সেকালের শাশুড়ি, একালের শাশুড়ি। সেকালের শাশুড়ি— গণ্ডাখানেক ছেলেমেয়ে। কোলেরটির যখন মুখেভাত, বড় মেয়ে তখন আঁতুড়ে। সেকালের শাশুড়ির একাধিক জামাতা— তাদের ভিন্ন ভিন্ন স্ট্যাটাস, স্ট্যান্ডার্ড, চাহিদা। কেউ আবার দোজবরে। কেউবা পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদায় গর্বিত। অর্থে অহংকারী, বেহিসেবি। কেউ কেউ সংকীর্ণমনা, ইনস্যাটিয়েবল, যার মানে সহজে খুশি হয় না, মনে সন্তোষ নেই। সেকালের শাশুড়ির জীবনধর্মই সংসার। আট ঘণ্টা ঘুম বাদ দিলে বাদ প্রায় পুরো সময়টাই সংসারের কাজে ব্যয় করেন। রাঁধার পর খাওয়া। খাওয়ার পর রাঁধা। তিনি কখনওই সংসারের লায়াবিলিটি নন, বরং, সংসারের সবকিছু এবং সব সদস্যের মনোরঞ্জন করাই তাঁর লায়াবিলিটি। আমরা এখানে এই শাশুড়ির মহত্তর মাতৃরূপটিকে এবং মানবিক সত্তাটিকে অতিরিক্ত বলে বা অতি-স্বাভাবিক বলেই ধরে নিলাম। তাঁর মাতৃত্ব যেন সেই হিসেবখাতার ওঁ চিহ্নের মতো— সবসময়ই উপরে থাকে এবং বর্ষিত হয়।
আরও পড়ুন-আলবিদা…
একালের শাশুড়ি নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির এক ব্যস্ত সদস্য। একাকিনী। কর্মরতা অথবা সংসারে নিজের মতো ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। খুব বেশি চাপ সহ্য করতে পারেন না। বিলাস অভিপ্রায়িণী। উচ্চ-মধ্যবিত্ত হলে অভাব-অনটন চেনেন না। অনেকে কিউলিনারি ক্লাশ করেন। আগেকার শাশুড়িদের মতো রন্ধনপটীয়সী নন। আগেকার শাশুড়িরা হাজারো পদ রান্না করে পাত সাজিয়ে পাখার হাওয়া করে জামাইদের খাওয়াতেন। একালে কুলার, এসির চল। শাশুড়ির যদি রান্নার দিকে ঝোঁক থাকে বা কোনও হবি থাকে তাহলে ব্যাপারটা উতরে যায়। কিন্তু, একালের শাশুড়ি যদি কর্মজগতে দীর্ঘ ইনিংস খেলে ক্লান্ত থাকেন এবং নতুন ধারার সামাজিক নিয়মকানুনের শিক্ষায় পূর্ণ শিক্ষিতা হন তাহলে জামাইদের প্রতি তাঁর ট্রিটমেন্ট একটু অন্য রকম। তখন রেস্তরাঁ বা হোটেলের মেনু দেখে আগে থেকেই খাবারদাবার ঠিক করা থাকে। মিসেস চ্যাটার্জি হয়তো বলবেন, আমার জামাই বিরিয়ানি-পাগল, মিসেস মজুমদার জানেন, তাঁর জামাইয়ের পাতে একটু কচি পাঁঠার মাংস বা লবস্টার তুলে দিলেই জামাইয়ের মুখে চাঁদের হাসি।
আরও পড়ুন-পাশের হারে এগিয়ে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর
সেকালে জামাইষষ্ঠীর শেষে কন্যাবিদায় কালে উপঢৌকন বা উপহার দেওয়ার রীতি ছিল, কিন্তু এখন তা রেওয়াজ বা আ মাস্ট টু ডু হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপহারের অপশনও প্রচুর— প্রয়োজনে ক্রেডিট কার্ড ‘টু বি ইউজড’। দায় এড়াতে গিফ্ট ভাউচার। আর বাড়তি খুশির জন্য জামাইকে সঙ্গে নিয়ে শপিংমল যাত্রা। সেকালের শাশুড়িরা জামাইকে আপনি আজ্ঞেও করতেন, বাবা-বাছা বলতেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেন। অনেকে আবার অতি স্নেহশীলাও ছিলেন।
