অপার জ্ঞান ছিল ওঁর
মাধবী মুখোপাধ্যায়
তরুণ মজুমদারের (Director Tarun Majumdar) সঙ্গে যতটুকু কাজ করেছি তাতে বলতে পারি, উনি একজন অসম্ভব ভাল পরিচালক। প্রত্যেকটি বিষয়ে ওঁর অপার জ্ঞান ছিল। শট কীভাবে নিতে হয় সেই সেন্সটা খুব ভাল ছিল। আউটডোর ইনডোর দুটো শট একসঙ্গে যাবে, সেটাকে কীভাবে মেশাতে হবে সেই বিষয়টা দারুণ জানতেন। ক্যামেরা সেন্স দারুণ ছিল। এই গুণ আমি দু’জনের মধ্যে দেখেছি তরুণ মজুমদার এবং সত্যজিৎ রায়। শুধু তাই নয়, দারুণ লিখতেন তনুবাবু। কাছের, পরিচিত জনেরা সবাই ওঁকে ওই নামে ডাকত ইন্ডাস্ট্রিতে। ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ বলে ওঁর একটা বই আছে। দু’খণ্ডে। সেই লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায় জ্ঞানের সীমানা কতখানি। গানের ওপর ভীষণ জ্ঞান ছিল— কোথায় কোন গানটা কাজে লাগাবেন। ভীষণ ভাল আঁকতে পারতেন তাই ওঁর পরিচালিত ছবিগুলো আঁকার মতো সুন্দর হত। আমি ওঁর দুটি ছবিতে কাজ করি। সেই কাজের অভিজ্ঞতা বড়ই আনন্দদায়ক।
অভিভাবককে হারালাম
গৌতম ঘোষ
দারুণ মানুষ ছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার (Director Tarun Majumdar)। একদিকে ভীষণ সিরিয়াস, অন্যদিকে খুব মজার রসিক একজন মানুষ। অসম্ভব প্রতিভাবান। ওঁর অনেক ছবি আমার পছন্দ, তবে সবচেয়ে পছন্দের ছবি হল ‘সংসার সীমান্তে’ এবং ‘গণদেবতা’। তিনি খুব নিখুঁত একজন মানুষ। প্রতিটা ছবির কাজ শুরুর আগে লেখা, পরিকল্পনা সব আগে থেকে তৈরি করে নিতেন। সবরকম প্রপস রেডি রাখতেন। আমার দারুণ লাগত ওঁর সেট। অসাধারণ সেট তৈরি করতেন। তখন আমাদের বয়স কম। আমরা ওঁর সেট দেখতে যেতাম স্টুডিওতে। অনেক কিছু শিখেছি ওঁর কাছ থেকে। যখন দেখা হয়েছে উনি আমার ছবি নিয়ে অনেক প্রশ্ন করতেন। অনেকরকম গল্প করতেন আমার সঙ্গে। নিজের ছবির কথাও বলতেন। আমরা একজন বড়মাপের ফিল্ম মেকারকে হারালাম। মজা করতেন সবার সঙ্গে। আমি মর্মাহত। একজন অভিভাবককে হারালাম।
আমাকে কন্যাসম স্নেহ করতেন
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
তরুণ মজুমদার আমাকে কন্যাসম স্নেহ করতেন। মন ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। উনি নেই এই কথা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেক স্মৃতি ওঁর সঙ্গে আমার কাজের। আমি ওঁর প্রথম ছবি করি ‘আলো’। যেটা খুব বড় একটা জায়গা তৈরি করেছিল। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটা ল্যান্ডমার্ক ছবি বলা যায়। আমি ওঁর সঙ্গে ‘চাঁদের বাড়ি’ করেছি যেটা আর একটা স্তম্ভ। এবং সম্প্রতি ‘ভালবাসার বাড়ি’ ছবিটা করেছি। তনুবাবুর অবদান বাংলা ছবিতে আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যখন উনি অসুস্থ ছিলেন মন ভীষণ অস্থির হয়েছিল। ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলাম এবং খুব আশা করেছিলাম যাতে উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে আবার ফ্লোরে ফিরতে পারেন। শুটিংয়ের কিছুটা অংশ বাকি রয়ে গেছে। প্রচুর এনার্জি নিয়ে উনি কাজ করতেন। অনেক সময় রাত হয়ে গেছে শুটিং করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি কিন্তু ওঁকে ক্লান্ত হতে দেখিনি। তিনি ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান। অনেক বড়মাপের কাজ তিনি দিয়ে গিয়েছেন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে। ওঁর কীর্তিতে, ওঁর সৃষ্টিতে, ওঁর মননে আমরা সমৃদ্ধ। সারা ভারতবর্ষকে ছবির এক অন্য নিদর্শন দিয়ে গিয়েছেন তিনি। বুঝিয়েছিলেন সিনেমাকে কীভাবে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে হয়। সম্পর্কে কীভাবে নতুন নিরিখে দেখাতে হয়, পারিবারিক গভীরতা কতটা হয়, প্রেমকে কীভাবে স্পর্শ করতে হয়, তিনি বুঝিয়েছিলেন সিনেমার মাধ্যমে।
ওঁর ছবির গান দিয়ে আমার পরিচিতি
শিবাজি চট্টোপাধ্যায়
তরুণ মজুমদারের (Director Tarun Majumdar) ছবি দিয়েই আমার আপামর মানুষজনের কাছে পৌঁছনো। তাঁর ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবির মাধ্যমে। সেই ছবির সব গান এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে সারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাকে চিনে নিয়েছিলেন। আজ ৩৭ বছর ধরে সেইসব গান টাটকা হয়ে আছে। এরপর তাঁর ‘পথভোলা’, ‘আগমন’, ‘সজনী গো সজনী’ ছবিতে গান করেছি। বহু স্মৃতি তাঁর সঙ্গে। তরুণ মজুমদারের ‘আলো’ ছবিতে প্রথম আমার এবং অরুন্ধতীর সংগীত পরিচালনায় আসা। আলোতে রবীন্দ্রনাথের গান যেভাবে ব্যবহার করেছেন মনে হয় গান ছাড়া যেন গল্পটাই অসম্পূর্ণ! ওঁর ছবির গল্প এবং গানের মধ্যে এক অদ্ভুত রসায়ন ছিল। এটা ওঁর ছবির রসায়ন। অরুন্ধতীর গান ছিল ওঁর প্রাণ। তারপর চাঁদের বাড়ি, ভালবাসার অনেক নাম— সব ছবিতেই আমরা সংগীত পরিচালনা করি। আমরা অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি অনেক কিছু শিখেছি। ওঁর সঙ্গে কাজ করার পর আর কারও সঙ্গে কাজ করা খুব মুশকিল ছিল আমাদের পক্ষে। এত সিস্টেমেটিক ভাবে কাজ করতেন তিনি! আমরা ওঁকে রাশভারী মানুষ হিসেবেই দেখেছি একসময়। কিন্তু তারপর হাসি মজা গল্প সব মিলিয়ে ভীষণ সহজ হয়ে গিয়েছিলেন। জীবনরসিক এবং খাদ্যরসিক দুই-ই ছিলেন।
একটা অধ্যায় শেষ
ইন্দ্রনীল সেন
নক্ষত্রের পতন হল। ওঁর চিকিৎসায় যা যা করণীয় করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা তাঁদের কর্তব্য করেছেন। যা ঘটে গেল তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ থেকে শুরু করে ‘দাদার কীর্তি’ অগুন্তি তাঁর কাজ। অনেক নতুন নায়ক-নায়িকাকে তিনি সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তাপস পাল সহ অনেক বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রী ওঁর হাতেই তৈরি হয়েছেন। তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত মর্মাহত। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে আমি চলে এসেছি। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও এসেছেন। প্রয়াত পরিচালকের পরিবারের সদস্যরা যেভাবে চেয়েছেন রাজ্য সরকার সেভাবেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করেছে। তরুণ মজুমদারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। আমি ওঁর একাধিক প্রোজেক্টে গানও গেয়েছি। বাংলা সিনেমা জগতের একটা অধ্যায় শেষ হল।
