টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত টেকনিশিয়ানস স্টুডিও। মহানায়ক উত্তমকুমার মেট্রো স্টেশন থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে। এই মুহূর্তে প্রতিদিন প্রায় কয়েকশো মানুষের অন্নসংস্থান হয় এই স্টুডিওয়। অভিনেতা, অভিনেত্রী, প্রযোজক, পরিচালক থেকে টেকনিশিয়ান, ব্যস্ত সবাই। বিভিন্ন ফ্লোর গমগম করে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। কাজের সময় মোটামুটি সাড়ে দশ ঘণ্টা। তবে প্রয়োজনে কোনও কোনও প্রযোজক বেশি সময় ভাড়া নেন। সিনেমার শুটিং হয়। তবে বর্তমানে টেকনিশিয়ানস স্টুডিওয় বেশি হচ্ছে মেগা সিরিয়ালের শুটিং। কখনও কখনও রিয়েলিটি শোয়ের কাজ।
আরও পড়ুন-রনিলকে চায় না বিক্ষোভকারীরা, এগিয়ে সাজিথ
লকডাউনের সময় কয়েক মাস বন্ধ ছিল। এর বাইরে প্রত্যেকটি দিন স্টুডিওর প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে জ্বলে ওঠে আলো, সচল হয়ে ওঠে ক্যামেরা, নিজেদের উজাড় করে দেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভিতরে একটা মস্ত বড় ইন্ডাস্ট্রি চলছে। তৈরি হচ্ছে মনোরঞ্জনের উপাদান। দর্শকরা দেখছেন, নির্মাতাদের কাজের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে। বিনিয়োগ হচ্ছে মোটা টাকা। হচ্ছে মুনাফা। এখানে কেউ অ্যামেচার নয়। সবাই পেশাদার। সারাদিন পরিশ্রম। বিনিময়ে উপার্জন। এক-আধ দিন নয়, প্রতিদিন। মাসের পরে মাস, বছরের পর বছর। গত কয়েক বছরে এই জগতের প্রায় প্রত্যেকেই পেয়েছেন নিরাপত্তা।
আরও পড়ুন-কপ্টার ভেঙে মৃত ১৪
শিল্পী কলাকুশলীদের কাছে টেকনিশিয়ানস স্টুডিও আসলে মন্দিরের মতো। আছে আরও অনেক স্টুডিও। তবে এই স্টুডিওর চাহিদা বাকিগুলোর তুলনায় বেশি। কারণ এর পিছনে আছে রাজ্য সরকার। নায্যমূল্যে স্টুডিও ফ্লোর ভাড়া পাওয়া যায়। পাশাপাশি আছে প্রচুর সুযোগ-সুবিধাও। প্রতিমুহূর্তে এখানে হয় নিত্যনতুন ভাবনার জন্ম। সাধারণ দর্শকরা হয়তো তার বিন্দুমাত্র খবর রাখেন না।
১৯৩৫ সালে শুরু। সেইসময় নাম ছিল কালী ফিল্মস স্টুডিও। মালিক ছিলেন প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রসন্ন ঘোষ, গিরিজাপ্রসন্ন ঘোষ। তখন সাদা-কালো ছবির যুগ। বহু উল্লেখযোগ্য ছবির শুটিং হয়েছে এই স্টুডিওয়। একটা সময় দেখা দেয় মহা সমস্যা। ১৯৫২ সালে স্টুডিওর হাল ধরেন কয়েকজন টেকনিশিয়ান। ১৯৫৪ সালে স্টুডিওর নামকরণ করা হয় টেকনিশিয়ানস স্টুডিও প্রাইভেট লিমিটেড। শুরু হয় নতুন পথচলা।
আরও পড়ুন-মাঝ আকাশে বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষা ২২২ যাত্রীর
তারপর থেকে স্টুডিওয় কাজ শুরু করেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা, কিছু পরে তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকরা। