মধ্যরাতে ঘুম ভাঙিয়া যায়। ‘সন ইন ল’-দের লইয়া লিখিতে গিয়া। যে-সে নহে, খানিক নোনতা-মুচমুচে এবং ‘পেনিট্রেটিং’। একালের ‘সন ইন ল’-দের লইয়া ‘স্পাইসি স্টোরি’ করা বরং কিয়ৎ সুবিধার, কেননা তাহারা বেশিরভাগ সময়েই ‘কেশ এলাইয়া’, পেশি ফুলাইয়া, প্রায় নাভির ওপরে ‘রামধনু আঁকা’ হ্রস্ব টি-শার্ট উড়াইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহাদের নিম্নাঙ্গে কাটা পাঁঠার দুটি ঠ্যাং-এর ন্যায় ফুটিফাটা জিন্সের ট্রাউজার ঝুলিতে থাকে, যাহা প্রায়শই পথের ধূলিতে ঝাড়ু দিতে দিতে যায়। ইহাদের কানে মোবাইল, হাতে মোবাইল (জন প্রতি কমপক্ষে দুইটি মোবাইল এখন স্টাইল হইয়াছে)। ইহাদের বক্ষ উন্মুক্ত। তবে বক্ষের ভিতরে যে বস্তুটি প্রাণধারণ করিয়া থাকে, তাহা কতখানি উন্মুক্ত—বুঝিবার উপায় নাই। ইহাদের কানে দুই-তিনখানি দুল, কণ্ঠে স্বর্ণ-শৃঙ্খল, হস্তে বহুরঞ্জিত বন্ধনী। ইহারাই একালের ‘নব্য জামাতা’।
আরও পড়ুন-যুবভারতী ভরানোর ডাক দিলেন সুনীল
‘বায়োডেটা’ দিবার কালে একটি ভুল করিয়া বসিলাম। ‘নব্য জামাতা’-রা প্রায়শই পিতা-মাতা মরিবার পূর্বেও একাধিকবার মস্তক-মুণ্ডন করে, যাহাকে একালে ‘ফ্যাশন’ বলিয়া আখ্যা দেওয়া হইয়াছে। কেহ শ্মশ্রু-গুম্ফশূন্য, কেহবা হিটলারি, কেহবা চ্যাপলিন, ফ্রেঞ্চকাট। এন আর আই অথবা বিদেশি জলবায়ুপুষ্ট হেভিওয়েট ‘সন ইন ল’-রা মস্তকে ‘পাঙ্ক স্টাইল’ মানচিত্র লইয়া গর্ব অনুভব করে। যে সময়ে আমরা নারীর শরীর-প্রদর্শন লইয়া চূড়ান্তভাবে ‘উদারীকরণ’-এ বিশ্বাসী হইয়া পড়িয়াছি, সূক্ষ্ম অথবা স্থূল ক্লিভেজ দেখিয়াও লজ্জিত হই না, প্রভাতে উঠিয়া দুর্গার মুখ দর্শন কবিবার পরিবর্তে সংবাদপত্রে প্রায় ‘অর্ধ-নারী-ঈশ্বর’ দেখিতে দেখিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি, সেইসময় আমাদিগের এইসকল জামাতাদের লইয়া মশকরা করিবার দুর্লভ সাহস হইল কী করিয়া? রিপোর্ট লিখিবার নিমিত্ত যখন সাত-পাঁচ ভাবিতেছি আর কড়িকাঠ গুনিতেছি, সেইসময় কী জানি কোথা হইতে ‘হুতোম প্যাঁচা’ আমার সম্মুখে হাজির হইলেন। আমি ‘প্ল্যানচেট’-এ বিশ্বাস করি না, পরজন্মে ইদানীং কিছু বিশ্বাস জন্মিয়াছে। আত্মা লইয়া সম্প্রতি আমি একটু-আধটু গবেষণাও করিয়া থাকি। নিজের পরিবারে বিবাহযোগ্য কন্যা থাকায় রিপোর্টটি আমাকে খুব সর্তক ভাবে লিখিতে হইবে—এ বিষয়ে আমি