বিলেতে থাকতে স্যার ডোনাল্ড রসের জীবনে যতটুকু রস ছিল ভারতে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে তা শুকিয়ে গেল। ওখানে ওঁর জীবন ছিল ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা কুল কুল আর এদেশে বিলকুল এক উল্টো জীবন। সারাক্ষণ হাত চুলকোচ্ছে, পা চুলকোচ্ছে, নাক চুলকোচ্ছে, গাল চুলকোচ্ছে। ভেতর থেকে কে যেন বারবার নির্দেশ দিচ্ছে, পাগলা চুলকে নে। ওদেশে থাকতে চিকিৎসা করা ছাড়া তেমন কিছু কাজ ছিল না তাঁর। একরকম মাছিই তাড়াতেন বলা যায়। কিন্তু এদেশে আসার পর থেকে তাঁকে মাছির সঙ্গে সঙ্গে মশাও তাড়াতে হচ্ছিল সারাক্ষণ। আর সেই মশাদের যে কত ধরনধারণ সেসব বলে আর শেষ করা যাবে না। এক-এক প্রদেশের মশাদের ভাষা আর আচরণ এক-এক রকম, কানের কাছে সারাবেলা যে পোঁ-পোঁ সোঁ-সোঁ তার আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি। ভারতে আসা ইস্তক তাঁর আর থিতু হওয়াও হচ্ছে না। কখনও মাদ্রাজ কখনও বর্মা, কখনও, বালুচিস্তান, আন্দামান অথবা সেকেন্দ্রাবাদ, পোস্টিং নিয়ে ছুটতে হচ্ছে যত্রতত্র। মনে রাখতে হবে, ইন্ডিয়া তখন অবিভক্ত হলেও নানা ভূখণ্ডে মশারা ছিল নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। মাদ্রাজি মশাগুলো যেমন ছিল ইয়া মোটা-মোটা তাগড়াই চেহারার, অন্যদিকে আবার বর্মা অথবা অধুনা মায়ানমারের মশাগুলো ছিল ছোটখাটো, নরমসরম।
আরও পড়ুন-ভালবাসার শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস
বিলেতে যেমন কাকু-জেঠু বলে বয়স্কদের কেউ ডাকে না, মিস্টার অমুক কি মিস্টার তমুক বলে ডাকে তেমনই ফরাসি দেখে কোনও ভদ্রলোককে মঁসিয়ে বলে সম্বোধন করা হয়। স্যার ডোনাল্ড রস এদেশে এসে লক্ষ্য করলেন মঁসিয়ে এদেশের জল হাওয়ায় মশাই হয়ে গেছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষদের এখানে পিসেমশাই কি মেসোমশাই বলে ডাকা হয় বেশি। এ-ছাড়া বিশিষ্টজনদের নামের পরে মশাই সম্বোধনটা এখানে খুবই প্রচলিত। যেমন রাজামশাই, জমিদারমশাই, মন্ত্রিমশাই, নায়েবমশাই, মাস্টারমশাই ইত্যাদি। চারদিকে শুধু মশাই মশাই। যেন মশা-ই এখানকার প্রথম সারির সম্মাননীয় চরিত্র। অথচ তিনি যে একজন মানবদরদি চিকিৎসক, কই কেউ তা তাঁকে কোনওদিন ডাক্তারমশাই বলে সম্বোধন করেনি! আরে, আলেকজান্ডার কি এমনি-এমনি তাঁর সেনাপতির কাছে আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!’
রাতের খাবার জুটুক বা না জুটুক ডোনাল্ড রস একটাই সামগ্রীকে নিশ্চিত করে রাখেন সর্বাগ্রে। সেটা হল মশারি। সেই মশারি আবার নিশ্ছিদ্র না হলে বিপদ। তা না হলে ফের বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের কেস হয়ে যাবে। ওদের জন্য লোহার তৈরি বাসরঘরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য যে চুলের মতো সূক্ষ্ম ছিদ্র ছিল তা দিয়েই ঢুকে পড়েছিল কালসর্প। পুরাণের এই কাহিনিতে বর্ণিত কায়দাটা তামাম মশককুল জেনে গেছে। ফলে, আলো নিভিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে মশা ছিদ্রান্বেষী হয়ে ওঠে, ফুটো খুঁজতে বেশি সময় লাগে না তাদের। দলে দলে তারা ঢুকে পড়ে ভিতরে। স্যার ডোনাল্ড রসের রক্তরস শুষে নেয় মহা উল্লাসের সঙ্গে।
আরও পড়ুন-এশিয়া কাপে নেই আফ্রিদি
ফুটোর এই গুরুত্বটা আবিষ্কার করেছিলেন স্যারজি স্বয়ং। রাতে ঘুম না এলে সিগারেট খাওয়া ছিল তাঁর অভ্যেস। নিশিকালে বারান্দা অথবা ঘরের মধ্যে ধূমপান করবেন তার উপায় নেই। কানের পাশে পাইলট ভ্যানের মতো পোঁওও পোঁওও সাইরেন বাজিয়ে মশার দল রণহুংকার দিচ্ছে। বিরক্তির একশেষ। তাই তিনি ঠিক করলেন মশারির ভেতরে বসেই সিগারেট খাবেন। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল সিগারেটের ছাই ফেলা নিয়ে। সেজন্য তিনি মশারির দেওয়ালে একটা ছোট্ট ফুটো করে নিয়েছিলেন। ছাই জমে গেলে সেই ফুটো দিয়ে সিগারেটটা বার করে ঝেড়ে ফেলতেন বাইরে। কিন্তু সেই ফুটো যে কত মারাত্মক হতে পারে সেটা টের পেলেন অচিরেই। রাত একটু গভীর হতেই ফুটো দিয়ে এত মশা ঢুকে পড়ল যে গুনে শেষ করা যাবে না । বাইরে একটিও মশা আর নেই। সব মশা-ই মশারির ভেতরে! সে-রাতের মতো রস সাহেব ধুত্তোর বলে বেরিয়ে এলেন বাইরে এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তাঁকে আর কোনও মশা কামড়াচ্ছে না। কারণ ঘরের সমস্ত মশা তো তখন মশারির ভেতরেই। হয়তো অভিমন্যুর মতো তারা চক্রব্যূহে ঢুকতে পারে কিন্তু বেরিয়ে আসার পথ তাদের জানা নেই।
