অন্তরীক্ষ

Must read

বিতস্তা ঘোষাল: রে, মনোনীত হয়নি। সরি।
হোয়াটসআপে আসা রিপ্লাইটা মোবাইলের স্ক্রিনের ওপরে ভেসে আসা নোটিফিকেশনে এক নজরে দেখল ঋধিমা। দেখার পর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল। যেন সে নিশ্চিত ছিল বাতিল বা রিজেক্ট বা মনোনীত হয়নি, এই উত্তরটাই আসবে। বরং অন্যটা হলেই তার এতদিনের বিশ্বাস, মানুষকে জাজমেন্ট করার ক্ষমতা টলে যেত।
উল্টোদিকের টেবিলের মুখোমুখি চেয়ারে বসে নিষাদের এই হাসিটা চোখে পড়ল। সে কৌতূকের ভঙ্গিতে চোখ নাচিয়ে জানতে চাইল— হঠাৎ এই বাঁকা হাসি?
না এমনি, আমি কি রামগড়ুরের ছানা যে হাসব না?
এড়িয়ে যাচ্ছ। তা না বলতেই পারো, আমি কি আর ইমপরট্যান্ট মানুষ তোমার জীবনে! নিষাদের গলায় বেদনার স্বর।
ঋধিমা সেদিকে লক্ষ্য করে বলল, যখন তুমি নিশ্চিত জানো একটা প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে, আর সেটাই যখন হয়, তখন হাসব না তো কি করব? কাঁদব?
কিছুই বুঝতে পারলাম না। নিষাদের মুখের অবস্থা দেখে ঋধিমার মন খারাপ করল। নিষাদ কী করে জানবে কি জন্য সে হাসল আনমনে! সে বলল, তেমন কিছুই নয়, একটা গেম চলছে গত কয়েক বছর ধরে। সেই গেমের একটা করে ফল ঘোষিত হয়, আমার তখন হাসি পায়।
তার মানে তুমি গেমটায় প্রতিবার জেতো, তাই তো?
হ্যাঁ।
কখনো বলোনি তো তুমি এতগুলো বছর ধরে একটা খেলা খেলছ। এটা কি কোনও অন লাইন খেলা?
নিষাদের কথা শুনে খুব জোরে হেসে উঠল ঋধিমা। না, মাই ডিয়ার এটা কোনও অনলাইন খেলা নয়। এটা জীবনের খেলা।
দূর! কী বলছ কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
এই তুমি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ। বলে একটু ঝুঁকে নিষাদের হাতটা স্পর্শ করল ঋধিমা। সত্যি এটার মধ্যে কোনও গভীর রহস্য লুকিয়ে নেই। একেবারেই মামুলি একটা হিউম্যান সাইকোলজির গল্প, যেটার প্রতিটি পর্বে অন্যদিকের মানুষটা ভাবে সে জিতছে, আর আমি তার মুখের অভিব্যক্তিটা কল্পনা করে হাসি।
কিছুই বুঝতে পারছি না তোমার এই কথাবার্তা। বলে আবার নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেল নিষাদ।
নিষাদের দিকে অল্প কিছুমুহূর্ত তাকিয়ে রইল ঋধিমা। নিষাদ তার খুব ভাল বন্ধু। একই অফিসে তারা দীর্ঘদিন। তাকে কীভাবে বোঝাবে সে এই বিষয়ে! সে নিজেও কি প্রথমে বুঝতে পেরেছিল!
সে ‘নিষাদ সত্যি শুনতে চাও কেন হাসছিলাম’? বলে ভরা চোখে তার দিকে চাইল। নিষাদের মনে হল অনেক কিছু বলার আছে ঋধিমার, যেটা বহুদিন ধরে সে নিজের মধ্যেই আগলে রেখেছে। সে বলল, যদি মনে হয় বললে ভাল লাগবে তাহলে বলো। আমি আর জোর করব না।
ঋধিমা চোখটা টেবিলের দিকে নামিয়ে নিল। দীর্ঘদিন তাকে সামনে থেকে দেখার সূত্রে নিষাদ জানে ঋধিমা যখন কোনও গভীর ভাবনায় ডুবে যায়, তখন তার দৃষ্টি এভাবেই খুব কাছে অথচ বহুদূরের হয়ে ওঠে। সেখান থেকে না ফেরা অবধি বোঝা যায় না সে কী ভাবছিল। তাই চুপ করে অপেক্ষা করল নিষাদ।
এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। পাশে রাখা ফ্ল্যাক্স থেকে দুজনের কাপে চা ঢাললো নিষাদ। সে জানে এই ভাবনা চলাকালীণ ঋধিমা চা পান করে, খালি কাপটাও মুখের সামনে ধরে অভ্যাবশত। এটা যবে থেকে সে উপলব্ধি করেছে, তবে থেকেই ঘরে থাকলে কাপটা ভরে দেয়।
যথারীতি ডান হাতে কাপটা নিয়ে চুমুক দিল ঋধিমা। তার পর বলল, তুমি গান্ধর্ব বলে একটা বিখ্যাত ম্যাগাজিন আছে জানও নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ। এটার নাম কে আর না জানে! সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। আগে পনেরোদিন পর পর বেরত। এখন সাপ্তাহিক। ইনফ্যাক্ট ওখানেই তো তোমার লেখা আমি প্রথম পড়েছিলাম।
হুম। আমার প্রথম গল্প ‘আশাবরী নামের মেয়েটি’ ওরাই প্রথম ছেপেছিল। তার পর আরও বেশ কিছু গল্প, বুক রিভিউ ছাপল। ওখানেই আমার পরিচয় ময়ূখের সঙ্গে।
ময়ূখ মানে তুমি সম্পাদকের কথা বলছ?
হ্যাঁ। আমার পরিচয় অবশ্য সে সম্পাদক হবার অনেক আগে, যখন সে নেহাতই একজন ফ্রিল্যান্সার ওখানকার। বন্ধুত্ব গড়ে উঠল খুব দ্রুত। বয়সে সে খানিকটা বড় হলেও আমি তো চিরকাল পাকা মেয়ে। বড়দের সঙ্গেই আড্ডা বেশি দিতাম। আমাদের এই ব্যাঙ্কের কাজ তো একেবারেই নীরস। তাই ময়ূখ অন্য পেশার হওয়ায় জমে গেল আমাদের। অফিস ছুটির পর আমাদের দেখা হত। যদিও অনিয়মিত। ধরা বাঁধা কোনও কিছুই আমার পছন্দ নয় সে তো জানো। ফলে সে ডালহৌসি-চত্বরে এলে বা আমি ওর অফিসের দিকে গেল দেখা করে নিতাম। খুব ভাল একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আমার অনেক গোপন কথা, তার অনেক না বলা কথা আমরা বিনিময় করতাম। অল্পবিস্তর হাত-ধরা, একটু খুনসুটি, কিন্তু একটা বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় সেটাই বজায় ছিল বা আমি মনে করি এখনও আছে।
সমস্যাটা তাহলে কোথায় হল? নিষাদ জানতে চাইল। তুমি তো আর ওই কাগজে লেখো না দেখি। বন্ধুত্বের পক্ষপাতিত্ব যাতে না হয়, তাই বুঝি লেখা দাও না সে সম্পাদক হবার পর!
ঠিক তা না। আসলে এমন একটা ঘটনা ঘটল যে লেখা ছাপা বন্ধ হয়ে গেল। প্রথমে ভাবতাম সত্যি লেখা পছন্দ হয়নি, আবার পাঠালাম অন্য লেখা। সেটাও বাতিল, এভাবে প্রায় পনেরোটা লেখা বাতিল হল। ময়ূখকে সাধারণত জিজ্ঞেস করতাম না, কেন বাতিল হচ্ছে। তা ছাড়া বাতিল গল্পগুলো যখন অন্য কোনও হাউজে দিচ্ছি সেগুলো সিলেক্ট হয়ে যাচ্ছে, ছাপাও হচ্ছে। এবং মজার ব্যাপার ময়ূখই ফোন করে অভিনন্দন জানাচ্ছে গল্প ভাল হয়েছে বলে। আমার খটকা লাগত। এই গল্পটাই তো সে জানিয়েছিল ভাল হয়নি, এখন উলটো বলছে। কী জানি! তার পর একদিন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে ফেললাম এর রহস্য। ময়ূখ সম্পাদক হবার পর পত্রিকায় কিছু ভুল দেখেছিলাম। আমার তখন তার ওপর অধিকারবোধ তীব্র। সেই তীব্রতা থেকেই বললাম, কী রে ছাপতে দেওয়ার আগে একটু ভাল করে দেখে নিস না কেন, তোর কেউ ভুল ধরলে আমার যে কষ্ট হয়, বড্ড ভালবাসি তোকে।