আশঙ্কায় ভুগিতেছি। তাই ‘হুতোম পেঁচা’-কে সম্মুখে পাইয়া কিঞ্চিৎ বিব্রত হইলেও মনের মধ্যে খানিক বল পাইলাম। কহিলাম ‘সিংহমহাশয়, আমায় রক্ষা করুন। আপনি নকশা রচনা করিয়া বঙ্গজগতে এবং বাংলা সাহিত্যের এত বড় উপকার করিয়াছেন, আর আমার সামান্যতম উপকার করিতে পারিবেন না? বিগত তিনরাত্র আমি নিদ্রাহীন। সেই সময়ে যেসকল নকশা-রিপোর্ট আপনি লিখিয়াছেন, তাহার পর আর কোনো বঙ্গসন্তান আপনার ধারে কাছে ঘেঁষিতে পারে নাই। একালের জামাতাদিগকে পরখ করিবার মতো অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বা যাচাই করিবার মতো হাতযশ আমার আছে কি? আসলে গত কয়েক প্রহরে আমি আপনার মতো একটি ‘স্টাইল’ মারিতে চাহিতেছিলাম। কলিকাতার চড়ক-পার্বণের ন্যায় বর্তমানকালে জামাই-পার্বণ লিখিতে গিয়াই ফাঁদে পড়িলাম।
আরও পড়ুন-হিমন্তের বিরুদ্ধে
আমি কহিলাম, টাকা ছিল, মাটি ছিল। একালের মাটি টাকা হইয়া গেল, আর সবকিছু হইয়াও সবকিছু মাটি হইয়া গেল। আমি পুনরায় বলিলাম, তবে হুতোম একটি গল্প শুনুন। এই বাংলাদেশে কিছুকাল পূর্বে এক নির্ভীক সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি যেমন মুঘল আমলের ইতিহাস লইয়া উপন্যাস লিখিয়াছিলেন, তেমনই পেশি-শক্তির প্রয়োগেও বিখ্যাত ছিলেন। তাহার দুই জামাতাকে তিনি কীভাবে নির্বাচন করিয়াছিলেন, সে কাহিনিই শুনাইতে চাহি। প্রথম জামাতা নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি খানিক ভুল-বিচার করিয়াছিলেন, তাহার জ্যেষ্ঠ জামাতা বিলাত-ফেরত। মিশন ফিলোজফিতে শিক্ষিত। দোষের মধ্যে তাহার একটিই ছিল, তিনি অতিরিক্ত মদ্যপান করিলে নিজেকে ‘কন্ট্রোল’ করিতে পারিতেন না। অপরদিকে ‘সেলেব’ স্ত্রীকে লইয়াও জামাতার দুঃখ কম ছিল না। ‘সেকেন্ড’ জামাতা নির্বাচনকালে সেই সাহিত্যিক কেবল একটিই প্রশ্ন বারংবার করিতেন— ‘মদ্যপান করিয়া তুমি কি মধ্যরাতে বাড়ির পাঁচিল ডিঙাইতে পারো?’ এই প্রশ্নের সদুত্তর যিনি দিয়াছিলেন, তিনিই তাহার দ্বিতীয় কন্যাটিকে লইয়া সুখে-শান্তিতে মদ্যপান করিতেছেন। বুঝিলাম, সিংহমহাশয় একটুও অবাক হইলেন না। কেননা সেকালের শ্বশুর এবং জামাই উভয়ই হাত-ধরাধরি করিয়া ‘বেশ্যাগমন’ করিতেন। আর জামাইষষ্ঠীর দ্বিপ্রহরে শাশুড়ি পাখার বাতাস করিয়া জামাতাকে পঞ্চব্যঞ্জন আহার করাইতেন। হুতোম কহিলেন, ‘একালে কোন জামাইয়ের কেমন দর?’