দারুণ সেন্স অফ হিউমার
শতাব্দী রায়
তনুদার সম্পর্কে কী বলব। যত বলব ততটাই কম বলা হবে। ভীষণ ট্যালেন্টেড একজন মানুষ। খুব মজার। ওঁর সেন্স অফ হিউমার দুর্দান্ত ছিল। আমি শুধু তনুদার সঙ্গে ছবি করেছি এমন নয়, ছবির বাইরে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি। এটা আমার তনুদার সঙ্গে ছবির শুটিংয়ের কথা বলছি না। কারণ তনুদার সঙ্গে কাজ থাকলে তখন গল্প করার সুযোগ বিশেষ হত না। যখন অন্য কাজ করছি তখন গিয়ে হাজির হতাম সে কত যে আড্ডা হত! ওঁর সঙ্গে কাজ করলে অনেক কিছু শেখা যায়। আমাকে ‘পথভোলা’ ছবির জন্য ডেকেছিলেন। আমার তখন খুব আক্ষেপ ছিল যে ডেটের কারণে কাজটা করতে পারিনি। তখন তনুদা বলেছিলেন দরকার পড়লে আবার তোমাকে ডেকে নেব। তারপর পরশমণি, আপন আমার আপন ছবির জন্য ডেকে নিয়েছিলেন। আমার তো মনে হয় তরুণ মজুমদার একটা ইন্ডাস্ট্রি। ভালগারিটি ছাড়া কত সুন্দর বাংলা ছবি হতে পারে সেটাই ওঁর থেকে শেখার মতো। আজ অবধি উনি এই ইন্ডাস্ট্রির সেই মানুষ যিনি একটা স্তম্ভ। তরুণ মজুমদার না থাকার অর্থ বাংলার ক্ষতি, বাংলার দর্শকের ক্ষতি। এতটা মিষ্টি ছবি করেছেন। উনি বড়-ছোট এগুলো নিয়ে ভাবতেন না। শুটিংয়ে সবার সঙ্গে ঠাট্টা করতেন। ওঁর এত সুন্দর হাতের লেখা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সাবজেক্ট যখন শোনাতেন অভিনয় করে, সংলাপ বলে বুঝিয়ে দিতেন। পরিচালক তনুদার থেকেও আমি মানুষ তনুদাকে খুব খুব মিস করব।
স্বতন্ত্র ধারার এক পরিচালক
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
আমি তরুণ মজুমদারের সঙ্গে কাজ করিনি। কিন্তু অসামান্য প্রতিভাবান মানুষ। কথাবার্তায় ভীষণ ভাল। ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমার সঙ্গে খুব ভাল ছিল। ওঁর কাজ আমরা দেখেছি। খুব স্বতন্ত্র ধারার, স্বতন্ত্র ভাবনাচিন্তার একজন পরিচালক। ওর ছবিগুলো এক অন্য বার্তা নিয়ে আসে। আমার একবার ওঁর ছবিতে কাজ করার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি।
উঁচুদরের পরিচালক ছিলেন
রঞ্জিত মল্লিক
তরুণ মজুমদার (Director Tarun Majumdar) একজন খুব উঁচুদরের পরিচালক। ওঁর সঙ্গে কাজ করতে পারাটা সৌভাগ্যের ছিল আমার জন্য। আমার প্রিয় পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম। খুব অভিজ্ঞ একজন মানুষ। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটা করতেন। এক-একজন পরিচালক এক-এক রকম স্টাইলে কাজ করেন। ওঁর সমসাময়িক যাঁরা পরিচালক প্রত্যেকেই খুব প্রতিভাবান। তনুবাবুও তাই। ছবির খুঁটিনাটির দিকে নজর দিতেন। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মানুষ ছিলেন কিন্তু কাজের সময় ততটাই সিরিয়াস।