আরও পড়ুন:মুখ্যমন্ত্রীর বই ফেরি, সঙ্গে একুশের প্রচার

তখন সে কোনও প্রতিবাদ করল না। কিন্তু একটু একটু করে আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। আমি ভাবছিলাম তার কাজের চাপ বেড়েছে। সার্কুলেশন বেড়ে গেছিল সে আসার পর আগের থেকে প্রায় ডবল। ফলে এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া আমারও ডালহৌসি থেকে অফিস এখানে চলে এল। সেন্ট্রাল থেকে একবারে এক্সট্রিম নর্থ ইস্ট। এখান থেকে যাতায়াতের খুবই সমস্যা। তাই যোগাযোগটা কমে গেল। কিন্তু লেখা নিয়মিতই পাঠাতাম। একটা রিজেক্ট বললে আরেকটা। কিন্তু সত্যি কোনও দিন চাপা থাকে না। একদিন খুব কাছের এক বন্ধুকে সে বলে ফেলল আসল কারণটা। তার দপ্তরে পাঠানো আমার একটি লেখাও সে সেদিনের পর থেকে আর পড়েনি। এমনকী আমার কোনও লেখা এসেছে জানতে পারলেও সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। আমি তাকে কখনওই জানাইনি যে আমি জানি প্রকৃত কারণটা।
কেন? এমন আচরণের কারণটা কী?
সাইকোলজি। তার আঁতে ঘা দিয়ে ফেলেছিলাম। সে নামী পত্রিকার সম্পাদক, আমি মামুলি এক লেখক। আমি বন্ধু ভেবেই বলেছিলাম, কিন্তু মানুষের মনের এই জটিল রসায়ন বোঝার সামর্থ্য আমার সেদিন ছিল না।
তাহলে এখনও পাঠাও কেন? জানোই যখন ছাপবে না।
ঋধিমা খানিকক্ষণ চুপ রইল। তারপর বলল, তার থেকে ভাল বন্ধু আমি এখনও কাউকে খুঁজে পাইনি যে!
মানে? নিষাদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
সে যতবার মনোনীত হয়নি বলে ততবার আমার আরও ভাল কিছু লেখার জন্য হাত নিশপিশ করে ওঠে। সে রিজেক্ট করলে বুঝতে পারি লেখাটা হয়েছে, তখন অন্য পত্রিকায় পাঠাই। আসলে মানুষের মনের ভেতরে কী চলে সে কি নিজেও জানে! যদি নিজেই না জানে তবে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে একটা কাজই তার মন তাকে করায়— রিজেক্ট। তাই তার থেকে মনোনীত হয়নি টেক্সট এলেই আমি হাসি।
তার মানে তুমি জেনেশুনেই তাকে জিতিয়ে দাও?
হয়তো। তার প্রতি আমার ভালবাসা, বন্ধুত্ব কোনওটাই মিথ্যে ছিল না, আজও নয়। সে যদি এটায় খুশি হয় হোক।
তুমি তাকে এখনও আগের মতোই ভালবাসো?
আগের থেকেও বেশি।
তোমার রাগ হয় না তার প্রতি?
রাগ! না তো! বরং ইচ্ছে করে যদি সুযোগ আসে কখনও একটা আস্ত বই তাকে উৎসর্গ করতে। সেখানে সেই সব গল্পগুলোই থাকবে যেগুলো সে বাতিল করেছে।
তুমি কী ধরনের মানুষ বুঝতে পারি না আমি। নিষাদ বলল।
আসলে একটা মনের মধ্যে অসংখ্য রঙ খেলা করে। কোনওটা লাল, কোনওটা নীল, হলুদ, সবুজ— ওই যে সাত রং মুখস্থ করতাম ছোটবেলায়, সেইসব বাদেও আরও কত রং তৈরি হয় মনের মধ্যে। আমরা তার হদিশ পাই না। কিংবা পেলেও আড়ালে রাখতেই ভালবাসি। ভয় পাই বে-আব্রু হয়ে গেলে যদি জীবনের ছন্দগুলো বদলে যায়, তাই লুকিয়ে রাখি, ঋধিমা বলল।
মানুষ কেন এত অহংসর্বস্ব হয় কে জানে?
অহংবোধ থেকেই আমিত্বের জন্ম। আমিটাই যদি না থাকে তবে সে আর জড় পদার্থের কী পার্থক্য?
তা বলে এভাবে?
ভুল করছ নিষাদ। প্রতিটি মানুষ জানে একদিন সে এই সব জাগতিক আকর্ষণ, মায়া, লোভ, অহংকার ছেড়ে বিদায় নেবে। মাটিতে মিশে যাবে তার শরীর, ছাই হয়ে ছড়িয়ে যাবে সর্বত্র। কিন্তু যদি সে এই ভাবনাতেই আক্রান্ত থাকে সারাক্ষণ তবে কখনওই কাজ করার তাগিদ অনুভব করবে না। তখন সব স্তব্ধ হয়ে যাবে। তার থেকে এই অহং যদি আরেকজনের উপকার করে, তবে তা ব্যবহার করাই ভাল। ঋধিমা হাসল কথাগুলো বলে।
নিষাদ বলল, তুমি অনেকটা অন্তরীক্ষের মতো। ভেতরে কী রহস্য লুকিয়ে তা বোঝা সম্ভব নয় কিছুতেই। তুমি বরং আরেক কাপ চা পান করো। বলে ফাঁকা কাপে চা ঢেলে দিল।
ঋধিমা দেখল উষ্ণ এক ধোঁয়ায় তার মনের ভিতরের বাষ্পগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে ঘর জুড়ে। তারপর জানলা দিয়ে তা ক্রমশ মিশে গেল বাতাসে।

Latest article