পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করার পরে, কম্বোডিয়া এসে মনে হল, এই দেশ না দেখলে জীবন বৃথা ছিল। দরিদ্র দেশটির আছে আঙ্করওয়াত-এর মতো বিশ্বখ্যাত মন্দির, যেখানে পাথরের বুকে লেখা আছে ইতিহাস। অনেক কিছু দেখলাম এখানে। নদীর উপর ঘর বাড়ি স্কুল দেখে মুগ্ধ হলাম। হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দিরের অতুলনীয় স্থাপত্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। কিন্তু, টা-প্রহম! ঘন জঙ্গলের মধ্যে চূর্ণবিচূর্ণ অতীত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপত্য দেখে চোখে জল চলে এল। জঙ্গলের মাঝখানে পরিত্যক্ত স্থানে এই মন্দির এক ধরনের থমথম ভাব সৃষ্টি করে। কম্বোডিয়ার সমস্ত মন্দিরের মধ্যে, টা-প্রহম সবচেয়ে কাব্যিক, শতাব্দী ধরে পাথরের দেওয়াল ভেদ করে শিকড়গুলি দেওয়ালের সঙ্গে একসঙ্গে বেড়েছে, যেন, গাছের আড়ালে ছিল বলেই শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপত্য রক্ষা করতে পেরেছে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য।
আরও পড়ুন-উপদেষ্টা আরতি
ইতিহাস
এই মন্দির থেকে পাওয়া কিছু শিলালিপি থেকে চমকপ্রদ ইতিহাস পাওয়া যায়।
টা-প্রহমের আসল নাম ছিল রাজবিহার, যার অর্থ রাজার মঠ।
১২শ শতাব্দীতে, শক্তিশালী রাজা জয়বর্মন সপ্তম, বৌদ্ধ মন্দির হিসাবে ‘টা-প্রহম’ নির্মাণ করে, নিজের মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন।
শিলালিপি থেকে জানতে পারি, মন্দিরটি মূলত বৌদ্ধবিহার এবং বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে নির্মিত হয়েছিল।
তথ্য থেকে আরও জানা যায়, মন্দিরটির চারিদিক ঘিরে ৩,১৪০ গ্রাম ছিল। ৭৯,৩৬৫ জন লোক মন্দিরে কাজ করত। তার মধ্যে ১৮ জন প্রধান পুরোহিত, ২,৮০০ কেরানি, ৬১৫ জন নর্তকী ছিল। ১২,০০০ এর বেশি মানুষ স্থায়ীভাবে মন্দিরের ভিতর বাস করত। আজ মন্দিরের চারপাশে যে জঙ্গল থইথই করছে, সেখানে জমজমাট শহর ছিল। বাজার হাট, নর্তকীর নূপুর কিঙ্কন বেজে উঠত। মন্দিরের কোষাগারে অনেক ধন রাখা হয়েছিল। শিলালিপি বলে, ৫০০ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের সোনার থালা, ৩৫টি হীরা, ৪০৬৩০টি মুক্ত, ৪৫৪০টি মূল্যবান পাথর, ২৬০টি দেবতার মূর্তি, ৩৯টি চূড়া সহ টাওয়ার এবং ৫৬৬টি আবাসস্থল ছিল। শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মার নিয়মিত আরাধনা করা এই মন্দির ছিল রাজার বিশ্রাম করার জায়গা। সুন্দরী রমণী সঙ্গ অনিবার্য ছিল, তাই অপ্সরা মূর্তি দেখা যায়। ১৫ তম শতাব্দীতে রাজার পতনের পর, দেখাশোনার অভাবে জঙ্গল গ্রাস করে নেয় মন্দিরকে।
আরও পড়ুন-অগ্নিপথে আত্মঘাতী
মন্দিরের বর্তমান বিবরণ
আমি, আমার কন্যা এবং আমার ভাইঝি— তিনজন একসঙ্গে বেরিয়েছিলাম কম্বোডিয়ার উদ্দেশ্যে। সাতদিনের একটা প্যাকেজ ট্যুর নিয়েছিলাম বলে, যে সমস্ত জায়গা পরিদর্শন করব, তাদের টিকিট আলাদা করে করতে হয়নি।
Angkor wat দেখা শেষ করে ta prohm যেতে গেলে গাড়িতে বেশিক্ষণ লাগবে না। গাড়ি না নিলে বাইক বা টুকটুক (অটো) আছে। ভিড় এড়াতে বা ভাল ছবি তুলতে ভোর বেলার দিকে যাওয়া ভালো। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত — দুটি দৃশ্যই স্বর্গীয়। প্রাচীন ভগ্ন স্থাপত্য আর সবুজ অরণ্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আকাশের অপার্থিব আলো, তখন মন জুড়িয়ে যায়।
