সারনাথের স্তম্ভেও (Ashoka Stambh Controversy) সিংহ ছিল।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ‘সিংহ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিতে হিংসা ঘাপটি মেরে বসে আছে। Ö ‘হিন্স্ + অ’ এই হল সিংহের প্রকৃতি প্রত্যয়। অর্থাৎ মূল ধাতুতে হিংসা আছেই।
নির্মীয়মাণ সেন্ট্রাল ভিস্তার শীর্ষচিহ্ন হিসেবে যে সিংহ চতুষ্টয়ের ব্রোঞ্জমূর্তি পূজিত হয়ে স্থাপিত হতে চলেছে, তাতে সেই হিংসাটাকে মোদিজিরা প্রকট করে তুলেছেন। অশোক-স্থাপিত স্তম্ভে সিংহমূর্তিতে বলের প্রকাশ ছিল। সেটাতে সিংহপেশিতে ছাগলের ভীরুতা বিম্বিত হত, এমনটা নয়। কিন্তু সেই সিংহগুলোর মধ্যে একটা রাজকীয় ধী ভাবের প্রকাশ ছিল। সেই সমাহিত ভাবটা এখন বেবাক উধাও। অশোকস্তম্ভের সিংহের চেহারায় শান্ত সমাহিত রাজকীয় প্রকাশ কোনও কষ্টকল্পনার বিষয় নয়।
আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতবর্ষ আগে এস পি গুপ্তা একটা বই লিখেছিলেন— নাম ‘দ্য রুটস অব ইন্ডিয়ান আর্ট’। অর্থাৎ, ভারতীয় শিল্পকলার শিকড়। সেখানে অশোকস্তম্ভের সিংহের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।
এবং তথায় লেখক নির্দ্বিধভাবে জানিয়েছেন, ‘‘(The Ashokan lions) were never expected to rouse fear in the minds of the onlookers while their West Asian cousins were invariably meant to inspire awe and fear.” অস্যার্থ, অশোকস্তম্ভের সিংহ পশ্চিম এশিয়ার সিংহের মতো দর্শকের মনে ভয় জাগিয়ে তোলে না।
এরকম সিংহ মোদিজিদের পছন্দ হবে কেন? সংবিধানসম্মত জরুরি অবস্থা জারি না করেও জরুরি অবস্থার ভীতি ও ভয়াবহতা যাতে সমগ্র দেশে বিরাজ করে, সেটাতেই তো তাঁদের যাবতীয় আগ্রহ। সারা দেশে প্রতিবাদী শিরদাঁড়ায় ভয়ের হিমেল স্রোত ছড়ানোতেই তো তাঁদের শাসন-জমানার সার্থকতা।
আরও পড়ুন: নতুনের কথা বলে লক্ষ্মী ছেলে
অশোক-নির্মিত স্তম্ভের (Ashoka Stambh Controversy) সিংহগুলিকে ভালভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় তাদের পায়ের শিরাগুলো স্বাভাবিকভাবে সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেগুলোতে কোনও আরোপিত বলিষ্ঠতা নেই। পক্ষান্তরে, আ-মোদিত সিংহগুলির পায়ের পেশিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই যেন শিরাগুলি রচিত হয়েছে। সেগুলির বলিষ্ঠতা, সেগুলির তীব্রতা, ভীষণ ভীষণই স্পষ্ট। সেগুলোর পাশে অশোকের সিংহ-পেশি নেহাতই নিরামিষাশী, রোগাপটকা, দুর্বল। এই যে সিংহ-লাঞ্ছিত জাতীয় প্রতীক, সেটির ইতিহাসের দিকে তাকালে কিন্তু দুই যুগের শিল্পীর মনোলোকের তফাতটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
গুপ্তযুগেও অশোকস্তম্ভের (Ashoka Stambh Controversy) সিংহমূর্তির প্রতিরূপ নির্মিত হয়েছিল। জন মার্শাল সারনাথের অশোকস্তম্ভ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর জেনারেল। গুপ্তযুগের সিংহ-স্থাপত্য দেখে সেই জন মার্শালের মন্তব্য, সেটি ছিল আসলের ‘a feeble and clumsy imitation’। দুর্বল এবং জঘন্য অনুসরণ। সাঁচীর সিংহের গুপ্তযুগীয় পুনর্নিমাণ সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার মতামত, সেটিতে মূলের প্রতি ‘little regard for truth and little artistic feeling’ প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থাৎ মৌর্যযুগের মূল মূর্তির সঠিক অনুসরণ গুপ্তযুগেও দেখা যায়নি।
