ফোর্থ ওয়েভ বা চতুর্থ ঢেউয়ে কোভিড খুব গুরুতর সমস্যার জায়গায় নেই। এখন কোভিড কেসে দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান খুবই কম। কিন্তু চতুর্থ ঢেউয়ের ভয়াবহতা হল কোভিড পরবর্তী যে সমস্যা ভীষণ ভাবে দেখা যাচ্ছে সেটা হল পোস্ট কোভিড সিকুয়েল বা পোস্ট কোভিড সিনড্রোম।
সাধারণত পোস্ট কোভিড সংক্রান্ত যা যা শারীরিক সমস্যা আসে সেগুলো এতদিন চার সপ্তাহ পর্যন্ত থাকত। তারপর ধীরে ধীরে চলে যেত। যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে তাঁদের দেখা যাচ্ছিল আরও কিছু ভোগান্তি চলছে। কিন্তু এইবার যেটা দেখা যাচ্ছে চার সপ্তাহ থেকে বারো সপ্তাহ পর্যন্ত পোস্ট কোভিড সিনড্রোম থাকছে অর্থাৎ তিনমাস অবধি এমনকী অনেকের ছ’মাস পেরিয়ে গেলেও কমছে না, কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-রোনাল্ডো আনফিট, ইঙ্গিত কোচের
কী কী ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়
প্রথমত যেটা হচ্ছে, সেটা হল ফ্যাটিগ। একটা ভীষণ দুর্বলতা। পায়ে, কোমরে টান ধরছে। মাসল ক্রাম্প। সারা গায়ে হাতে পায়ে একটা অসহ্য ব্যথা।
রোগী ইনসমনিয়া বা অনিদ্রার শিকার হয়ে পড়ছে। রাতে ঘুম আসতে চাইছে না। ঘুম কমে গেছে। বিক্ষিপ্ত ঘুম হচ্ছে এবং তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।
একটা মানসিক সমস্যা যা এই সিনড্রোমেরই অঙ্গ। একটা ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি সারাক্ষণ কাজ করছে। কিছুই ভাল লাগছে না।
প্যালপিটেশন বা বুক ধড়ফড় করছে। একটু সিঁড়ি ওঠানামা করলে প্যালপিটেশন বেড়ে যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
কোভিড পরবর্তীতে রোগী ক্রমাগত একটা পেটের সমস্যায় ভুগছে। একটানা হজমের গোলমাল যা সারছে না সেই সঙ্গে অ্যাসিডিটির সমস্যা অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে। খুব কমদিনের ব্যবধানে ডায়েরিয়া বা আমাশাজনিত সমস্যায় ভুগছেন বা একদিনে একাধিকবার খারাপ স্টুল হচ্ছে অনেকের।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে নারী নির্যাতনের নমুনা!
এছাড়া কারও কারও চেস্ট পেন বা বুকে একটা ব্যথা হচ্ছে। কারও স্যাচুরেশন ভাল কিন্তু হঠাৎ নেমে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট রয়ে যাচ্ছে একটানা।
হার্টের সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি ফুসফুসজনিত সমস্যাতেও তাঁরা একটানা ভুগছেন। একটু সর্দি-কাশি হলেই যা খুব বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যাঁদের আগেই লাং বা ফুসফুসের সমস্যা ছিল অর্থাৎ আজমা বা সিওপিডি-র পেশেন্ট তাঁদের লাং-এর সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এর সঙ্গে যাঁরা ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি বয়স্ক কোভিডের চতুর্থ ঢেউয়ে যাঁদের করোনা হয়েছে তাঁদের স্যাচুরেশন ধরে রাখতে না পারা বা শ্বাসকষ্টজনিত একটা সমস্যা রয়েই যাচ্ছে।
যাঁরা ক্রনিক স্মোকার বা ধূমপায়ী তাঁদের চতুর্থ ওয়েভে পোস্ট কোভিড সিনড্রোম একটানা অনেকদিন থেকে যাচ্ছে।
চতুর্থ ওয়েভে এসে মানুষ একটু বেপরোয়া হয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। পথে-ঘাটে একটু চোখ রাখলেই দেখা যাবে মাস্ক পরা এবং স্যানিটাইজেশন করা মানুষের মধ্যে একদম চলে গেছে। তাঁদের মধ্যে একটা ধারণা হয়েছে যে আর কিছু করার দরকার নেই। ওই একটু জ্বর হবে বা সর্দিকাশি হয়ে সেরে যাবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা বৃদ্ধির খুব প্রয়োজন যে চতুর্থ ঢেউয়ে কোভিডের পরবর্তী ভোগান্তি কিন্তু আগের তিনটে ঢেউয়ের চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক এবং ক্ষতিকর। এই সময় যে সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে তা অনেক বেশি সমস্যা তৈরি করছে।
আরও পড়ুন-চাপের কাছে মাথা নত নয়, ফের বললেন সঞ্জয়