আরও পড়ুন-চা-শ্রমিক সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন
এ ঘটনার পর ডাক্তারবাবু আর একটি চমৎকার কায়দা আবিষ্কার করেছিলেন। ইতিহাসে তা লেখা নেই। গভীর পর্যবেক্ষণ থেকে তাঁর জানা হয়ে গিয়েছিল মশারিতে ফুটো থাকলে মশা ঢুকবেই। সেজন্য তিনি ওই ফুটোটির বিপরীতে আর একটি ফুটো করলেন। এবার একটি হালকা পাইপ জোগাড় করে এক ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য ফুটো দিয়ে বার করে দিলেন। এবারে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন মশারি গুঁজে। যা ভেবেছিলেন, তাই-ই হল। এ পাশের ফুটো দিয়ে হু-হু করে মশারা ঢুকে পাইপ বাহিত হয়ে বেরিয়ে গেল অন্য পাশের ফুটো দিয়ে। সারারাত এভাবে চক্কর কেটেও তারা আর মিস্টার রসের রক্তরস নিংড়ে নিতে পারল না। এর পর থেকে অন্তত রাতের বেলায় মশারা আর কখনও ডাক্তারবাবুর ঘুম কেড়ে নিতে পারেনি।
আরও পড়ুন-চা-শ্রমিক সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন
মানুষের কাছে মশা তুচ্ছ একটি পতঙ্গ। অনেক ডাকাবুকো মানুষ দুর্বল মানুষকে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়ে বলেন ‘তোকে মশার মতো টিপে মেরে দিতে পারি।’ তবে শুধু মনুষ্য সমাজে নয় মশাদের সমাজেও নাকি তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই। ওপার বাংলার একজন প্রাচীনার কাছে এ বিষয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম। আজ মশাদের নিয়েই যখন কথা হচ্ছে, তখন এই গল্পটি শোনাবার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। এক মশা-মশাইয়ের তিন বউ। গৃহকর্তাটি রক্তের খোঁজে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ, এখনও ঘরে ফেরার নামগন্ধ নেই। চিন্তিত প্রথম বউ বলে উঠল, ‘সেই যে গেলেন তিনি আর তো ফিরলেন না।’ দ্বিতীয় বউ অনেকটাই নিশ্চিন্ত। সে জবাবে বলে, ‘খেয়েদেয়ে পড়ে আছেন নড়তে পারেন না।’ দুই বউয়ের এহেন কথোপকথনে তৃতীয় বউ দৃশ্যতই বিরক্ত। সে জবাবে ফোড়ন কেটে বলে ওঠে, ‘থাপ্পড় দিলে চ্যাপ্টা, ডলা দিলে নাই / সেই সোয়ামির আবার এমন বড়াই!’
আরও পড়ুন-লর্ডসেই সম্ভবত বিদায় ঝুলনের
যাঁকে নিয়ে এই লেখার শুরু এবার তাঁর প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসা যাক। স্যার ডোনাল্ড রস কবিতার ভক্ত ছিলেন, নিজেও লিখতেন বেশ। তিনি হয়তো মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই বিখ্যাত কবিতাটি পড়েছিলেন কখনও। ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়।’ পড়তে গিয়ে হয়তো ভেবেছিলেন, এখানে পা দেওয়ার পর মশা তাঁর জীবনকে যে ভাবে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতাটি তিনি
লিখলে প্রথম চরণটি হত, ‘মশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়…।’ কিন্তু কবিতা লিখে ছলনার সঙ্গে আপস করার পাত্র তিনি নন। তাঁর পেছনে মশাদের লাগতে না দিয়ে তিনি নিজেই লেগে পড়লেন মশাদের পেছনে। নিরলস সাধনায় আবিষ্কার করলেন আসলে অ্যানোফিলিস মশাই হল মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়া রোগের বাহক। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারটা হয়েছিল ২০ অগাস্ট, সালটা ছিল ১৮৯৭। তাঁর এই অমূল্য আবিষ্কারকে সম্মান জানাতে সেই থেকে সারা দুনিয়ায় এই বিশেষ দিনটিকে ‘বিশ্ব মশা দিবস’ হিসেবে পালনের মহোৎসব হয়ে চলেছে। গতকালই ছিল সেই দিন।