এই জায়গার বিশেষত্ব আগেই বলেছি, গাছপালা নিবিড় করে জড়িয়ে ধরেছে পাথরকে, লম্বা সুড়ঙ্গ পথ, অলিন্দ, উঠোন, স্তম্ভ— সমস্ত কিছুর উপরে গাছ ছড়িয়ে দিয়েছে তার শাখা প্রশাখা, শিকড়। খণ্ড খণ্ড পাথর ভেদ করে পুরনো সভ্যতা আবিষ্কারের আনন্দ কিন্তু একেবারে আলাদা। পরিপাটি মন্দিরে সেটা কখনও সম্ভব নয়। সেই প্রাচীন কাল যেন এখানে থমকে আছে। এইটাই এই জায়গার বৈশিষ্ট্য। কম্বোডিয়ার আর কোথাও এটা নেই। এর চারটি প্রবেশদ্বার(গো পুরা) আছে।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় উপনির্বাচনে সাতসকালে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বুথে আক্রান্ত ভোটার ও সাংবাদিক
গোপুরা (প্রবেশ মণ্ডপ) থেকেই গাছের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে, সেইসঙ্গে সুড়ঙ্গ ভর্তি নড়বড় পাথর, দুর্গম, অন্ধকার। ভগ্ন স্তম্ভের শরীরে অলংকরণ রয়েছে নিখুঁত। সুন্দরী অপ্সরা, বুদ্ধের গৃহত্যাগ, পাথরের মুখ, ধ্যানরত তপস্বী, চক্র… মন্দিরের দিকে যাওয়ার কেন্দ্রীয় পথটিতে অপূর্ব সমস্ত কারুকৃতি দেখে থমকে গেলাম। মন্দিরের মধ্যে গ্রন্থাগার, নর্তকীদের হল এখনও দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, যতক্ষণ থাকা যায়, জঙ্গলের নিজস্ব ভাষা মন্দিরের কথা বলে যায়। সেই রহস্যময় রোমান্টিকতায় ভরপুর অভিজ্ঞতা পৃথিবীর কোনও জায়গায় নেই!
কোনও একটা জায়গায় স্টেগোসরাসের একটি চিত্র কৌতূহল সৃষ্টি করেছে এই জন্য যে, ১১ এবং ১২ শতকের হিন্দুরা কি ডাইনোসরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত? আমরা এটা দেখতে পাইনি। চেষ্টাও করিনি। কারণ, আমরা তিনজনেই বিস্মিত হয়ে অনুভব করছিলাম, এই স্থান জীবন্ত। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না, কম্বোডিয়ার আর কোনও মন্দিরে এইরকম অনুভব আমার হয়নি। ২০২১ সালে লারা ক্রফট: টুম্ব রেইডার— নামে হলিউড মুভি এখানেই নির্মিত হয়। গাইড খুব উত্তেজিত হয়ে আমাদের সেকথা বারবার বলছিল। সত্যি বলতে কী, ওইরকম একটা গম্ভীর পরিবেশে বুঁদ হয়ে থাকায় সিনেমার ব্যাপারটা নাড়া দেয়নি খুব একটা।
আরও পড়ুন-কবজি-কাণ্ডের শিকার রেণু আদালতে গোপন জবানবন্দি দিলেন, যাবজ্জীবন সাজা চান দোষীদের
যাতায়াতের নিয়মকানুন
সান স্ক্রিন, ছাতা, টুপি, জলের বোতল অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। জুতো ফ্ল্যাট হলেই ভাল। কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা সময় হাতে রাখা জরুরি।
অনেক বিপজ্জনক জায়গা আছে, ছবি তোলার জন্য ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল।
কম্বোডিয়ার ট্যুরিজম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই বলে, পর্যটক ভারত থেকে কম যায়। কিন্তু, ইতিহাস-প্রিয় মানুষের কাছে কম্বোডিয়া অতীব আকর্ষণের জায়গা।
ভিসা আমরা ব্যাংকক থেকে করেছিলাম। যেহেতু ব্যাংকক থাকি। পাসপোর্ট কপি একটা জেরক্স করে সঙ্গে রাখা ভাল। কারণ, আসল পাসপোর্ট নিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করলে চুরি যাবার ভয় আছে।
কম্বোডিয়ার কারেন্সির নাম রিয়েল। এয়ারপোর্টে ডলার ভাঙিয়ে রিয়েল নিতে পারেন। কিন্তু, কম্বোডিয়ায় ডলারের কদর খুব বেশি। ১ ডলার— ৪০০০ রিয়েল।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শোভন এবং বৈশাখী
কে বলে পাথর প্রাণহীন? পুরো মন্দির জুড়ে কথা কে বলে তবে? গাছেদের পাতায় পাতায় কিসের দীর্ঘশ্বাস? কেন স্থানীয় গাইড সভয়ে বলে— একলা যাবেন না। কেউ আছে। এখনও আছে। কারণ, এই মন্দির সংস্কার করা হয়নি। শতকের পর শতক একলা পড়ে থেকে জমা হয়ে আছে অভিমান। সে অভিমান মৃত নয় এখনও জীবন্ত। Ta prohm দেখলে বোঝা যায়, পরিদর্শনের সময় সঙ্গে কেউ আছে, আমরা একলা নই।