ব্রেন টিউমার শব্দটা শুনলে আতঙ্কিত হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। এই রোগের কারণে হতে পারে জীবন সংশয়। গত সপ্তাহে ছিল বিশ্ব ব্রেন টিউমার দিবস। সারা বিশ্বে ব্রেন টিউমার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জার্মান ব্রেন টিউমার অ্যাসোসিয়েশন ২০০০ সাল থেকে জুন মাসের ৮ তারিখে এই দিনটি পালন শুরু করে। সমীক্ষা বলছে, প্রতিবছর আমাদের দেশে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয় এবং যতদিন যাচ্ছে বাড়ছে এই সংখ্যা। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসকদের মত, সমস্যার শুরুতেই রোগ নির্ধারণ হওয়ার ফলে অনেক বেশি সংখ্যক রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। আগে যা ধরাই পড়ত না, এখন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান,পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি উন্নত হওয়ায় রোগ ধরা পড়ছে বেশি, ফলে চিকিৎসাও শুরু করা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-ব্যাটে-বলে দুরন্ত পারফরম্যান্স, প্রোটিয়াদের ৪৮ রানে হারাল ভারত
ব্রেন টিউমার কী?
আমাদের মস্তিষ্কে বা মাথার খুলির মধ্যে কিছু কোষ রয়েছে, যে কোষের অ্যাবনরমাল গ্রোথ বা অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির ফলে সেখানে টিউমার হয়। ব্রেনের বিভিন্ন অংশেই টিউমার হতে পারে। ব্রেন টিউমার দু’ধরনের হয় বিনাইন বা নন ক্যানসারাস এবং ক্যানসারাস। ক্যানসারাস টিউমার মস্তিষ্কেই জন্ম নিতে পারে বা শরীরের অন্য অঙ্গ থেকে এসে মস্তিষ্কে ছড়ায় অর্থাৎ শরীরে অন্য কোথাও ক্যানসার হয়েছে, তার থেকেই কর্কট রোগের কোষ ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কে।
কিছু টিউমার ব্রেনের মধ্যে হতে পারে এবং কিছু আবার ব্রেনের বাইরে কিন্তু স্কালের ভিতরেও হতে পারে। ব্রেনের মধ্যে যে টিউমার হয় তাকে বলে ইনট্রা এক্সিয়াল টিউমার এবং ব্রেনের বাইরে যে টিউমার হয় তা হল এক্সট্রা এক্সিয়াল টিউমার। ইনট্রা এক্সিয়াল টিউমারের মধ্যে রয়েছে গ্লাইওমা, মেডুলোব্লাসটোমা, লিম্ফোমা, মেটাসটাসিস টিউমার, ক্র্যানিওফ্যারিংজিওমা, মেনিনজিওমা, সোয়ানোমা, পিট্যুইটারি গ্ল্যান্ডের টিউমার হতে পারে।
এর মধ্যে গ্লাইওমা ব্রেনের নিজের টিউমার আর মেটাসটাসিস টিউমার দেহের অন্য জায়গায় হয় কিন্তু তারই কিছু সেল ব্রেনে এসে জমে যায়। লিম্ফোমা, মেডুলোব্লাসটোমা এগুলোও ক্যানসার জাতীয় টিউমার।
আরও পড়ুন-‘উজালা’ উধাও, গ্যাস ছেড়ে ফের মাটির উনুনে আগুন
বিনাইন বা নন-ক্যানসারাস টিউমারের মধ্যে রয়েছে, পিট্যুইটারি, মেনিনজিওমা, ক্র্যানিওফ্যারিংজিওমা, সোয়ানোমা ইত্যাদি।
ব্রেন টিউমারের কারণ
ব্রেন টিউমারের কারণ মূলত জেনেটিক মিউটেশন হতে পারে অর্থাৎ বংশগত ভাবে টিউমারের জিন রোগী ধারণ করে তাঁর নিজের শরীরে। বাবা-ঠাকুর্দা বা মায়ের দিক থেকে আসে।
পরিবেশগত কোনও টক্সিনের কারণে হতে পারে অর্থাৎ কোনও খারাপ খাদ্যাভাস থেকে শরীরে কোনও টক্সিন ঢুকলে তার থেকেও জেনেটিক মিউটেশন হতে পারে।
দেহের মধ্যে অনকো জিন এবং টিউমার সাপ্রেসার জিন এই দুইয়ের মধ্যে ইমব্যালেন্স বা ভারসাম্যহীনতা থাকলে টিউমার হয়।
কিছু কিছু নির্দিষ্ট ভাইরাস ইনফেকশন থেকেও ব্রেন টিউমার হতে পারে।
রেডিয়েশন এক্সপোজার থেকেও ব্রেন টিউমার হতে পারে।
হেড ইনজুরি বা মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে ব্রেন টিউমার হতে পারে।
আরও পড়ুন-দ্বিগুণ পেনশন প্রাক্তনদের
উপসর্গ
ব্রেন টিউমারের লক্ষণ বা উপসর্গ নিভর্র করে মাথার ভিতরে টিউমারটি ঠিক কোথায় হয়েছে তার উপরে।
ব্রেনের সামনের দিকে টিউমার হলে স্মৃতিশক্তির সমস্যা হতে পারে। সামান্য কয়েকদিন আগের কথাও ভুলে যাওয়া। রোগীর বিহেভিয়ারে সমস্যা বা পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে, মৃগী রোগের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