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’, ‘মহানগর’, ‘দেবী’, ‘সমাপ্তি’ প্রভৃতি ছবির শুটিং হয়েছে এই টেকনিশিয়ান স্টুডিওয়। এখানেই তৈরি হয়েছে মৃণাল সেনের ‘আমার ভুবন’, রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’, হরিদাস ভট্টাচার্যর ‘আঁধারে আলো’, অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘শুভ মহরত’, ‘তিতলি’, ‘চোখের বালি’ প্রভৃতি ছবি। ছবিগুলো বিভিন্ন সময় পেয়েছে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার। হরিদাস ভট্টাচার্যের ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, তপন সিনহার ‘সাগিনা মাহাতো’, সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’, ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘মৌচাক’, তরুণ মজুমদারের ‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’, দিলীপ রায়ের ‘দেবদাস’, প্রকৃতি উল্লেখযোগ্য ছবিরও শুটিং হয়েছে এখানেই।
আরও পড়ুন-হু-র সতর্কবার্তা
মহানায়ক উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে অতীত ও বর্তমান সময়ের বহু জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন এই স্টুডিওয়। এখানেই জীবনের শেষ শুটিং করেছেন মহানায়ক উত্তমকুমার। ছবির নাম ‘ওগো বধূ সুন্দরী’।
ছয় এবং সাতের দশকে বহু গানের রেকর্ডিং হয়েছে এই স্টুডিওয়। এখানেই সুরের মায়াজাল বিস্তার করেছেন আলি আকবর খান, রবিশঙ্কর, বড়ে গোলাম আলি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, নচিকেতা ঘোষ প্রমুখ কিংবদন্তিরা। জন্ম হয়েছে বিভিন্ন ভাষার নতুন নতুন গানের।
আরও পড়ুন-ঋষিকে প্রধানমন্ত্রী পদে মানতে রাজি নন বরিস
আটের দশকে স্টুডিওয় আবারও অন্ধকার নেমে আসে। হয়ে পড়ে রুগ্ণ। কমে আসে কাজ। অন্যতম কারণ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা। ১৯৮৩-র ১মে এই স্টুডিওটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ অধিগ্রহণ করে। কিন্তু তারপরও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ফিরে আসেনি পুরোনো জৌলুস। বরং দিন দিন হয়ে পড়ে ভগ্নপ্রায়। তার মধ্যেই হতে থাকে কিছু কাজ। সেই সময় শুরু হয় টেলিভিশন মেগা সিরিয়াল। বিষ্ণুপাল চৌধুরীর ‘জন্মভূমি’ এবং ‘জননী’। দূরদর্শনের এই দুই মেগা সিরিয়ালের শুটিং হয়েছে এই স্টুডিওতেই। বহু সমস্যার মধ্যেই। ফ্লোরের আলো জ্বলত না প্রতিদিন। দিনে দিনে স্টুডিওটি হয়ে পড়ে আরও রুগ্ণ। কর্মহীন হয়ে পড়েন বহু মানুষ।
২০১১ সাল। রাজ্যে ঘটল রাজনৈতিক পালাবদল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ক্ষমতায় এসেই স্টুডিওটি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন। নবজন্ম হয় টেকনিশিয়াস স্টুডিওর। আগে যেখানে ছিল মাত্র দুটি স্টুডিও ফ্লোর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তৈরি হল অত্যাধুনিক ছ’টি স্টুডিও ফ্লোর। উত্তমকুমার, তপন সিনহা, সুচিত্রা সেন, সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং ঋত্বিক ঘটকের নামে। ফ্লোরগুলি বিভিন্ন সাইজের। বেশির ভাগই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি ফ্লোরে আছে ৪টি মেকআপ রুম, ১টি কস্টিউম রুম, প্রোডাকশন রুম, মিল রুম, ক্যানটিন, বাথরুম ইত্যাদি। সব থেকে বড় কথা, সব ফ্লোরেই আছে খোলামেলা কাজের পরিবেশ। সেই কারণে স্টুডিও ফ্লোরগুলোর দারুণ চাহিদা। গত কয়েক বছরে বহু জনপ্রিয় মেগা সিরিয়ালের শুটিং হয়েছে এখানেই।
আরও পড়ুন-যশোবন্ত সিনহাকেই সমর্থন করবে আপ