আরও পড়ুন-রৌনকে উজ্জ্বল
একালের শাশুড়িরা জামাইকে প্রায়শই সন্তান স্নেহে তুইও বলেন। একালের শাশুড়িরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক কন্যার জননী। অথবা যেকোনও একটি প্লাস। একালের কন্যাদের বাপের বাড়িতে আজকাল একটা কর্তৃত্ব থাকে থাকে, অধিকারবোধ থাকে। সেহেতু পরিবারে জামাইয়ের পোজিশনেরও ওঠানামা থাকে।
জামাইষষ্ঠীর দুটো সামাজিক উপাদান, এক পূজা— তিলক, তাগা, ধান-দুব্বো, প্রদীপ ও প্রসাদ; দুই, ভূরিভোজন পর্ব। সেকালের জামাই মাটিতে বসত, একালের জামাই টাকায় বসে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ইটারি— এই তাদের রসনাবিলাস। একালের শাশুড়িরা অনেকেই জামাইষষ্ঠীর স্পিরিচুয়াল অংশটি তুলে দিয়েছেন। শাশুড়ি বা জামাই বা মেয়ে নাস্তিক হলে যা হয়! কিন্তু অনুষ্ঠানের বিলোপ হয়নি। আহারে আত্মনিবেদন হান্ড্রেড পার্সেন্ট। তার উপর রাম, ভদকা, শ্যাম্পেন, পকোড়া, ফিশফ্রাই, কাবাব— যার যেমন ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড। ক্রেডিট কার্ড কখনও কখনও উভয় পক্ষেই উচ্ছৃঙ্খল হয়। কিন্তু, জীবন তো বিন্দাস, সামনে এসকালেটর, উপরে উঠে যাও, যেভাবেই হোক ওঠো। সব পাবে। একালের সুবিধা শাশুড়িরা জামাইকে একটু বেশি মাত্রায় কাছে টানতে পারেন। জামাই সন্তানতূল্য। কোনও কোনও সময় পুত্রের অধিক। একালের জামাইরাও আর আগের মতো সংসারের সংকীর্ণতা আর ইগোর বশবর্তী নয়। আগের মতো সে ভাবনা আর নেই। তারাও শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব নেয়। বিপদে-আপদে পাশে থাকে। অসুস্থ হলে পাশে থাকে। মরে গেলে ছেলের মতো মুখাগ্নিও করে।
আরও পড়ুন-১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে বাধ্য হল ইসিএল, ধরনায় বসে দাবি আদায়
তবে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত অস্বীকার করা যায় না। আগেকার দিনে সুপাত্র জামাতাও যেমন ছিল, তেমনই সামাজিক দর্শনটি ছিল শ্বশুরবাড়ি মানেই পরের বাড়ি। ছেলের মা, ছেলের বাবা পুত্রকে বারবার এই কথা বারবার মনে করিয়ে দিতেন যে স্ত্রীর বাবা-মা কখনওই নিজের বাবা-মা হতে পারে না। সুতরাং তাদের বাবা-মা বলে ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই । ব্র্যাকেটে যে কথাটা থাকত তা হল দায়-দায়িত্ব না নিয়ে নিজের সুবিধা ও স্বার্থ সিদ্ধ কর। অন্যদিকে আরেকটি বাক্য, স্বতঃসিদ্ধ কথা জন-জামাই-ভাগনা তিন নয় আপনা। আপনারাই বলুন না ব্যাপারটা কি তাই? যদিও এ-পৃথিবীতে সবকিছুই নশ্বর, কেউ কারও নয়, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, অচেনা-অজানা তাহলে দু’দিনের এই পৃথিবীতে সমস্ত সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে একটু বেঁধে বেঁধে থাকলে ক্ষতি কী? রক্তের জোরের থেকেও স্নেহ, ভালবাসা ও মানবিক সম্পর্কের জোর অনেক বেশি দামি।