টিউমার ব্রেনের মাঝামাঝি হলে প্যারালিসিস হতে পারে।
টিউমার ব্রেনের বাঁদিকে হলে তাহলে পেশেন্টের কথা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কিছু টিউমার হলে ব্রেনে জল জমে যেতে পারে।
মাথার একেবারে পিছনে হলে হাঁটাচলা, দেহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ব্রেন টিউমারের নানাবিধ উপসর্গ মাথা যন্ত্রণা তো থাকেই সঙ্গে দৃষ্টিশক্তির সমস্যাও হতে পারে। চোখের অস্বাভাবিক নড়াচড়া শুরু হয়ে যায় বা ক্ষীণ হতে থাকে। ব্রেন টিউমার যদি তার আয়তনের তুলনায় বেড়ে যায় তবে মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব হতে পারে। কিছু সময় রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন-প্রমাণ হল বিজেপি = রাজ্যপাল
চিকিৎসা
ব্রেন টিউমার ডায়াগনোসিস করতে হলে প্রথমে সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই স্ক্যান করতে হবে। এই বেসিক স্ক্যানগুলো হয়ে গেলে এরপর যদি আরও কিছু পরীক্ষা- নিরীক্ষার দরকার পড়ে যেমন, অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, এমআর স্পেকট্রোস্কপি এই জাতীয় পরীক্ষাগুলোও করা হয়।
ব্রেন টিউমার ধরা পড়লে একমাত্র ট্রিটমেন্ট হল সার্জারি। অর্থাৎ অপারেশন করে টিউমার বাদ দিয়ে দিতে হয় এবং তারপর বায়োপসির জন্য পাঠিয়ে দিতে হয় এটা দেখার জন্য যে টিউমারটা বিনাইন না ক্যানসার জাতীয় টিউমার।
অপারেশন বিভিন্ন ভাবে হয়। ব্রেনের সামনের দিকে টিউমার হলে ছোট ফুটো করে মাইক্রোস্কোপ বা এন্ডোস্কোপ দিয়ে টিউমারটা রিমুভ করে দেওয়া হয়। যদি পিট্যুইটারি টিউমার হয় তবে অপারেশনটা অনেক সময় নাক দিয়ে করতে হতে পারে। তখন নাকের ভিতরে এন্ডোস্কোপ বা মাইক্রোসকোপ দিয়ে রিমুভ করতে হয়। যদি পিছনের দিকে টিউমার হয় তাহলেও একই পদ্ধতিতে অপারেশন করতে হয়।
যেসব টিউমারে জল জমে যায় আগে সেক্ষেত্রে ভিপি শান্ট বলে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তারপর অপারেশন করা হয়। কিছু ব্রেন টিউমার আছে যেগুলো মাইক্রোস্কোপ এবং এন্ডোস্কোপ ছাড়াও আরও উন্নত ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন নেভিগেশন মেশিনের সাহায্যে হয়।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় শান্ত পরিবেশ ফিরে আসায় উদ্যোগ, ১২ বছর পর জঙ্গলমহলে বন অফিস
কিছু টিউমার অজ্ঞান করে অপারেশন করা হয় আবার কিছু অজ্ঞান না করে হয়। কিছু সার্জারি রয়েছে যেগুলো অ্যাওয়েক সার্জারি বলে অর্থাৎ শুধু মাথা অবশ করে হয়, বাদবাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়। ফলে অ্যাওয়েক সার্জারির সময় রোগী কথা বলেন, হাত পা নাড়েন, এমনকী গানও গাইতে পারেন। এতে অপারেশন চলাকালীন রোগী বলতে পারেন তাঁর কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। সার্জারির পর বায়োপসি রিপোর্টে যদি বিনাইন বা নন ক্যানসরাস হয় তবে আর কোনও ট্রিটমেন্ট থাকে না, ওটাই অন্তিম চিকিৎসা। কিন্তু যদি তা ক্যানসারাস হয় তবে রোগীকে ক্যানসার হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হয়। সেখানে পরবর্তী চিকিৎসা শুরু হয়।
অপারেশন পরবর্তী সতর্কতা
অপারেশনের পর মাথার স্টিচ হয়, সেই জায়গাটার সঠিক যত্ন নিতে হবে। ড্রেসিং করতে হবে। স্টিচ থেকে কোনও পুঁজ হচ্ছে কি না বা ইনফেকশন হচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় শান্ত পরিবেশ ফিরে আসায় উদ্যোগ, ১২ বছর পর জঙ্গলমহলে বন অফিস
কিছু ওষুধপত্র প্রেসক্রাইব করা থাকলে নিয়ম মেনে খেতে হবে। টিউমার ক্যানসার জাতীয় হলে সার্জারির পরবর্তী চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপির কোর্সটা যাতে কমপ্লিট হয়। নিয়মিত ফলো আপ করা, এমআরআই করা, দেখাতে যাওয়া অঙ্কোলজিস্টকে অথবা নিউরোসার্জনকে, সেটা একটা বড় বিষয়।