এমনও দেখা যাচ্ছে যাঁরা কোনওদিন ডায়াবেটিক ছিলেন না তাঁদের কোভিড পরবর্তী সিনড্রোমে ডায়াবেটিস পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। আর যাঁদের ডায়াবেটিস ছিল সেটা নিয়ন্ত্রণ করলেও অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।
প্রয়োজনীয় সাবধানতা
প্রথম দরকার সুরক্ষা পদ্ধতির সবটা আবার নিয়ম মেনে করা। মাস্ক পরার এবং স্যানিটাইজেশনের দিন কিন্তু এখনও চলে যায়নি।
যাঁদের আগের ওয়েভগুলোয় কোভিড হয়ে গেছে এবং আবার চতুর্থ ওয়েভেও তাঁরা কোভিডে আক্রান্ত বা আগে হয়নি চতুর্থ ঢেউয়ে কোভিড হয়েছিল তাঁদের সবার আগে ধূমপান এবং মদ্যপান সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে। তাহলে পোস্ট কোভিড সিনড্রোম অনেকটা আটকানো যাবে।
এর পাশাপাশি যেসব পোস্ট কোভিড রোগী নিউরো-সাইকিয়াট্রিক বা মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, ডিপ্রেশনে ভুগছেন তাঁরা ঘরবন্দি বা মোবাইল বন্দি না থেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করুন।
আরও পড়ুন-গুজরাতে মন্ত্রীর ধর্ষণ, রাজ্যসভায় প্রতিবাদ দলের
বই পড়ার অভ্যেস করে ফেলুন। কারণ পোস্ট কোভিডে অনেকের টেম্পোরারি মেমরি লস হচ্ছে এবং কনসেন্ট্রেশন ব্রেক হচ্ছে বা বলা যেতে পারে মনোযোগ থাকছে না, একটা অস্থিরতা কাজ করছে সবসময়। বই পড়লে মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি বাড়বে। যদি খুব সিভিয়র হয় এই ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে।
পোস্ট কোভিডে স্লিপ ডিসটার্বেন্স হচ্ছে যাঁদের তাঁদের দিনের বেলা ঘুমোনো বন্ধ রাখতে হবে। সন্ধের দিকে চা, কফি ইত্যাদি ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় কম খাওয়া। যাতে যতটা সম্ভব নিজেকে রিল্যাক্স রাখা যায়।
খুব বেশিক্ষণ খালি পেটে না থাকা। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে একটা করে মিল নিতে হবে। অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর ডায়েট নিতে হবে। পুষ্টি সমৃদ্ধ খাওয়া-দাওয়া নিয়ম মেনে করলে পোস্ট কোভিড সিনড্রোমের সমস্যা কমবে।
এক্সারসাইজ শুরু করতে হবে। কার্ডিয়াক সমস্যা রয়েছে যাঁদের বা পোস্ট কোভিড কার্ডিয়াক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁদের ব্যায়াম এড়িয়ে চলতে হবে অন্তত তিনমাস।
কেমন হবে খাদ্যতালিকা৷ বললেন
ডায়েটেশিয়ান সোনালি ঘোষ
পোস্ট কোভিড সিনড্রোম কমাতে দরকার বিশ্রাম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং ব্যালান্সড ডায়েট মানে পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ভিটামিন ও মিনারেলসের সংমিশ্রণে তৈরি ডায়েট প্ল্যান। যা থেকে মিলবে শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালরি।
এই সময়টা খেতে হবে পরিমাণমতো কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার যাতে রয়েছে পরিমিত ফাইবার। যা আমাদের বাওয়েল মুভমেন্টকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে যেমন ওটস, হোলগ্রেন এবং মিলেট শস্যজাতীয় খাদ্য।
স্টার্চ যুক্ত খাদ্য যেমন আলু বা রাঙাআলু। ইমিউনিটি বাড়াতে ভীষণভাবে প্রয়োজন প্রোটিন জাতীয় খাদ্য-প্রাণীজ প্রোটিন। ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, ছানা, পনির, দই এবং ভেষজ প্রোটিন ডাল সোয়াবিন, রাজমা, ছোলা ইত্যাদিও খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে।
এছাড়া অবশ্যই খেতে হবে ফল যার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা ইমিউনিটি বাড়ায় দ্রুত।
ভিটামিন-সি রাখতে হবে যেমন আমলকী, করমচা, লেবু, পেয়ারা,পালংশাক, টমেটো, আম, কিউই, বেরিস জাতীয় ফল।
থাকবে জিঙ্ক যেমন রাজমা, বিন, ছোলা, আমন্ড, কুমড়োর বীজ, চিকেন, দুধ ইত্যাদি।
ভিটামিন ডি খুব জরুরি। ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে। সূর্যের হালকা রোদ খুব ভাল ভিটামিন ডি দেয়।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যেমন-সরষের তেল, সামুদ্রিক মাছ, বাদাম, ফ্ল্যাকসিড, চিয়া সিড ইত্যাদি।