় করার কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার তৎপর। তাইতো বিজেপির ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্লোগানকে হারিয়ে দিল ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’— এই স্লোগানটি।
আরও কিছু বিষয় আছে। স্থানাভাবে সবটা লেখা গেল না। আলোচ্য নীতিগুলি ১১ বছরে রাজ্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। বদ্ধদশা থেকে রাজ্যকে সচল করেছে। গতিশীল করেছে। কর্মনাশা ধর্মঘট, হরতাল, বন্ধে আর স্তব্ধ হয় না পশ্চিমবঙ্গ। তাই সার্বিকভাবে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। তার স্বীকৃতি মিলছে সর্বত্র। অবিরাম কাজ করে চলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তিনি আজ তাঁর নীতি ও কাজের জোরে গোটা ভারতের অন্যতম মুখ। পথপ্রদর্শক।