এই মুহূর্তে সরগরম টেকনিশিয়ানস স্টুডিওর প্রত্যেকটি ফ্লোর। চোখে পড়ছে চরম ব্যস্ততা। প্রতিদিন হচ্ছে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের কয়েকটি মেগা সিরিয়ালের শুটিং। তার মধ্যে অন্যতম ‘বোধিসত্ত্বের বোধবুদ্ধি’, ‘সুন্দরী’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘উড়ন তুবড়ি’। প্রত্যেকটি সিরিয়ালই এককথায় বাণিজ্য সফল।
আছে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংগঠন এবং টেকনিশিয়ানদের সংগঠন। প্রত্যেকটি সংগঠনই খুশি সরকারি ব্যবস্থাপনায়। তাঁদের বক্তব্য, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে এই ইন্ডাস্ট্রি এবং টেকনিশিয়ানস স্টুডিওর পাশে দাঁড়িয়েছেন, আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী বা সরকার সেইভাবে এগিয়ে আসেননি। পাশে দাঁড়াননি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি টেকনিশিয়ান স্টুডিওকে নতুন রূপে গড়ে তুলেছেন বলেই বেড়েছে কাজের সুযোগ, তৈরি হচ্ছে অনেক বেশি বেশি সিনেমা এবং সিরিয়াল। জোয়ার এসেছে বিনোদন জগতে। তিনি তৈরি করেছেন টেলি আকাদেমি। এই নবগঠিত আকাদেমিও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বলা যায়, গত কয়েক বছরে সিনেমার পাশাপাশি বিপ্লব ঘটে গেছে টেলি ইন্ডাস্ট্রিতে। সেটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর সার্বিক সহযোগিতায়। আশা করা যায়, আগামী দিনে আরও বেশি আলোর মুখ দেখবে এই ইন্ডাস্ট্রি।
আরও পড়ুন-দেশের প্রত্যেকটা রাজ্যকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে: সুচরিতা বসু
লীনা গঙ্গোপাধ্যায়
আছে উন্নত পরিকাঠামো। ফ্লোরগুলো খুব উন্নতমানের। সবরকমের উপযোগিতা এবং নিয়মকানুন মেনে করা। আছে নিরাপত্তা। চারপাশের দু-একটা স্টুডিওর সঙ্গে তুলনা করলে এটা বেশ ভাল বোঝা যায়। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্টুডিওকে নতুন রূপদান করেছেন। কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। আমি এখানে কাজ করি। এই মুহূর্তে টেকনিশিয়ানস স্টুডিও দ্য বেস্ট স্টুডিও।
আরও পড়ুন-সংবাদমাধ্যমকে লভ্যাংশ দিয়েই ব্যবসা করতে হবে গুগল, ফেসবুককে
বিশ্বনাথ বসু
টেকনিশিয়ানস স্টুডিও গত কয়েক বছরে খুবই সুন্দর হয়েছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন ভাবে গড়ে তুলেছেন। হয়েছে আধুনিকীকরণ। সুন্দর ফ্লোর, লিফট, বাথরুম, ক্যানটিন। মুখ্যমন্ত্রী ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভেবেই এটা করেছেন। আমাদেরও রক্ষা করতে হবে। এই মুহূর্তে আমি টেকনিশিয়ানস স্টুডিওয় শুটিং করছি। ‘বোধিসত্ত্বের বোধবুদ্ধি’ মেগা সিরিয়ালের। খুব ভাল কাজ হচ্ছে।
ইন্দ্রাণী হালদার
স্টুডিওর যে স্ট্রাকচার ছিল সেটা পুরোটাই বদলে দিয়েছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে। ফ্লোর থেকে শুরু করে সমস্তকিছু হয়েছে দারুণ। সবথেকে বড় কথা, পুরো স্টুডিওর উন্নতি হয়েছে। অফিস পেয়েছে সংগঠনগুলো। ফ্লোরের নামকরণগুলোও খুব সুন্দর হয়েছে। যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়েছে কিংবদন্তিদের। এখানে আমি বহু সিরিয়াল ও সিনেমার শুটিং করেছি।