কথামুখ
এক অত্যাচারী লম্পট পাপ পুণ্য জ্ঞানহীন জমিদার ছিলেন জীবানন্দ। তিনি তাঁর বিবাহিত স্ত্রী ষোড়শীকে পরিত্যাগ করেছিলেন। চণ্ডীগড়ের ভৈরবী সেই ষোড়শীর পুনরায় সংস্পর্শে এসে জীবানন্দের অভূতপূর্ব পরিবর্তন হয়েছে। পাপে আকণ্ঠ ডুবে থাকা জীবানন্দের অন্তরে যে ভালবাসার গুণ আর ভদ্রজীবন যাপনের স্পৃহা ছিল তা যেন ষোড়শীর সংস্পর্শে এসে হঠাৎ নবজীবন লাভ করে ফুলে-ফলে মঞ্জরিত হয়ে উঠেছে। এই অপূর্ব চরিত্রটি জীবানন্দকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করে তাঁর পাষাণ প্রাণকে দ্রবীভূত করেছে ও জীবানন্দকে প্রথম প্রেমের স্বাদ এনে দিয়েছে। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের রচনার গুণে ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসটি আজও পাঠকের এত প্রিয়। সেই উপন্যাসের চিত্ররূপ দিলেন পশুপতি চট্টোপাধ্যায়। ছবির নাম ‘ষোড়শী’। নামভূমিকায় অভূতপূর্ব অভিনয় দর্শক সমালোচকদের প্রশংসা ধন্য হয়েছিল। বিপরীতে জীবানন্দের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস।
আরও পড়ুন-বিজ্ঞানের আলোকপ্রাপ্তা কমল রণদীভ
জীবনকথা
দীপ্তি রায়ের জন্ম ১৯২৯ সালে কলকাতায়। পারিবারিক কারণে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়াশোনা করতে পারেননি। গান জানেন। সুন্দর গিটার বাজাতে পারেন। বিয়ে করেননি। দীপ্তি রায়ের চলচ্চিত্র জগতে আসার মূলে ওর বান্ধবী মণিকার অবদান অনস্বীকার্য। প্রখ্যাত পরিচালক অভিনেতা ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (সংক্ষেপে ডিজি)-এর মেয়ে মণিকার বড় পর্দায় অভিনয় দেখে ছবির জগতে অভিনেত্রী রূপে আত্মপ্রকাশের প্রথম ইচ্ছে জেগেছিল দীপ্তির অন্তরে। মণিকার প্রচেষ্টাতেই মণিকার বাবা ডিজি নরেশ মিত্রকে নিয়ে হাজির করেন দীপ্তি রায়ের বাড়িতে। নরেশ মিত্রের নির্মীয়মাণ ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় সুযোগ পেলেন তিনি। হাবাগোবা স্বামীকে (গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) সুস্থ-সতেজ করে তুললেন যে স্বয়ংসিদ্ধা, তিনি অনায়াসেই দর্শকদের মুগ্ধ করলেন ।
আরও পড়ুন-আলোর পথের দিশারি
চলচ্চিত্রে জয়যাত্রা
স্বয়ংসিদ্ধার পর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি দীপ্তি রায়কে। তবে বরাবর দীপ্তি রায় চরিত্র নির্বাচনের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে ছিলেন। নায়িকার চরিত্রেই হোক কিংবা অভিনেত্রীর ভূমিকাতেই হোক তিনি সর্বদা ছিলেন খুঁতখুঁতে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানী’ উপন্যাসের চিররূপে দীপ্তি রায়ই রাধারানী হয়েছিলেন। ‘সতীর দেহত্যাগ’ ছবিতে তিনি দক্ষরাজ (কমল মিত্র)-এর কন্যা সতী। বিপরীতে রাজা মুখার্জি (শিব ঠাকুর)। ‘শিব শক্তি’ ছবিতেও তিনি রাজা মুখার্জিকে পেলেন শিব রূপে। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ছবিতে তিনি রাইচরণের (উত্তমকুমার) মনিবগিন্নি। ‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে তিনি শাজাহান হোটেলে নৈশ-অভিযানকারী মিসেস পাকড়াশী। দুরন্ত সে অভিনয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের চিত্ররূপে তিনি লাবণ্য। বিপরীতে নির্মলকুমার (অমিত)। ‘বিচারক’ ছবিতে উত্তমকুমার জ্ঞানেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন। দীপ্তি রায় তাঁর প্রথমা স্ত্রী সুমতি। দাপটের সঙ্গে সেই অভিনয়। ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে তিনি ধীরাপদর (উত্তমকুমার) চারুদিদি। ‘সবরমতী’ ছবিতে নায়ক শঙ্করের (উত্তমকুমার) বিধবা দিদি। ‘রাজকুমারী’ ছবিতেও তিনি নায়ক নির্মলের (উত্তমকুমার) দিদি। ‘হরিশ্চন্দ্র’ ছবিতে তিনি হরিশচন্দ্রের (নীতীশ মুখোপাধ্যায়) সর্বংসহা স্ত্রী শৈব্যা। ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবিতে মৃত্যুপথযাত্রী শ্বশুরের (জহর গঙ্গোপাধ্যায়) বিধবা পুত্রবধূ।
