ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসের পাতায় মেদিনীপুরের নাম স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করবে চিরকাল। একই সঙ্গে অহিংস ও সহিংস আন্দোলনের আলোকোজ্জ্বল পথরেখাও নির্মাণ হয়েছিল এই জেলায়। একদিকে বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, অন্যদিকে গান্ধীবাদী দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। একদিকে গান্ধীবুড়ি মাতঙ্গিনী হাজরা, অন্যদিকে গান্ধী-অনুগামী চারুশীলা দেবী।
আরও পড়ুন-খোলা চিঠি
কে এই চারুশীলা দেবী?
অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার দুর্ধর্ষ গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেন কুমারচন্দ্র জানা। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ‘কংগ্রেস’ এই নামটি অতি অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে-বউয়ের মুখে কেউ যদি প্রথম তুলে দিয়ে থাকেন, তবে তিনি দেশপ্রাণের সুযোগ্য শিষ্য কুমারচন্দ্র জানা। বীরেন্দ্রনাথের দেহাবসানের পর কুমারচন্দ্রের মতো অন্য কোনও কংগ্রেস নেতা পায়ে হেঁটে হেঁটে জনসংযোগের চেষ্টা করেননি। তিনি পেয়েছিলেন তাঁর জীবনযাপনে বীরেন্দ্রনাথের মতো ইস্পাতকঠিন দৃঢ়চরিত্র, গান্ধীজির আদর্শনিষ্ঠা, গ্রাম্য অতি সহজ ও সরল কাজকর্মে গান্ধীমন্ত্র, কথায়-চলায়-বলায় সম্পূর্ণ মেদিনীপুরের গ্রাম্যভাব, যা তাঁকে তৎকালীন সাধারণ মানুষের নিকটতম প্রিয়জন করেছিল।
তিনি অগ্নিগর্ভ মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন বারো বছর। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে ১২ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। তাই এই কথাই সত্যি, ‘কুমারচন্দ্র অজগাঁয়ের চাষার ছেলে না হয়ে যদি শহুরে হতেন তাহলে সারা বাংলায় এক প্রাতঃস্মরণীয় জননায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতেন।’
আরও পড়ুন-টেলি-ইন্ডাস্ট্রিতে জোয়ার, সরগরম টেকনিশিয়ানস স্টুডিও
সেই অদম্য সাহসী ও সংগ্রামী সাধক কুমারচন্দ্র জানার স্ত্রী ছিলেন চারুশীলা দেবী। বিবাহিত জীবনে সারাটা সময় স্বামীর পদানুসরণ করে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
চারুশীলা দেবী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০২ সালে মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটা থানার ভূঞ্যারাচক গ্রামে। পিতার নাম রমানাথ সামন্ত এবং মাতা ছিলেন রমণী সামন্ত।
ছোটবেলা থেকেই স্বদেশানুরাগী পিতার কাছে দেশপ্রেমের দীক্ষা পেয়েছিলেন। তাঁর পিতা নিজের গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। চারুশীলা দেবী পড়াশোনা ও হাতের কাজে পারদর্শী ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। ১৯১২ সালে ২৩ বছরের কুমারচন্দ্র জানার সঙ্গে এগারো বছর বয়সি চারুশীলা দেবীর বিবাহ হয়।
আরও পড়ুন-রনিলকে চায় না বিক্ষোভকারীরা, এগিয়ে সাজিথ
তারপর থেকেই স্বামীর আন্দোলনের পথে নিজেকে তৈরি করেন। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, সুতাহাটার বাসুদেবপুর গ্রামে কুমারচন্দ্র জানা প্রতিষ্ঠা করেন গান্ধী আশ্রম। যখন কুমারচন্দ্র জানাকে ইংরেজ রাজসরকার জেলে বন্দি করে রাখত, তখন সেই আশ্রমকে শক্ত হাতে আগলে রাখতেন এবং পরিচালনা করতেন চারুশীলা দেবী।
মনের দিকে দৃঢ় ও সাহসী নারী ছিলেন। ১৯৩৪ সালে সুতাহাটা থানার আগাদোর গ্রামে ইংরেজ সরকার-বিরোধী পুস্তিকা বিতরণ করেন একাই এবং এই কাজের জন্য তিনি তিন মাস বহরমপুর জেলে বন্দি ছিলেন। মেদিনীপুরের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল বাসুদেবপুর গান্ধী আশ্রম।
আরও পড়ুন-মাঝ আকাশে বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি, রক্ষা ২২২ যাত্রীর
কী হত গান্ধী আশ্রমে?
মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় শুধু ইংরেজ হঠাও, দেশ বাঁচাও বলে স্লোগান তোলেননি, তিনি দেশ গঠনের জন্য আঠারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তার মধ্যে প্রায় খাদি ও চরকা প্রচলন, মাতৃভাষা চর্চা, কৃষক উন্নয়ন, শ্রমিক উন্নয়ন, ছাত্র সংগঠন, গণশিক্ষা প্রসার, মাদক বর্জন, কুটির শিল্প স্থাপন, সাফাই ও সালিশি সভার আয়োজন এবং নারীকল্যাণ প্রভৃতি অতি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হত। এইসব কাজে মহিলাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন চারুশীলা দেবী। তিনি চরকাকাটা ও প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য গ্রামের মেয়েদের বাড়ি-বাড়ি ডেকে আনতেন, যত্ন করে শেখাতেন এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বপন করতেন।
মেদিনীপুরে অসহযোগ আন্দোলন ও ইউনিয়ন বোর্ড-বিরোধী গণচেতনার কাজে চারুশীলা দেবী গান্ধী আশ্রমকে কেন্দ্র করে গোটা মেদিনীপুরে একটা নারী জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। চারুশীলা দেবী বাসুদেবপুর গান্ধী আশ্রমের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন। এমনকী কংগ্রেসের সংগঠনের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী কুমুদিনী ডাকুয়া জানান, ‘তমলুকের নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন, দেশ স্বাধীন করতে হলে মেয়েদের সাহায্য প্রয়োজন। তাই তাদের প্রস্তুত করার জন্য ১৯৪১ সালে বাসুদেবপুর গান্ধী আশ্রমে বিপ্লবী সুশীলকুমার ধাড়া ও ক্ষুদিরাম ডাকুয়া ব্যবস্থা করেন ১৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণ শিবির।’ তাতে অংশগ্রহণ করেন সাধারণ গ্রাম্য দরিদ্র বিধবা, অশিক্ষিত রমণী থেকে অভিজাত ঘরের শিক্ষিত মহিলারাও। এমনকী পতিতাপল্লির মেয়েরাও সম্মানের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল দেশসেবার কাজে। একদিকে যেমন ডাঃ প্রফুল্ল ঘোষ, অজয়কুমার মুখার্জি, সতীশচন্দ্র সামন্ত, ডাঃ জনার্দন হাজরা, চুনীলাল কুইতির মতো পুরুষেরা কাজ করছেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁদের পাশাপাশি বাসন্তী কর, সুবোধবালা কুইতি, সুশীলা জানা, প্রভাবতী সিংহ, কুমুদিনী ডাকুয়া, গিরিবালা দে প্রমুখ। আর এঁদের সকলের কাছে চারুশীলা দেবী হয়ে উঠেছিলেন একটি বৃক্ষসম আশ্রয়, সকলের ‘মাসিমা’।
আরও পড়ুন-হু-র সতর্কবার্তা
এই সময় শুধুমাত্র গৃহের মধ্যে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাননি চারুশীলা দেবী, ১৯৪১ সালের ১০ জানুয়ারি সুতাহাটা থানার লবণ সত্যাগ্রহ পরিচালনার নেতৃত্ব দেন। তিনি মিছিল করে এগিয়ে যান সুতাহাটা থানার দিকে এবং সুতাহাটা থানা দখল করে নেন। মেদিনীপুরের মাটিতে এটি এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এইভাবে একদিকে গান্ধী আশ্রমে মহিলাদের মধ্যে দেশাত্মবোধক বীজ সঞ্চার করা, অন্যদিকে স্বাধীনতার জন্য নানা সময়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ একই সঙ্গে করতে লাগলেন চারুশীলা দেবী। অর্থাৎ একই সঙ্গে দেশোদ্ধার ও দেশগঠন— দশভুজা শক্তিময়ীর মতো কাজ করে যাচ্ছিলেন। এবং এইসব কাজে সকলকে নিয়ে চলার উদারপন্থী ছিলেন। সংগ্রামী সাধক কুমারচন্দ্র জানা প্রায় গাইতেন—
‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন
এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন’।
আরও পড়ুন-টাকার পতন অব্যাহত
এই গানের মর্মার্থ সারা জীবন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন চারুশীলা দেবী।
ইংরেজ সরকার চারুশীলা দেবীর কর্মতৎপরতা ও দেশাত্মবোধক সচেতনতাকে খুবই সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল।
১৯৩৪ সালে মে মাসে চারুশীলা দেবী এবং তাঁর সঙ্গে সুশীলা বেরা ও গিরিবালা দে একত্রে গ্রেপ্তার হন। বিচারে চারুশীলা দেবীর ৬ মাসের জেল হয়। তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয় এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, চারুশীলা দেবীর সঙ্গে তাঁর পাঁচ বছরের কন্যা মুক্তিবালাও কারাগারে বন্দি থাকে। এই ঘটনা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরল ঘটনা।
এরপর কুমারচন্দ্র জানার ব্যক্তিগত ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রভাবে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী উপস্থিত হন সুতাহাটা থানার গান্ধী আশ্রমে। সেদিন ছিল ১৯৪৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর। বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে মহাত্মা গান্ধী এসে উপস্থিত হন। গাড়ি থেকে নেমেই মহাত্মা বলে ওঠেন, ‘কুমারবাবু, পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেল, আপনি খুশি তো?’
আরও পড়ুন-সুস্থ হয়ে ফিরলেন শিলিগুড়ির মেয়র
আনন্দে অভিভূত কুমারচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমার আশা পূর্ণ। এই আশা পূর্ণ হওয়ার পশ্চাতে কম অবদান ছিল না চারুশীলা দেবীর। তিনি আশ্রমের মধ্যে শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যপূর্ণতার বিষয়টি লক্ষ্য রেখেছিলেন।
নেপথ্যে থেকে আশ্রমের সকল কাজের যোগসূত্রকে বেঁধে রাখা ও ভিত্তিকে সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন সুদৃঢ় করেছিলেন।
প্রায় এক হাজার মানুষ সেদিন আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন। নীরবে ও শ্রদ্ধায় চরকা কেটেছিলেন। মহাত্মা গোটা আশ্রম ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করেন এবং মুগ্ধ হয়ে যান।
কী স্বাধীনতার আগে, কী স্বাধীনতার পরে সংগ্রামী সাধক কুমারচন্দ্র সমগ্র জীবন দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, তেমনি তাঁর মহীয়সী স্ত্রী চারুশীলা দেবীও তাই করেছেন।
সেজন্য স্বয়ং কুমারচন্দ্র জানা বলেছিলেন,
‘যদি আমার স্ত্রী আমার কাজকর্ম ও চলার পথে বাধা হতেন আমার পক্ষে স্বদেশি আন্দোলনে এতখানি সময় ও শক্তি ব্যয় করা সম্ভব হত না। তিনি আমার কাজে বিরোধিতা তো করেনইনি, বরং আমার পথ অনুসরণ করে দুঃখ-কষ্ট বরণ করেছেন এবং জেল খেটেছেন। সেজন্য স্ত্রীর কাছে আমার ঋণ যথেষ্ট।’
তাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চারুশীলা দেবীর মতো অবিস্মরণীয়াকে যদি আমরা বিস্মৃত হই, তাতে আমাদের ইতিহাস যেমন খণ্ডিত হবে, তেমনই ভবিষ্যৎ হবে অনুজ্জ্বল।