মোদি জমানায় মিডিয়া অষ্টপ্রহর পদ্মকীর্তন

গণমাধ্যম এই পোস্ট ট্রুথ বাস্তবতায় একেবারে অন্যরকম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাঁর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়াতেই যাবতীয় বিবমিষা। মোদি জমানার আটকাহনে এটাই চরম সত্য। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Must read

মিডিয়া (Media) শব্দটি এসেছে মিডিয়াম শব্দ থেকে। পৃথিবীর সমস্ত অভিধানেই মিডিয়াম শব্দটি কিন্তু বহুবচনে ব্যবহৃত হয়। মিডিয়াম-এর বাংলা আমরা করি মাধ্যম। এখানে মাধ্যম মানে একজন মানুষের আরেকজন মানুষের কাছে তথ্য বিশ্লেষণ করা বা কোনও কনটেন্ট কমিউনিকেট করা। অর্থাৎ সংযোগ করা অন্য আরেকটা মানুষের সঙ্গে। একটি পিঁপড়ে যেরকম তার শুঁড় দিয়ে অন্য একটি পিঁপড়ের কাছে তার সংবাদ প্রেরণ করে ঠিক সেইভাবে মানুষও আরেকটা মানুষের কাছে যোগাযোগ স্থাপন করে কোনও না কোনও মাধ্যমে। একটা সময় সাংবাদিকতার সূত্রপাত হয়েছিল ছাপাখানার মধ্য দিয়ে, প্যাপিরাসের মধ্য দিয়ে। তারপর সেটি ইলেকট্রনিক্স যুগে অবতীর্ণ হল। তারপর এখন আমরা পৌঁছে গেছি ডিজিটাল মিডিয়ার (Media) যুগে, সোশ্যাল মিডিয়ার পরিসরে। এখন তো এমন একটা পরিস্থিতি যেখানে একটা ইমোজি একটা কনটেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সংবাদমাধ্যমে বলা হয় ‘কনটেন্ট ইজ দ্যা কিং’।

নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ২০১৪ সালে। আর ‘পোস্ট ট্রুথ’ নামক শব্দটি জন্ম নিয়েছে ২০১৬ সালে। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ২০১৬ সালে এটি ‘ওয়ার্ড অফ দা ইয়ার’ বলে চিহ্নিত হয়। ২০১৬ সালে এটা অভিধানেও এই পোস্ট ট্রুথ ফ্যাকচুয়াল। আমরা বলছি উত্তর-সত্য বা সত্যযুগ এটা কিন্তু ২০১৬-এর বেশ কয়েক বছর আগে থাকতেই ফেনোমেনাল হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের আগে তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখন থেকেই আমেরিকান সংবাদমাধ্যম এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়ার (Social Media) ওপর বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে গবেষণা করেন। এই ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। একটা জিনিস তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে একটা পারসেপশন তৈরি করা সম্ভব। যদি কোনও কনটেন্ট না থাকে শুধু বায়বীয় অস্তিত্ব দিয়ে একটা ধারণাকে আমজনতার মনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেই পারসেপশন তৈরি করার জন্য যদি নানাবিধ উপাচার সংগ্রহ করা যায়, উপাদান তৈরি করা যায় তবে সেক্ষেত্রে জনমতকে সেই প্রবাহে পরিচালিত করা সম্ভব। তার কারণ বিপুল জনসংখ্যার দেশে এটা সম্ভব নাও হতে পারে, তৈরি করাটা কঠিন হতে পারে। কিন্তু এই বিপুল জনসমাজে চিরকালই একটা পলিটিক্স অফ পারসেপশন কাজ করেছে। গান্ধীজি যদি তাঁর ফকিরের পোশাক না পরতেন, ট্রেনে থার্ডক্লাসে ট্রাভেল না করতেন তবে গান্ধীজির সম্পর্কে তৈরি হওয়া যে অবভাস সেটা কতটা তৈরি হত সেটা কিন্তু আজও গবেষকদের চর্চার অভাব নেই। জওহরলাল নেহরুর জন্মদিনকে শিশুদিবসে পরিণত করা হল। তখন সাদা-কালো ছবি দিয়েও জওহরলাল নেহরুর শিশুদের নিয়ে এবং বুকে লাল গোলাপ দিয়ে একটা ভাবমূর্তি তৈরি করা কিন্তু হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক সমাজের প্রক্রিয়াটিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। এই অভিমত তৈরির রণকৌশলটাকে অনেক গবেষক অভিহিত করেছেন যে জনমত উৎপাদন করার খেলা। যাকে বলা হয় ম্যানুফ্যাকচার পাবলিক ওপিনিয়ন। এই কাজটা করার জন্য দরকার একটা ভিন্ন তথাকথিত মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সমর্থন। কিন্তু তিনি প্রথমে পাননি। ঠিক যেমনভাবে তিনি প্রথমে আমেরিকার ভিসা পাননি। এমনকী লন্ডনও তাঁর পক্ষে ছিল না। উল্টে আমেরিকার বিরোধিতার জন্য চিন তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেছিল মহাসম্মানে যখন তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু প্রথমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা তার পরে লন্ডনের সঙ্গে বনিবনা এবং ধীরে ধীরে আমেরিকার যোগসূত্র তৈরি হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী দেখল যে মোদির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ভারতে বেড়ে গেছে। তখন স্বভাবতই ক্ষমতা-তত্ত্ব অনুসারে তারা মোদির প্রতি তাদের সুর নরম করল।

