‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধের ‘দেশের শ্রীবৃদ্ধি’ অংশের শুরুতেই বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, আমাদের দেশের বড় শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে।’ সেই বাক্যের সূত্রে বলা যায়, ‘আজি কালি বড় গোল শুনা যায় যে, বাংলার শিক্ষা উৎসন্নে যাইতেছে।’ এই ‘গোল’ প্রধানত লোকসমাজে রাম-বাম যৌথকণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে সেইসব গোষ্ঠীর পান্ডাদের মাধ্যমে। একটা বড় অংশের সংবাদমাধ্যমও সেই সুরে সুর মেলাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে, বাস্তবের চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত দশ বছরে, বিশেষত ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নেতৃত্বে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ণ জাগরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা— উভয় ক্ষেত্রেই মেধার বিকাশ এবং জন-সংযুক্তির অভাবনীয় সাফল্য আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পরিসরে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। পরিসংখ্যানের বিভিন্ন স্তরে এবং সূচকে তার স্পষ্ট উপস্থিতি কেন যে নিন্দুকদের নজরে পড়ে না, সে এক রহস্য! বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার তিনবছর অন্তর রাজ্যগুলির বিদ্যালয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষার নাম সংক্ষেপে NAS, অর্থাৎ ন্যাশানাল অ্যাচিভমেন্ট সার্ভে। প্রতিটি রাজ্যের কয়েক হাজার বিদ্যালয়ে এই সমীক্ষা ছাত্রছাত্রীদের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কোন বিদ্যালয়ের কোন শ্রেণিতে এই পরীক্ষা চালাতে হবে, সেটি গোপনীয় তথ্য। এসবই নির্বাচন করে কেন্দ্রীয় সংস্থা বা কেন্দ্রীয় বোর্ড। প্রশ্ন করে তারাই। এই প্রক্রিয়াটি অবশ্য সমস্ত রাজ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফলে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এই NAS পরীক্ষা সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে, কে কোথায় দাঁড়িয়ে। ফলে রাজ্য বোর্ডের অধীন বিদ্যালয়গুলি পরস্পরের সঙ্গে রাজ্যভিত্তিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। NAS এর ফলাফলের ভিত্তিতে বুঝে নিতে হয় শিক্ষাক্ষেত্রে কতটা উন্নতি প্রয়োজন কিংবা অন্যান্যদের তুলনায় একেকটি রাজ্যের অগ্রগতির মান কতটা।
জাতীয় এই সমীক্ষা ২০২০ সালে গোটা ভারতবর্ষের সবক’টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে চালানো হয়েছিল। সম্প্রতি তার ফলাফল বেরিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সবক’টি স্তরেই পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীরা তাদের মেধার পরিচয় রেখেছে। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে এই সমীক্ষায় সমস্ত ফলাফলের নিরিখে প্রথম স্থান পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ!
সবক’টি রাজ্যের নিরিখে পাঞ্জাব এবং রাজস্থানের পর তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলা। আরও উল্লেখযোগ্য কথা হল, তৃতীয়, পঞ্চম, অষ্টম শ্রেণির সবক’টি বিষয়ে জাতীয় গড়ের অনেকটা ওপরে পশ্চিমবঙ্গের স্থান। অতিমারি সময়ের দমবন্ধ পরিবেশে সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে রাজ্য সরকারের শিক্ষা বিভাগ, মাননীয় শিক্ষক সমাজ এবং ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার সারস্বত চর্চা যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ফলে ২০১৭তে পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা ছিল যথাক্রমে ২০ এবং ১৯-এ। এবছরের ফলাফলে তারা দু-শ্রেণিতেই উঠে এসেছে ৭-এ। অভূতপূর্ব কৃতিত্ব!
