সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জিং ছিল
সুমন্ত্র সেনগুপ্ত
হঠাৎ ‘বিদ্রোহী’ কেন?
হঠাৎ নয়। আমি ৪৪ বছর ধরে কবিতাটা নিয়ে বসবাস করছি। ১৯৭৮ সাল থেকে। মঞ্চে বলেছি। কিন্তু তখন নিজেরই ভাল লাগেনি। এইবছর কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ রচনার শতবর্ষ। কত শিল্পী আবৃত্তি করছেন। এবারের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি আয়োজিত কবিতা উৎসব-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শতকণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’র নির্বাচিত অংশ আবৃত্তি হল। তাতে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমি যৌথভাবে পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, এই কবিতাকে এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে ধরতে হবে। তাই নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম।
কবিতাটি রচনার শতবর্ষ, বর্তমান সময় এবং একজন ব্যক্তিমানস হিসেবে ‘বিদ্রোহী’ আমার আশ্রয় হয়ে উঠল। মনে হল, এই তো সময় এই কবিতার শব্দকে উচ্চারণ করার। কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে এই কবিতার আবৃত্তি প্রত্যেকটি বাঙালির রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কোনও বাঙালি যদি অন্তত একটি কবিতার আবৃত্তি শুনে থাকেন তাহলে সেটা সব্যসাচীর কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’। আমার মনে হয়েছিল এখন নতুন করে কবিতাটা আবিষ্কার করা যায় কি না। সেই তাগিদটা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে।
আরও পড়ুন-শুরু হল বিধানসভার বাদল অধিবেশন, নজিরবিহীনভাবে শোকপ্রস্তাব পর্বেও থাকল না বিজেপি
মঞ্চে কতবার সম্পূর্ণ কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন?
মাত্র দুবার। তাও বহু বছর আগে। সেটা ছিল কাজী সব্যসাচীকে অক্ষম অনুকরণ। পরে ভেবে কুণ্ঠিত হয়েছি। ভেবেছি যদি নিজে কিছু দিতে না পারি, নতুন করে ভাবতে না পারি, আর বলব না।
রেকর্ডিংয়ের আগে কতদিনের প্রস্তুতি ছিল?
নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। নতুন করে ভাবতে চেষ্টা করার প্রক্রিয়াটা অনেক দিনের। অবশেষে একদিন মনে হল, এইবার রেকর্ড করা যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এমন একজনকে চাই যে এই আবৃত্তির আবহ নির্মাণ করতে পারবে। সুরকার জয় সরকার ছাড়া আর কারও কথা মনে এল না।
আবহের প্রস্তাব পেয়ে জয় সরকারের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
জয় রাজি হলেন এককথায়। তারপর দুজনের একটা দীর্ঘ আলোচনার পর্ব চলল। সেটাই প্রস্তুতিপর্ব বলা যায়। যে মনন যে ভালবাসা দিয়ে জয় কাজটা করেছেন, তার জন্য আমি ওঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
রেকর্ড করবেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে-পরে আর কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন?
জয় সরকার ছাড়া কথা বলেছি এবং আলোচনা করেছি অনেকের সঙ্গেই। আবৃত্তিশিল্পী উৎপল কুণ্ডু, অলোক রায় ঘটক, রঞ্জনা সেনগুপ্ত, কবি রাহুল পুরকায়স্থ, বাসব দাশগুপ্ত, সংগীতশিল্পী শ্রীকাম্ত আচার্য, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেছি, পরামর্শ নিয়েছি। এই কাজে পাশে পেয়েছি কৌশিক সোমকে। তিনি ছিলেন শব্দগ্রহণের দায়িত্বে। পোস্টার এঁকেছেন শিল্পী তরুণকান্তি বারিক।
কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি মিথের পর্যায়ে চলে গেছে। এইরকম একটি চূড়া পেরিয়ে অন্যরকম কিছু সৃষ্টি করা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
আরও পড়ুন-বিধানসভায় দলের বিধায়কদের ১০০ শতাংশ উপস্থিতিতে জোর তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে
ওরে বাবা, সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জিং ছিল। খুব টেনশনে ছিলাম। এখনও আছি। কাজী সব্যসাচীকে মাথায় রেখে তাঁর প্রভাব থেকে বেরেনো কি মুখের কথা? সব্যসাচীর পর যাঁরা বলেছেন তাঁরা সবাই সব্যসাচীকে অনুসরণ করেছেন। সবার মনে তো ওই বলাটা রয়ে গেছে। নতুন ভাবে বললে মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবেন এই ভাবনাটা আমার মনের মধ্যে ছিল। আসলে এটা একটা বিশ্বাসের শিকড়ে আঘাত হানা তো!