আরও পড়ুন-ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত ৫
আমি খানিক চিন্তা করিয়া কহিলাম, কন্যার দর বুঝিয়া জামাইয়ের দর। যেমন, মাটি টাকা এখন কন্যাও টাকা। পণ শব্দটি উহ্য হইয়া গিয়াছে। তবে সমাজের অন্তর হইতে এই ব্যাধির সকল শিকড় এখনো যায় নাই। বলিলাম, এ যুগ ‘ইকুয়্যালিটি’-র। নারী-পুরুষ সমান-সমান। তবে সকলেই যে ইহা বিশ্বাস করে, তাহা নহে। বলিলাম, আপনার কালে জামাতার এক দর। একালে বাজার বুঝিয়া। যেমন ধরুন, কিছুকাল পূর্বে কন্যার পিতা সৎপাত্র খুঁজিলেও চুপি চুপি খোঁজ নিতেন— ‘উপরি’ কতটা। পিতা-মাতা যেমন করিয়া পুত্রের পাত্রীনির্বাচনের পূর্বে চুল টানিয়া অথবা কাপড় তুলিয়া পায়ের গোছ দেখিতেন, কিংবা চামড়ার বর্ণ ঘষিয়া-ঘষিয়া যাচাই করতেন, ইদানীংকালে কন্যার পিতারা সামাজিক চাপে পড়িয়া অনেক কিছু করিয়া থাকেন। কয়েদির যেমন সংখ্যা-পরিচয় থাকে, তেমনই জামাতারও একালের পরিচয় ‘কারেন্সি’। ধরুন হুতোম, ব্রিটিশ আমলে কোন জামাইয়ের দাম বেশি ছিল? – ডেপুটি মেজিস্ট্রর, হৌসের করণিক, বিলাত-ফেরত ডাক্তার-ব্যারিস্টার অথবা ‘ভুঁইফোড়’-ভূস্বামী, দেওয়ান।
তাহার পর জুটিয়াছিল ক্ষমতাবান দালালকুল, কালো-টাকার কালো-মানুষ। তাহারও অনেক পরে ‘সেনসেক্স’-এ দাম উঠিয়াছিল সরকারি বাবু-সম্প্রদায়ের। আপনার স্মরণে থাকিবার কথা নহে যে, একসময়ে ব্যাংক-কর্মী পাত্ররও বাজারদর ছিল না। কেননা প্রায়শই সেগুলি লাটে উঠিত। হুতোম আপনি কি ইহার জন্য প্রিয়দর্শিনী-ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদজ্ঞাপন করিতে চান?
আরও পড়ুন-চারজনের ফাঁসি
এই সেদিনও হুতোম আপনি হইলে বিদ্যালয় অথবা কলেজ-শিক্ষকের হস্তে কন্যা সমপর্ণ করিতেন না। কারণ তাহাদের বেতন পাইবার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। সেইসময় সওদাগরি হৌসের কর্মী-পাত্রদের রমরমা। শিক্ষিত মানুষ-জামাতা চিরকালেই মার খাইয়াছে। টাকা আর মাটি না থাকিলে এ জগতে কোনো জামাতারই মূল্য নাই—এ কথা কি আপনি স্বীকার করিবেন? যেমন সর্বসুলক্ষণা-গৃহকর্মনিপুণা কন্যাও নিজ-অর্থ বা বিত্তবান পিতার কন্যা না হইলে এই সংসার-পরিবারে কোনো দাম পায় না।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে ৯ শ্রমিকের মৃত্যু
রিপোর্ট লিখিবার পূর্বে, আপনার মনে হইতে পারে আমি আপনার সহিত গাল-গল্প জুড়িয়াছি। আসলে হুতোম, এ সমাজে কেমন সবকিছু গোলমাল পাকাইয়া গিয়াছে। বিলাতি জামাইয়ের দাম কমিয়াছে। কারণ? — বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা। হুতোম, ইউপি-বিহারের মতো আমাদের অবস্থা নহে। সেথায় আইপিএস, আইএএস জামাইদের অ্যা-ত-তো দাম! বাংলাদেশে সিভিল সারভেন্ট বিরল। এখন পূর্ণ অশিক্ষিত টাকাওলা হাইপ্রোফাইল এবং প্রোমোটার জামাইদের বাজার। ‘জেন্ডার-ইকুয়্যালিটি’-র সহিত আসিয়াছে ‘জয়েন্ট ভেঞ্চার থিয়োরি’—ফেলো কড়ি, মাখো তেল। শুধু তুমি যে আমার নহে, তোমার সকলই আমার। আসো ভাগ করিয়া, মিলিয়া-মিশিয়া, শেয়ার করিয়া জীবন চালাই।