তাইল্যান্ডে দ্বিতীয় শতাব্দীতে অশোকচক্রের অনুকরণে যে ধর্মচক্রগুলি তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর কথাও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার। সেখানে অশোক-নির্মিত চক্রের তুলনায় বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব স্পষ্টতর এবং দৃঢ়তর।
বুদ্ধের সঙ্গে, বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে অশোকচক্র বা ধর্মচক্রের এই যোগসূত্রটাকেই নতুন আলোয় তুলে ধরেছিলেন জওহরলাল নেহরু। অশোকের ধর্মচক্রকে যখন তিনি জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করলেন তখন সেটিকে নিছক বৌদ্ধধর্মের সংযোগ থেকে বের করে এনে ভারতীয় সভ্যতার বহুকালাগত সংস্কৃতির সঙ্গে অন্বিত করেছিলেন। নেহরুকৃত এই পরিবর্তনের পক্ষে সওয়াল করেছেন বাসুদেবশরণ আগরওয়াল। তিনিও নেহরুর সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন, অশোকচক্র নিছক বুদ্ধদেবের সারনাথে ধর্মপ্রচারের সঙ্গে লেগে থাকা একটা প্রতীকমাত্র নয়। এতে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা ভারতবাসীর ধর্মীয়, দার্শনিক বিশ্বাস প্রতীকী তাৎপর্যে পরিস্ফুট। তাঁর ভাষায়, এটি ‘‘not a sectarian concept but was the fruit of number of religious, philosophic and cult motifs which received approval for thousands of years in the accumulated tradition of the Indian people.”
এ-সবকিছুই একেবারে বদলে গেল মোদি জমানার সিংহস্তম্ভে। পরিবর্তন ঘটানো হল, যদিও ভারতের জাতীয় প্রতীক আইনে এ-ধরনের কোনও রদবদল করা যাবে না, সেকথা পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগে বিহারের রাজনীতিতে জাতিগত রাজনীতির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিলেন অশোক। বিহারের কুশওয়া জাতির পূর্বপুরুষ হিসেবে অশোকের বন্দনায় মদত জুগিয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি, কারণ, বিহারের ভোটের প্রায় ৯ শতাংশ ওই কুশওয়া সম্প্রদায়ের ভোট। এবার, অশোকস্তম্ভের সিংহের রূপে ও ভাবে বদল ঘটানো হল। বদল ঘটানো হল, কারণ অশোক-প্রবর্তিত অহিংস জনকল্যাণের ভাবাদর্শে নতুন রাষ্ট্রশাসকেরা বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন না বলেই, ১১ জুলাই হিংস্র আগ্রাসী সিংহমূর্তি পূজন-অর্চনের ৭২ ঘণ্টা কাটতে না-কাটতেই এল সংসদীয় ফতোয়া। লোকসভার সচিবালয় থেকে প্রকাশিত হল বুকলেট। তাতে সাফ বলে দেওয়া হল, ‘‘দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী, বিশ্বাসঘাতক, অযোগ্য, দ্বিচারী, অসত্য, অপমান, কাপুরুষ, গুন্ডামি, নাটক” ইত্যাদির মতো সাধারণ শব্দও ‘অসংসদীয়’। এককথায়, এই ‘হিংস্র’ সরকার তার সমালোচনায় ব্যবহৃত হতে পারে, এরকম যাবতীয় শব্দকে ‘অসংসদীয়’ হিসেবে চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা করল।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় আক্ষেপ করছিলেন, সারনাথের অশোকস্তম্ভ এবং নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে অঙ্কিত অশোকস্তম্ভ, দুটোতেই যে অহিংসার বার্তা অণ্বিত ছিল, তা বদলে গিয়ে সংসদভবনের শীর্ষে বসানোর জন্য যে সিংহমূর্তি নির্মিত হয়েছে সেটিতে হিংসার উদগ্র প্রকাশ স্পষ্ট।
ব্রোঞ্জ-নির্মিত বিকটদর্শন বিরাট সিংহমূর্তি প্রকাশ্যে আসার পর যা যা ঘটছে তাতে স্পষ্টতর, আলো ক্রমে কমিতেছে। সমাগত এই অন্ধকারে মানবিকতা ও গণতন্ত্র— দুইয়েরই বিপন্নতার ইঙ্গিত স্পষ্টতর।
এখনও যদি আমাদের প্রতিবাদের ভাষা, আমাদের প্রতিরোধের আগুন দ্বিগুণ হয়ে না জ্বলে, তবে চিরায়ত তমিস্রাই হবে ভারতীয় গণতন্ত্রের অনিবার্য আশ্রয়।