অবচেতনভাবে কারও প্রভাব থেকে গেছে?
সচেতনভাবে নিজের বোধকে অনুসরণ করেছি। অবচেতনভাবে কারও প্রভাব থেকে যেতে পারে। হয়তো। তবে সেটা ভেবে দেখিনি।
কবিতাটি নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছেন বলে আজ মনে হয়?
কোনও কবিতাকেই সম্পূর্ণ আবিষ্কার করা যায় বলে মনে হয় না। আগের থেকে ভাবনার পরিবর্তন ঘটেছে। সেইমতো উচ্চারণ করেছি। আজ থেকে একবছর পরে হয়তো আবার নতুন করে ধরা দেবে এই কবিতাটি আমার কাছে।
নজরুলের জন্মদিনে মুক্তি পেয়েছে আপনার কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’র আবৃত্তি। এতটা সাফল্য পাবেন, শুরুতে ভেবেছিলেন?
সাফল্য পেয়েছে কিনা জানি না। তবে মানুষ যে শুনছেন সেটা বুঝতে পারছি। বেশি ভাল লাগছে সাধারণ শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া পেয়ে। পাশাপাশি অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী, সংগীতশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা মিত্র, সুরকার কল্যাণ সেন বরাট, কবি শ্রীজাত খুব খুশি হয়ে তঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু দু-চারজন ছাড়া সমবয়সি ও বরিষ্ঠ আবৃত্তিশিল্পীরা আশ্চর্যরকম নীরব। যাইহোক, আমি চাই আরও বেশি মানুষের কাছে আবৃত্তিটা পৌঁছে যাক। সময়সীমা ১১ মিনিট ৭ সেকেন্ড। শঙ্খমালা ক্রিয়েশনস ইউটিউব চ্যানেলে গেলেই শুনতে পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন-পার্ক সার্কাস: মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন আত্মঘাতী কনস্টেবল, জানালেন পুলিশ কমিশনারের
যথেষ্ট থিয়েট্রিক্যাল বিষয় আছে
জয় সরকার
আবহের প্রস্তাব পেয়ে কী মনে হয়েছিল?