আরও পড়ুন-রথের চাকায় বাংলার যোগ
বিখ্যাত পরিচালকদের ছবিতে কাজ
দীপ্তি রায় তাঁর সময়ের বহু বিখ্যাত পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন। তালিকাটা দেখে নেয়া যাক। মধু বসু (শেষের কবিতা), প্রভাত মুখোপাধ্যায় (বিচারক), অগ্রদূত (খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন), নির্মল চৌধুরি (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন), অসিত সেন (জীবন তৃষ্ণা), পিনাকী মুখোপাধ্যায় (চৌরঙ্গী), সবরমতী (হীরেন নাগ), সলিল সেন (রাজকুমারী), সলিল দত্ত (বাবুমশাই), পীযূষ বসু (দুই পৃথিবী), অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় (নায়িকার ভূমিকায়), দীনেশ গুপ্ত (শ্রীকান্তের উইল) প্রমুখ পরিচালকদের ছবিতে প্রাণঢালা অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর আরও দুটি ছবির কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। গায়ক ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলায় একটিমাত্র ছবি পরিচালনা করেছিলেন। আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনি অবলম্বনে ‘অনিন্দিতা’। সেখানে পিরগঞ্জের কালীমন্দিরের ভৈরবী চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই চরিত্রে দারুণ করেছিলেন তিনি। দীপ্তি রায়ের অপর ছবিটি হল ‘অন্তরীন’ (১৯৯৪)। এটি দীপ্তি রায়ের শেষ ছবি। পরিচালক মৃণাল সেন। সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছিলেন ডিম্পল কাপাডিয়া ও অঞ্জন দত্তকে।
আরও পড়ুন-টাকা নিয়ে যাদবপুরে শ্যুটিং করাল এসএফআই
শেষের কথা
চলচ্চিত্র ছাড়া আর কোনও মাধ্যমে তিনি অংশ নেননি। যাত্রা-থিয়েটার-রেডিও-সিরিয়াল সব কিছু থেকেই ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু পর্দার বাইরে কখনও সাড়া দেননি। যখন বুঝলেন চলচ্চিত্রে তাঁর দেওয়ার কিছু নেই তখন সেখান থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। এতে আক্ষেপের কিছু নেই। কারণ তিনি যা দিয়ে গেছেন তার তুলনা নেই। সেখানে তিনি ভাস্বর হয়ে থাকবেন। ২০১১ সালের ২৪ জুলাই নজরুল মঞ্চে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মহানায়ক সম্মানে’ ভূষিত করেন দীপ্তি রায়কে। তিনি যেহেতু হুইলচেয়ারে করে এসেছিলেন তাই মুখ্যমন্ত্রী নিজে মঞ্চ থেকে নেমে এসে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেন। তাঁর মৃত্যু বড় মর্মান্তিক। তিনি একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন অসুস্থ অবস্থায়। ২০১২ সালের ২৭ অগাস্ট তিনি মারা যান। কিন্তু পুরো টাকা না পেলে শবদেহ নার্সিংহোম থেকে ছাড়া হবে না— এই খবর জানতে পেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেন পুরো টাকাটা নার্সিংহোমকে দিয়ে শবদেহের সৎকার করতে। সে-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন তিনি। যিনি এত ছবিতে আমাদের মুগ্ধ করেছেন, তাঁর জীবনের এমন পরিণতি বেদনাদায়ক বললেও কম বলা হয়।