আরও পড়ুন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা মউ রোমানিয়ার

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দীপঙ্কর সিংহ আজকের গণতন্ত্রের নামকরণ করেছেন ‘মিডিয়াটাইস গণতন্ত্র’ এবং এই মিডিয়াটাইস গণতন্ত্রে এক ধরনের মিডিয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সরকার একদিকে। যেরকম নানান ভাবে তাদের প্রচারিত যে তথ্য সেই তথ্যগুলোকে তুলে ধরেন। অনেকটাই একমুখী একটা কমিউনিকেশনের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি প্রথম দিন থেকেই এগিয়ে গেছেন। মেইনস্ট্রিম বৃহৎ সংবাদপত্রকে কার্যত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় (Social Media) নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়ে নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা টুইটার, সোশ্যাল মিডিয়া অনেক বেশি হ্যান্ডেল করে তাদের কাছে একটা নতুন যুগের ভোরের স্বপ্ন দেখিয়ে তিনি কিন্তু ২০১৪ সালে অবতীর্ণ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতাশ ব্রিটিশবাসীর কাছে যে রকম একটা জেমস বন্ডের প্রয়োজন ছিল সেরকম সত্তরের দশকে একটা বিক্ষুব্ধ সময় হওয়ায় যখন বেকারত্ব বেড়ে গেছে, দারিদ্র্য বেড়ে গেছে সেই সময় যেরকম একটা অমিতাভ বচ্চনকে বলিউড তৈরি করেছিল ঠিক সেইভাবে অনেকটা ফিল্মের কায়দাতেই নরেন্দ্র মোদি তৈরি হলেন ২০১৪ সালে। আমজনতার কাছে এক হিন্দু হৃদয়সম্রাট। যিনি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করবেন এবং ভারতে অর্থনৈতিক সংস্কার এনে তিনি একটা অশ্বমেধের ঘোড়া যেন চালিয়ে নিয়ে যাবেন। মনমোহন সিংহ সরকারের পঙ্গু নীতি, দুর্নীতি যখন মানুষকে হতাশ করেছে তখন নরেন্দ্র মোদির এই কৌশল সফল হল। কিন্তু ২০১৪-র পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে নরেন্দ্র মোদি আজ পর্যন্ত কোনও সাংবাদিক বৈঠক করেননি। যাকে বলা হয় কথোপকথনের সংস্কৃতি। সেই কথোপকথনের সংস্কৃতি কিন্তু নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। করণ থাপারের সাক্ষাৎকারে নরেন্দ্র মোদি রাগত উঠে চলে গেছিলেন, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এমন কোনও সাক্ষাৎকার তিনি দেননি যেখানে তাঁকে খুব কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। *******(বাকি অংশ আগামিকাল)

Latest article