ব্যস্ততা আছে। আছে অন্য কাজের চাপ। সেটা কোনও বিষয় নয়। প্রত্যেকেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। তারমধ্যে ‘বিদ্রোহী’র প্রস্তাবটা পেয়ে মনে হয়েছিল, এটা একটা অন্যরকম কাজ হতে পারে। আমি নানারকম প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে চাই। একজন মিউজিক ডিরেক্টর মানেই তিনি শুধু গান বানাবেন, সিনেমার জন্য, অ্যালবামের জন্য, তা নয়। আমি গ্রুপ থিয়েটারেও কাজ করি। এইভাবে চাই সবরকম মাধ্যমে কাজ করতে। নিজের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য, ক্রিয়েটিভিটির ব্যাপ্তিটা বাড়ানোর জন্য। এইসব কারণেই ‘বিদ্রোহী’র মিউজিক করতে রাজি হয়ে যাই। এটা প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই সুমন্ত্র সেনগুপ্ত। তিনি আমার খুব প্রিয় আবৃত্তিশিল্পী। বহুদিন ধরেই ওঁর আবৃত্তি শুনছি। ফলো করছি। আমি ওঁর একজন ভক্ত। তৃতীয় কারণ, ‘বিদ্রোহী’ একটা অন্যরকম কাজ। নজরুলের এই কবিতাটা মিথের পর্যায়ে চলে গেছে। কবিতার মধ্যে ঢুকে, তার অন্যান্য লেয়ার আবিষ্কার করে, সেটা এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে বলার পরিকল্পনা করেছিলেন সুমন্ত্রদা। সেটা আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। কাজটা করার এটাও একটা কারণ। বুঝেছিলাম, সুমন্ত্রদা সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা কিছু ভাবছেন।
আরও পড়ুন-হাসপাতাল থেকে ছেলের দেহ পেতে ভিক্ষা দম্পতির, বিজেপি জোট শাসিত বিহারে
আবহ রচনা করতে কতদিন সময় লেগেছে?
একটু অন্যরকম পদ্ধতিতে কাজটা করেছি। সুমন্ত্রদাকে বলেছিলাম আগে আবৃত্তিটা রেকর্ড করতে। কারণ আমার মনে হয়েছিল, কবিতা বা আবৃত্তির আবহ যে ফরম্যাটে হয়, এটা সেইভাবে করলে হবে না। এর মধ্যে যথেষ্ট থিয়েট্রিক্যাল বিষয় আছে। তাছাড়া কবিতাটা দীর্ঘ। এমন কোনও বিষয় নেই যা এই কবিতায় নেই। পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। তাই আগে থেকে কিছু করিনি। শুধু আলোচনা করেছি। জেনেছি কবিতাটা নিয়ে সুমন্ত্রদা কী ভাবনাচিন্তা করেছেন। রেকর্ডিংয়ের দিন ছিলাম। তখন শুনেছি। পরেও শুনেছি বেশ কয়েকবার। কীভাবে বলছেন, কোন জায়গা থেকে বলছেন, ধরার চেষ্টা করেছি, পাশাপাশি কবিতাটা বোঝার এবং আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছি। স্কেল, বেস, টেম্পো, ছন্দ— এগুলোকে নিজের ভিতরে ঢুকিয়ে তারপর শুরু করেছি আবহের কাজ। মনে হয়েছিল, আমি যদি ঠিক জায়গাটা ধরতে পারি, তাহলে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিংটা স্বাভাবিক এবং সহজাত ভাবেই আসবে। দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার ছিল কাজটার মধ্যে। এইভাবে শুনতে এবং আত্মস্থ করতে অনেকটা সময় লেগেছে। তারপর তিন-চার দিনের মধ্যে শেষ করেছি আবহের কাজ। আমি আগেও কবিতায় আবহ করেছি। ভবিষ্যতেও হয়তো করব। তবে নিয়মিতভাবে নয়। বিশেষ কোনও কাজ এলে তবেই।
আরও পড়ুন-উচ্চমাধ্যমিকের ফলে জেলার জয়জয়কার, ৪৯৮ পেয়ে প্রথম দিনহাটার অদিশা
শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া?
খুব ভাল প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, পাচ্ছি। আনন্দ হচ্ছে কাজটা শ্রোতাদের পছন্দ হয়েছে জেনে। শুরুতে সুমন্ত্রদা একটা কথা বলেছিলেন, ‘তুমি আবহ করলেই আমি কাজটা করব।’ আমার উপর কেউ এতটা ভরসা করছেন, দায়িত্ব দিতে চাইছেন জেনে খুব ভাল লেগেছিল। মনে হয়েছিল, তাঁর ভাবনাকে সম্মান জানানো উচিত। সুমন্ত্রদার সঙ্গে কাজটা করতে পেরে আমি নিজেও সম্মানিত।