ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠি। যাত্রার মরশুম। এই সময় গ্রামবাংলা মাতিয়ে বেড়ায় বিভিন্ন যাত্রার দল। নানা রকমের পালা। সামাজিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক।
তবে যাত্রার বোধন হয় রথের দিন। রথের রশিতে টান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। কথায় আছে, রথযাত্রা। রথের শুভ দিনেই বিভিন্ন অপেরা নতুন পালার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে। নতুন রূপে সেজে ওঠে কলকাতার চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। মূলত নতুনবাজার থেকে অ্যালেন মার্কেট পর্যন্ত। অফিসগুলো সাজানো হয়। কোথাও কোথাও হয় পুজো। চতুর্দিকে শোভা পায় নতুন পালার ঝকঝকে পোস্টার। দূরদূরান্ত থেকে আসেন নায়েক পার্টি। পছন্দের পালা বুকিং করেন। তাঁদের আপ্যায়ন করা হয় জল-মিষ্টি দিয়ে। দেওয়া হয় নতুন ক্যালেন্ডার, পোস্টার, খাবার প্যাকেট।
নতুন পোশাকে সুগন্ধী ছড়িয়ে আসেন প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীরাও। পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এই রেওয়াজ দীর্ঘদিনের।
আরও পড়ুন-উদয়পুর হত্যাকাণ্ড: একসঙ্গে বদলি ৩২ জন পুলিশ আধিকারিক
এই বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রথের দিন চিৎপুর ছিল সরগরম। গত দুই বছর করোনার কারণে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে যাত্রা শিল্পে। এইবার সমস্ত ক্ষতি সুদে আসলে উশুল করে নিতে চাইছেন শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেই। আছে করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের ভ্রুকুটি। তবু তাঁরা আশাবাদী।
রথযাত্রায় বোধন হয়েছে। দলগুলোর রিহার্সাল শুরু হবে মোটামুটি শ্রাবণ মাস থেকে। দুর্গাষষ্ঠী থেকে শুরু হবে যাত্রা-অভিনয়। এক আসর থেকে অন্য আসরে। আছড়ে পড়বে জেলায় জেলায়। চলবে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষদিন পর্যন্ত।
চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার পাশাপাশি রথের দিন সেজে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত এই আকাদেমি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে যাত্রাশিল্পের উন্নতির জন্য বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কাজগুলো সম্পাদিত হয় বিভাগের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, আকাদেমির সভাপতি মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে। কী কী হয়? যাত্রা উৎসবের আয়োজন, গুণী শিল্পীদের পুরস্কার প্রদান, দুঃস্থ শিল্পীদের আর্থিক সাহায্য, বক্তৃতা, আবাসিক কর্মশালার আয়োজন ইত্যাদি। ফলে গত এক দশকে নতুন জোয়ার এসেছে একটা সময় রুগ্ণ-শিল্পে পরিণত হওয়া যাত্রাশিল্পে। ঘটেছে নবজাগরণ। আসছেন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা।
আরও পড়ুন-দু’বছর পর মহাসমারোহে মাহেশের ঐতিহাসিক রথযাত্রা পালন
রথযাত্রা উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সামনে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। এসেছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস-সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ। ছিলেন যাত্রার পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রীরাও। কেউ এসেছেন চিৎপুর ঘুরে, কেউ চিৎপুরে যাবার আগে। হয়েছে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, শুভেচ্ছা বিনিময়।
২০১৩ থেকে প্রতিবছর রথযাত্রার দিন প্রকাশিত হচ্ছে ‘যাত্রা দর্পণ’ নামে একটি বই। কোন দল নতুন কী যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করতে চলেছে, বিস্তারিত তথ্য থাকে বইটিতে। যাঁরা নতুন পালার বায়না করতে চান তাঁদের সুবিধার জন্য এই উদ্যোগ। গতকাল যথারীতি প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইটি। অনেকেই সংগ্রহ করেছেন। যাত্রা আকাদেমির মাধ্যমে বইটি ছড়িয়ে পড়বে জেলায় জেলায়। হয়েছে পোস্টার প্রদর্শনীর উদ্বোধন, আকাদেমির সামনে বাগবাজার স্ট্রিটে বসেছিল স্টল। হয়েছে বিভিন্ন দলের নতুন পালার বুকিং। নায়েক পার্টিদের উৎসাহ হাসি ফুটিয়েছে দলের মালিকদের মুখে।
পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের যুগ্ম সম্পাদক রূপকুমার ঘোষ। তিনি আকাশবাণী যাত্রা সংস্থার প্রযোজক। কথায় কথায় জানালেন, ‘রথের দিনটা আমাদের কাছে মহালয়ার মতো। মহালয়া এলেই মনে হয় পুজো আসছে। তেমন রথের দিন আসা মানেই মনে হয় যাত্রার মরশুম আসছে। শুরু হবে রিহার্সাল। বুকিং শুরু হয় রথের দিনেই। এবার আমাদের ভালই বুকিং হয়েছে। অন্তত শুরুটা। খুশি অন্যান্য দলের মালিকরাও। মনে হচ্ছে আগামী যাত্রা মরশুম ভালই জমবে। যাত্রা পালার সিলেকশন আগেই হয়ে যায়। অনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয় রথের দিন। প্রতিবছরের মতো এইবছরেও আমরা দর্শকদের উপহার দেব দুটি পালা। সামাজিক পালার নাম ‘আমার সিঁদুরের দিব্যি’, মঞ্জিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। পৌরাণিক পালার নাম ‘জনমদুঃখিনী বিষ্ণুপ্রিয়া’। লিখেছেন অসীম মুখোপাধ্যায়। অভিনয়ের পাশাপাশি দুটি পালা পরিচালনা করবেন চম্পা হালদার। পুরোনো শিল্পী কয়েকজন আছেন। তা-ছাড়াও নতুন কয়েকজন শিল্পী এবার এসেছেন আমাদের দলে। সারাবছর আমরা খোঁজখবর রাখি কে কোথায় ভাল অভিনয় করছেন। যাত্রা উৎসবে অভিনয় দেখেও আমরা নতুন বছরের শিল্পী নির্বাচন করি। নামী শিল্পীদের ব্যাপারটা আলাদা। আমাদের রিহার্সাল শুরু হবে শ্রাবণ মাসে। দর্শকদের সামনে মঞ্চস্থ হবে দুর্গা পুজোর ষষ্ঠী থেকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষদিন পর্যন্ত। কয়েকটা দল বিশ্বকর্মা পুজোতেও শো করে। গতবছর করোনার জন্য যাত্রার অনেক ক্ষতি হয়েছে। বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রযোজকদের। আমাদের দলের অভিনয় শুরু হয়েছে দেরিতে। ফেব্রুয়ারি মাসে। তবু ভালই শো হয়েছে। যাত্রা শিল্পীদের উন্নতির জন্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি আমাদের মা।”
আরও পড়ুন-মণিপুরে ধসে মৃত্যু দার্জিলিংয়ের ৯ জওয়ানের, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
দীর্ঘদিনের অভিনেত্রী রুমা দাশগুপ্ত। অভিনয়ের পাশাপাশি যাত্রাপালা পরিচালনাও করেন। জানালেন, ‘‘এবারেও আছি স্বপন দেবনাথ প্রতিষ্ঠিত শ্রীচৈতন্য অপেরায়। আমাদের নতুন পালা ‘আমি চোখের জলের প্রতীক’। বুকিং ভালই হচ্ছে। রথের দিন আমাদের দুর্গাপুজোর মতো আনন্দ হয়। সারা বছর দিনটার অপেক্ষায় থাকি। আগে চিৎপুরে যাত্রা সংস্থার অফিসে পুজো হত। বহু মানুষ আসতেন। এখন সবাই মিলিত হই যাত্রা আকাদেমিতে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুজো হয়েছে, যজ্ঞ হয়েছে। পাশাপাশি চিৎপুরও ছিল সরগরম। অফিসে এসেছিলেন বহু মানুষ। খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখ। সবাই সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। অনেকেই দল পরিবর্তন করে পুরোনো দল ছেড়ে নতুন দলে এসেছেন। তবে রথের দিন কোনও দলাদলি থাকে না। বিজ্ঞাপন, পোস্টার বেরোলেই জানা যায় কে কোন দলে।”
আরও পড়ুন-বিধানসভায় বিধান রায়ের জন্মদিবস পালন: গরহাজির বিজেপি, কটাক্ষ অধ্যক্ষের
পুরোনো দল ছেড়ে নতুন দলে এসেছেন অভিনেতা অমিতকান্তি ঘোষ। জানালেন, ‘‘আমি যাত্রা প্রহরীর চেয়ারপারসন। দীর্ঘদিন নট্ট কোম্পানিতে ছিলাম। এই প্রথম এসেছি নাগমাতা অপেরায়। দল গুছোনো শেষ হয়েছে। শ্রাবণ মাস থেকে শুরু হবে রিহার্সাল। নতুন পালার নাম ‘কলিকালের ধন্যি মেয়ে’। সামাজিক পালা। বাবলি ভট্টাচার্য লেখা। আগে রথের দিন পুজো করেই রিহার্সাল শুরু হত। এখন রথের দিন রিহার্সাল হয় না। তবে পুজো হয়। আমরা সবাই মিলিত হই যাত্রা আকাদেমিতে। এবারেও তাই হয়েছে। ১-১৫ জুলাই একটা আবাসিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে যাত্রা আকাদেমির উদ্যোগে। রথের দিন তার সূচনা হল। পাশাপাশি শুরু হয়েছে বিভিন্ন দলের নতুন পালার বায়না। আকাদেমিতে এবং চিৎপুরে। জমজমাট ছিল দুটি জায়গা। এসেছেন বহু মানুষ।”
আরও পড়ুন-রথযাত্রা উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সবমিলিয়ে এবারের রথযাত্রা চওড়া করেছে যাত্রা শিল্পীদের হাসি। বায়না হয়েছে ভালই। প্রত্যেকেই আশাবাদী। করোনার ক্ষতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে। জষ্ঠি তো বহুদূর। প্রত্যেকের চোখ এখন দুর্গাষষ্ঠীর দিকে…