৩৪ বছরের বাম শাসনে জাতীয় নিরিখে পশ্চিমবঙ্গকে তালিকায় খুঁজে পাওয়া যেত না। ২০১১ সালেও শিক্ষা বিষয়ক ঢক্কানিনাদ যতই থাকুক পশ্চিমবঙ্গ প্রথম দশে উন্নীত হতে পারেনি। এঁরাই এখন ‘গেল গেল’ রব তুলছেন। মজার কথা হল, গুজরাত এবং উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের শিক্ষা রিপোর্ট কার্ডটি ততোধিক শোচনীয়। কে জানে, ওইসব রাজ্যের শিশুশিক্ষা, গরুর দুধে সোনা কিংবা, গোবর নিয়ে গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ কি না! এমনকী কর্নাটক বা মধ্যপ্রদেশকেও মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে অপরিসীম প্রযত্নে এবং মনোযোগে এ রাজ্যের শিক্ষাকে শিখরমুখী করে তুলছেন তার তুলনা নেই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর তত্ত্বাবধানে সেই শিক্ষাপ্রবাহ উৎকর্ষের নতুন নতুন প্রয়োগিক ক্ষেত্রে প্রসারিত হচ্ছে।
NAS-এর এমন চমকপ্রদ ফলাফল কিন্তু একদিনে ঘটেনি। মা মাটি মানুষের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে নানা পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিটি পরিপ্রেক্ষিতেই একথা স্মরণ রাখতে হবে। সেই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলির সুফল আজ ক্রমে ক্রমে উদঘাটিত হচ্ছে। আগামিদিনে আরও অভিনব দিশায় কুহেলিকা উন্মোচন করে তার প্রকাশ ঘটবে।
কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ২০১০-১১ সালে বামফ্রন্টের আমলে বিদ্যালয় শিক্ষার মোট প্ল্যান বাজেট ছিল মাত্র ৮২৯ কোটি টাকা। বর্তমানে ২০২২-২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে তার পরিমাণ ৯৬১৪ কোটি। উচ্চশিক্ষায় যা ছিল ২০১১-১২ সালে ১২০ কোটি, এখন ৭২৮% বেড়ে ৯৯২ কোটি! ২০১১ সালের পর ৯০৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬০৬৯টি নতুন উচ্চপ্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, আর নতুন ক্লাসরুম তৈরি হয়েছে ২,১৫,০০০টি। ২০৯৬টি মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়কে উন্নীত করা হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে। শুধু তাই নয়, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘বাংলার শিক্ষা’ পোর্টালের মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়ের, প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রবাহের মনোনয়নের তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে। একেবারে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মূল্যায়নের নানা আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে শেখার সোপানগুলি অতিক্রম করতে ছাত্রছাত্রীদের কোনও সমস্যা না হয়। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীকে ধারণানির্ভর শিক্ষা যেন পরীক্ষা আর নম্বরমুখী হয়ে না দাঁড়ায়। শিক্ষাই নির্মাণ করে জাতির মেরুদণ্ড। ফলে চেতনাসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্রসমাজ তৈরি করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার এই অভিমুখ আগামিদিনেও বজায় রাখতে হবে। সমান অধিকারে সমস্ত শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে আধুনিক শিক্ষার আলো। যে শিখরের দিকে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় শিক্ষার অভিমুখ আজ নিশ্চিত হয়েছে তাকে খুব যত্নের সঙ্গে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দিতে হবে।
আরও পড়ুন- ‘বিজেপির সঙ্গে ইডি-সিবিআই আছে, মমতার সঙ্গে মানুষ আছে’ আত্মবিশ্বাসী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
মনে রাখতে হবে, বিদ্যালয় শিক্ষার এই অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন অঙ্গীকারে আকাশে উড়ছে উচ্চশিক্ষার জয়কেতন। ৫২টি নতুন সরকারি/সরকার পোষিত কলেজ তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি ডিগ্রি কলেজ এবং ২টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। জেলায়-জেলায় পৌঁছচ্ছে উচ্চশিক্ষার প্রসার। ২০১১ সালের পর রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও। ফলে, শিক্ষার সঞ্চার ঘটেছে রাজ্যের কোণে কোণে। একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের কথা বলতে চাইব। ২০১১ সালের পর থেকে উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীদের সংখ্যা ৫.৬২ লক্ষ থেকে বেড়ে আজ হয়েছে ১০.৯১ লক্ষ। কৃষ্ণনগরে তৈরি হয়েছে কন্যাশ্রী বিশ্ববিদ্যালয় আর ডায়মন্ড হারবারে পূর্ব ভারতের প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়। এর পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে ৪৬টি দেশের সঙ্গে নানা বিষয়ে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার মধ্যে আছে জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া। কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং অনুযায়ী দেশের প্রথম দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হল যথাক্রমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কারা বলছেন বাংলার শিক্ষা দিনে দিনে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে?